বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
Proval Logo

কোটা আন্দোলনে রফতানি ও  রেমিট্যান্স প্রবাহে অনিশ্চয়তা

প্রকাশিত - ০৪ আগস্ট, ২০২৪   ০৮:৫৯ পিএম
webnews24

প্রভাত রিপোর্ট : দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন বছর ধরেই কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে রিজার্ভের পতন থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। এক্ষেত্রে এত দিন রফতানি ও রেমিট্যান্সের ডলার বেশ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু হঠাৎ শুরু হওয়া কোটা আন্দোলনে রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে এর আঘাত লেগেছে রিজার্ভেও। এই রিজার্ভ আরও কমে গেলে কী হবে, তা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কার পরিণতি উৎকণ্ঠিতও করছে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে রয়েছে আলোচনা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে সামনের দিনগুলোতে রিজার্ভের ওপর বেশি চাপ পড়বে।  কারণ হিসেবে তারা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে দেশ থেকে প্রচুর পরিমাণে ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। আবার রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেছেÍ যার ফলে ব্যাংকে ও ব্যাংকের বাইরের খোলা বাজারে ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে করে ব্যাংকে ও ব্যাংকের বাইরে কোথাও নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে না।  নির্ধারিত ১১৮ টাকা ডলার কিনে এলসির দেনা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১২২ থেকে ১২৩ টাকা দরে পরিশোধ করতে হয়েছে। এছাড়া খোলা বাজারে প্রতি ডলারের দাম ১১৯ টাকায় নির্ধারণ করে দেওয়ার নির্দেশনা মানছে না কেউ। ১ আগস্ট) খোলা বাজারে এক ডলার কিনতে গ্রাহককে গুণতে হয়েছে ১২৫ টাকা ৫০ পয়সা। খোলা বাজারের একাধিক ডলার বিক্রেতারা জানান, বিদেশ থেকে ফেরার সময় প্রবাসীরা যে ডলার নিয়ে আসেন, খোলা বাজারে সেসব ডলার বিক্রি হয়।
তারা বলছেন, চলমান পরিস্থিতিতে মানুষ বিদেশ থেকে আসছে কম। কিন্তু বিদেশে যাচ্ছে বেশি। যাওয়ার সময় সবাই ডলার নিয়ে যাচ্ছেন। বিদেশ থেকে প্রবাসীরা কম আসার কারণে ডলার সরবরাহ কমে গেছে। সংকট তৈরি হওয়ায় ডলারের দাম বেড়ে গেছে।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে  দেশে ডলারের ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন  বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।  তিনি বলেন, ‘চলমান পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে দেশে তিনটি বড় সমস্যা তৈরি হবে। প্রথমত, হুন্ডির পাশাপাশি দেশ থেকে অর্থপাচার বহুগুণ বেড়ে যাবে। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই রিজার্ভ শূন্য হয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’
বর্তমান সময়কে ‘অর্থপাচারের মৌসুম’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘চলমান ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অনেকেই এখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। অলরেডি কেউ কেউ যাচ্ছে। যাওয়ার সময় তারা ডলার নিয়ে যাচ্ছে। অবৈধ অর্থ উপার্জনকারী রাজনৈতিক নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংক লুট করা ব্যবসায়ীদের মতো অনেক ব্যবসায়ী দেশ ছেড়ে চলে যাবে। এতে করে দেশে ডলারের ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, আন্দোলন দীর্ঘায়িত হলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর আঘাত আসবে। প্রতি মাসে ৬ বিলিয়ন আমদানি খরচ মেটাতে গিয়ে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই শূন্য হয়ে যেতে পারে। তিনি উল্লেখ করেন, ডলারের কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি, ফান্ডিং ফর পেমেন্ট সার্ভিস যদি কমে যায়, আরেকটা ধাক্কা আসতে পারে। ধাক্কাটা অলরেডি খেয়েছে। যদি এটা দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে আরও বড় ধাক্কা আসতে পারে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রফতানি তথ্য সংশোধনের পর চলমান স্থবিরতার কারণে রফতানি নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এরইমধ্যে সব খাতে রফতানি আয় কমেছে। যদিও রিজার্ভ কমা ঠেকাতে ডলারের ভীষণ প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, চলমান অস্থিরতার কারণে রফতানিকারকরা পণ্য সরবরাহ করতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে বিদেশি ক্রেতারা অনিশ্চয়তা ও উদ্বিগ্নের মধ্যে রয়েছেন।
তিনি মনে করেন, অস্থিরতার কারণে গত ১২ দিনে অন্তত ৩০০ কোটি ডলারের রফতানি আদেশ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। তার ধারণা, ওইসব কার্যাদেশ বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোকে দেওয়া হয়েছে। সৌভাগ্যবশত আগের কার্যাদেশগুলো বাতিল হয়নি। তবে বিদেশি ক্রেতারা এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সদ্য বিদায়ী জুলাই মাস শেষে সেই রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। আর নিট রিজার্ভ কমে ১৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। অর্থনীতিবিদদের অনেকের মতে, রিজার্ভ অলরেডি বিপদজনক মাত্রায় চলে গেছে। তারা বলছেন, ২০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক থাকার পরও বিগত দুই বছরের প্রায় প্রতি মাসেই রিজার্ভ গড়ে ১ বিলিয়ন ডলার করে কমছে। সর্বশেষ সদ্য সমাপ্ত জুলাইয়ে রিজার্ভ কমেছে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন, বা ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত প্রায় তিন বছরে (৩৫ মাসে) রিজার্ভ কমেছে কমপক্ষে ২৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সার ও খাদ্যসহ সরকারি আমদানির দায় পরিশোধে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি জুলাইয়ে প্রবাসী আয়ও জুনের তুলনায় ২৫ শতাংশ কমে গেছে। অথচ প্রতি মাসে আমদানি ব্যয়ে খরচ করতে হচ্ছে সাড়ে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এ কারণে রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় দুটি উৎস রফতানি ও প্রবাসী আয়। এই দুই খাত থেকে আয় কমলে তাতে রিজার্ভও কমে যায়।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান ছাত্র আন্দোলনের সুরাহা না হলে এবং রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক না হলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই রিজার্ভ শূন্য হয়ে যাবে । অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এমন সময়ে রিজার্ভ শূন্য হতে যাচ্ছে, যখন বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রোরেল ও কর্ণফুলী টানেলের মতো মেগা প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হলেÍ এ চাপ আরও অনেক জোরালো হয়ে উঠবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের শুরু থেকেই প্রতি মাসে রফতানি আয় এসেছে গড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের কম-বেশি। আর প্রতি মাসে রেমিট্যান্স এসেছে গড়ে ২ বিলিয়ন ডলারের কম-বেশি করে। তবে চলমান ছাত্র আন্দোলনের কারণে দেশে ডলারের সরবরাহ কমতে শুরু করেছে।
 

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন