• মঙ্গলবার, ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:৫৮ পূর্বাহ্ন

বিষাক্ত ঢাকার বাতাস ও করনীয়

প্রভাত রিপোর্ট / ৩০ বার
আপডেট : বুধবার, ১২ মার্চ, ২০২৫

ড. আহমদ আল জোবায়ের

বায়ুদূষণে ২০২৪ সালে দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ দূষিত নগর ছিল ঢাকা। ২০২৩ সালে বায়ুদূষণে বাংলাদেশ শীর্ষে ছিল। নগর হিসেবে ঢাকার অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। গত বছর বায়ুদূষণে শীর্ষ দেশ ছিল আফ্রিকার চাদ। আর নগর হিসেবে শীর্ষে ছিল ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি। গতকাল মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’-এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সার্বিকভাবে বায়ুদূষণে আগের বছরের তুলনায় গত বছর বাংলাদেশের অবস্থানের সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। শীর্ষ অবস্থান থেকে বাংলাদেশের স্থান হয়েছে দ্বিতীয়। আর নগরীগুলোর মধ্যে ঢাকা দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় হয়েছে। তবে এই পরিবর্তনকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন না পরিবেশবাদী ও গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, দূষণ আরও বিস্তৃত হচ্ছে, এবারের প্রতিবেদন সেই বাস্তবতাকে তুলে ধরেছে। কারণ, আগে দেখা গেছে যে রাজধানীর তুলনায় দেশের সার্বিক গড় বায়ুমান কিছুটা ভালো থাকত। কিন্তু এবারের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশ এবং দেশের সবচেয়ে দূষিত নগরী ঢাকার বায়ুর মান প্রায় একই। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র ছয় মাসে বায়ুমানের অনেক উন্নতি হবে, তা আশা করা ঠিক নয়। কিন্তু আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি, যাতে এমন আশা করতে পারি যে আগামী শুকনা মৌসুমে ঢাকা এবং দেশের অন্যত্র বায়ুমানের উন্নতি হবে।’ তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তার পাশের খোলা স্থান ঘাস দিয়ে আচ্ছাদিত করা হবে। তাতে অন্তত ধুলাদূষণ কমবে। ছয়জন ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে সাড়ে ছয় হাজার ইটভাটা পর্যবেক্ষণ করা যায় না। এ ক্ষেত্রেও নজরদারি বাড়ানোর চেষ্টা থাকবে।
বাতাসের মান নিয়ে আইকিউএয়ার তৈরি করে তাৎক্ষণিক সূচক; যা একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর আইকিউএয়ার দূষণের বার্তা হালনাগাদ করে। এসব প্রতিবেদন একত্র করে বার্ষিক বৈশ্বিক প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এবার ১৩৮টি দেশ ও অঞ্চলের ৮ হাজার ৯৫৪টি শহরের প্রায় ৪০ হাজার নজরদারি স্টেশন থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। আগের বছর ১৩৪টি দেশ থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছিল। সে তুলনায় এবারের প্রতিবেদন অনেক বিস্তারিত করা হয়েছে। বরাবরের মতো এবারের প্রতিবেদনেও বায়ুদূষণের অন্যতম উপাদান পিএম ২.৫ বা অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপাদান ধরেই এই বায়ুর মান নির্ণয় করা হয়েছে। পিএম ২.৫ মূলত ধূলিকণা। এটি স্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক। কণাগুলো ফুসফুস ও রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, পিএম ২.৫-এর গড় বার্ষিক মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের প্রতি ঘনমিটার বায়ুতে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম ২.৫) উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম। আর ২০২৩ সালে তা ছিল ৭৯ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বেঁধে দেওয়া মানদণ্ডের চেয়ে অন্তত ১৫ গুণ বেশি। এবারের প্রতিবেদনে বায়ুদূষণে শীর্ষে আছে আফ্রিকার চাদ। দেশটির বায়ুতে পিএম ২.৫ এর উপস্থিতি ৯১ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম।
এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অনেক অঞ্চল এবং দেশে দূষণের মাত্রা তীব্র হলেও পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ না থাকায় ওই সব এলাকার দূষণ পরিস্থিতি হিসাবের মধ্যে আনা যায় না। এর মধ্যে আফ্রিকা ও পশ্চিম আফ্রিকার কিছু দেশ আছে। দূষণে শীর্ষ স্থানে থাকা চাদ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়ায় ২০২৩ সালের প্রতিবেদনে এ দেশের নামই ছিল না। এবারের প্রতিবেদনে ভয়ানক দূষণে আক্রান্ত আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর নাম নেই। এর কারণ প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়া। ২০২৩-এর প্রতিবেদনে বুরকিনা ফাসোর অবস্থান ছিল পঞ্চম। এবার বায়ুদূষণে বাংলাদেশের পরই আছে পাকিস্তান। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে যথাক্রমে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ও ভারত। তবে দূষণের তালিকায় থাকা প্রথম তিনটি দেশের তুলনায় পরের দেশগুলোর বায়ুর মান অপেক্ষাকৃত উন্নত। দূষণে প্রথম থেকে তৃতীয় স্থানে থাকা দেশগুলোর বায়ুর মান ৭০ বা এর বেশি। কিন্তু চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানের গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ও ভারতের বায়ুর মান যথাক্রমে ৫৮ দশমিক ২ ও ৫০ দশমিক ৬। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) দেশের বিভিন্ন শহরের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি নিয়ে সার্বক্ষণিক গবেষণা করে। ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার গতকাল এই প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বায়ুদূষণে দ্বিতীয় শীর্ষ স্থানে থাকাটা আমাদের জন্য মোটেও ভালো সংবাদ নয়। আগের বছরের চেয়ে ২০২৪-এ আমরা তেমন উন্নতি করতে পারিনি। কিন্তু আমরা দেখেছি, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি আগের ৯ বছরের চেয়ে বেশি দূষিত ছিল। এ বছর বায়ুদূষণ আরও বেড়ে যাচ্ছে।’
আইকিউএয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নগর হিসেবে দূষণের দিক থেকে ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। এ নগরের বায়ুতে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ছিল ৭৮ মাইক্রোগ্রাম। ২০২৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ৮০ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম। এ তালিকায় শীর্ষে থাকা নয়াদিল্লির বাতাসে পিএম ২.৫-এর উপস্থিতি ৯১ দশমিক ৮। ২০২৩ সালে তা ছিল ৯২ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ সর্বোচ্চ দূষিত এ নগরীরও বায়ুর মান কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে। এবার ঢাকা এবং সার্বিকভাবে বাংলাদেশেরও বায়ুর মান ৭৮। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মাধ্যমে এটিই প্রমাণিত হয় যে দূষণ বিস্তৃত হচ্ছে। বায়ুদূষণ মানব স্বাস্থ্যের প্রতি একটি বড় হুমকি। ডব্লিউএইচওর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট মৃত্যুর দ্বিতীয় কারণ বায়ুদূষণ। আর পাঁচ বছরের নিচের বয়সী শিশুদের মৃত্যুরও দ্বিতীয় কারণ এটি। বাংলাদেশেও দূষণে ক্ষতি কম নয়। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৯ সালে বায়ুদূষণসহ চার ধরনের পরিবেশদূষণে ২ লাখ ৭২ হাজারের বেশি মানুষের অকালমৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণের কারণে। এ ছাড়া দূষণের কারণে ওই বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। দূষণ রোধে সরকারি যেসব তৎপরতা আছে, সেগুলো কার্যকর নয়। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে সঠিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
রাজধানী ঢাকার বাতাস এখন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আর এ বিষাক্ত বাতাসের অন্যতম কারণ, পুরনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়ির কালো ধোঁয়া, যা প্রতিদিন আমাদের শ্বাসযন্ত্রে প্রবাহিত হচ্ছে। গাড়ির ধোঁয়া, ইট ভাটা থেকে নির্গত বিষাক্ত কণা, নির্মাণকাজের ধুলাÍসবকিছু মিলিয়ে ঢাকার বাতাস এখন সবচেয়ে বেশি দূষিত। বিশ্ব বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজুয়ালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকার একাধিক এলাকা বর্তমানে বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষস্থানীয়। বিশেষত, শীতকালে ঢাকা প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় এক নম্বরে উঠে আসে। একিউআই (বায়ু মান সূচক) স্কোর ২০০ ছাড়িয়ে গেলে এটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য অস্বাস্থ্যকর, এবং ৩০১ থেকে ৫০০ এর মধ্যে স্কোর হলে তা বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। অথচ ঢাকায় এই স্কোর প্রায়ই অতিরিক্ত মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছে, যা প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এই দূষণ শুধু নগরবাসীদের শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যই হুমকি নয়, বরং আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, শিল্পায়ন, অবৈধ ইট ভাটা, ও নিয়মবিহীন নির্মাণকাজÍএসব কারণেই ঢাকার বাতাস এতটা দূষিত হয়েছে। এতে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যান্সার, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া সহ নানা রোগের প্রকোপ বাড়ছে। ঢাকাবাসী প্রতিদিনই এই বিষাক্ত বাতাসে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছেন, যার প্রভাব তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে অপরিসীম। এয়ার ভিজুয়াল ৮ মার্চ, ২০২৩ তারিখে রিপোর্ট করেছে যে, ঢাকার বাতাস ছিল অস্বাস্থ্যকর এবং বিশেষজ্ঞরা জনগণকে ঘরের বাইরে শরীরচর্চা থেকে বিরত থাকতে, মাস্ক পরতে, এবং ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে পরামর্শ দিয়েছে। এছাড়া, দূষণের মূল উৎসগুলির মধ্যে ইট ভাটাগুলি অন্যতম। রাজধানীর আশপাশে অবৈধ ইট ভাটা সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন ছাড়া কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা শহরের বাতাসের পিএম ২.৫ (অতিসূক্ষ্ম বস্তুকণা) মাত্রা বাড়াচ্ছে। এছাড়া, রাজধানীতে চলাচলকারী পুরনো গাড়ির কালো ধোঁয়া এবং দহনশীল জ্বালানি ব্যবহারের ফলে পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। বিআরটিএ’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি, এবং প্রতিদিন এগুলি বাতাসে বিষাক্ত কণা ছড়াচ্ছে। এখন সময় এসেছে, ঢাকার দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের। পরিবেশ অধিদফতর, সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য সরকারি সংস্থাগুলিকে একযোগে কাজ করতে হবে। ইট ভাটার নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ, গাড়ির ফিটনেস যাচাইÍএসব ক্ষেত্রে কঠোর নজরদারি চালানো অত্যন্ত জরুরি। এছাড়া, জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। মাস্ক পরা, ঘরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখা, এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহার করাÍএইগুলোই হতে পারে পরিবেশের প্রতি আমাদের দায়িত্ব। ঢাকার বাতাসের এই বিষাক্ত অবস্থা যদি তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণে না আসে, তবে আগামী প্রজন্মের স্বাস্থ্য ও জীবনমানের উপর বিপর্যয়কর প্রভাব পড়বে। এখনই সময়, একত্রিত হয়ে এই সংকট মোকাবিলা করা, না হলে ঢাকার বাসিন্দাদের জন্য ভবিষ্যত হবে আরও অন্ধকার।

লেখক : জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও গবেষক


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরও