• বুধবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৫৬ পূর্বাহ্ন

রোনালদোরই কার্বন কপি ছেলে ক্রিস্টিয়ানো জুনিয়র

প্রভাত রিপোর্ট / ৩ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০২৫

প্রভাত স্পোর্টস: ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর বড় ছেলে, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জুনিয়র। বাবারই কার্বন কপি। বাবার মতো খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা হয়। তারপর প্রথম যে কাজটি জুনিয়র করে সেটা হলো, গোটা দিনের পরিকল্পনা বাবাকে জানায়। কোনো ভুলত্রুটি বা পরামর্শ থাকলে সিনিয়র তা শুধরে দেন। মুখটা ধুয়ে বাবার হাতে বানানো প্রোটিন শেক খেয়ে দিনটা শুরু করে জুনিয়র। বাইরে থেকে একটু ঘুরে এসে সকালের নাশতায় ফল ও ইয়োগার্টই বেশি পছন্দ তার। বাবার ব্যক্তিগত ইচ্ছা কী সে হয়তো জানে না, তবে এটা জানে, বাবা একটু সময় দেবেই। এর মধ্যেই তাকে তৈরি হয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ বাবার অবসর নেয়ার এখনো দেরি আছে। ঠিক কতটা, সেটা সে হয়তো জানে না, আন্দাজ করতে পারে। দুই বছর?
ষোলো-সতেরোর ভেতর সে মূল দলে চলে এলেই বাবার অপেক্ষার অবসান। বাবা কেন বুট তুলে রাখে না, সেটা জুনিয়রের তাই ভালোই জানা। আসল কথা হলো, অবসর নেয়ার আগে তার বাবা তার সঙ্গে খেলতে চান। গত মাসেই কথাটা বলেছেন ফরাসি সংবাদমাধ্যম ‘ক্যানাল১১’কে, ‘আমি এটা চাই। এমন না যে এটার জন্য রাতে ঘুম হয় না, কিন্তু হলে ভালো হতো।’
জুনিয়র জানে, ফুটবলের তাবৎ উঁচু উঁচু স্বপ্ন ধরাশায়ী করলেও এই স্বপ্ন তার বাবা চাইলেই পূরণ করতে পারবেন না। বাবা তো আর আল নাসর অনূর্ধ্ব-১৫ দলের সঙ্গে মাঠে নামতে পারবেন না! যা করার তাকেই করতে হবে। আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে উঠে আসতে হবে আল নাসরের মূল দলে। সর্বোচ্চ ৩ বছর? তখন হয়তো সম্ভব। এর মধ্যে আসল কাজটা করতে হবে তাকে। বাবা সেটাও সেই ফরাসি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, দেখা যাক। ব্যাপারটা আমার চেয়ে তার (জুনিয়র) ওপর বেশি নির্ভর করছে। বাবার জায়গা থেকে দেখলে জুনিয়রের কাঁধে অনেক দায়িত্ব। কিন্তু বাবা আগেই বলে দিয়েছেন সবাইকে, ক্রিসের যেটা ভালো লাগে করবে। আমি হবো গর্বিত বাবা।
ফুটবলটা যে তার ভালো লাগে না, তা নয়। অবশ্যই ভালো লাগে। আর লোকেও বলে, বাপ কা বেটা; খেলার ধরন ও ধার দেখে। ২০১৯ সালে সংবাদমাধ্যমে বের হয়েছিল, জুভেন্টাসের বয়সভিত্তিক দলের হয়ে ২৮ ম্যাচে ৫৮ গোল করেছে। আসলে বাবার খেলার জায়গাগুলোই জুনিয়রের ফুটবল পাঠশালা। রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাস ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের একাডেমি পেরিয়ে এখন আল নাসরের বয়সভিত্তিক দলে। গত বছর অনূর্ধ্ব-১৩ দলকে সৌদি প্রিমিয়ার লিগ জিতিয়ে এখন অনূর্ধ্ব-১৫ দলে বাবার মতোই ৭ নম্বর জার্সির খেলোয়াড়।
১০ বছর আগে ‘দ্য জোনাথন রস শো’তেই রোনালদো বলেছিলেন, ‘ক্রিস্টিয়ানো বড় হওয়ার পর আমি অবশ্যই তাকে সত্যটা বলব, কারণ, এটা তার প্রাপ্য।
এরপর শুরু হয় বাবার সঙ্গে জিমে অনুশীলন। প্রতিদিনই নিজের শরীরটা নিয়ে কাজ করে জুনিয়র। এই কাজে ‘শিক্ষক’ তার বাবাই। বাসায় রোজকার এসব অনুশীলন সেশনের মাঝে জুনিয়র আরও একটি কাজ করে। বল নিয়ে ভাইবোনদের সঙ্গে খেলতে সে খুব পছন্দ করে। তার ছোট ছোট ভাইবোনও এই খেলায় খুব মজা পায় বলে জানিয়েছেন রোনালদোর আর্জেন্টাইন প্রেমিকা জর্জিনা রদ্রিগেজ। রিও ফার্ডিনান্ডের পডকাস্টে রোনালদোও কিছু মজার তথ্য জানিয়েছেন। জুনিয়রের সঙ্গে প্রতিদিনই প্যাডেল খেলেন তিনি। খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার বশে বাবা-ছেলের মধ্যে ঝগড়াও লাগে। তখন কিছুদিনের জন্য দুজনের মধ্যে কথা বলার বিরতি চলে। পরে আবার ঠিক হয়ে যায়। আসলে রোনালদোর সন্তানেরা তাঁর মতোই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। জুনিয়র একটু বেড়ে ওঠায় তার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনোভাবটি এখন বেশি বোঝা যায়।
রোনালদোর ভাষায়, ‘এমনকি ছোট্ট মাতেও পর্যন্ত খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মনোভাবের। আমার ভালো লাগে। কারণ, তাদের ব্যক্তিত্বটা এতে বোঝা যায়। সত্যি বলতে, আমার সন্তানেরা আমার মতোই। আমি তাদের কিছু শেখাই না, আমাকে তারা উদাহরণ হিসেবে দেখে। কখনো রেগে যাই, কখনো কাঁদি, তারাও একই রকম। আমি তাদের সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। কোনোকিছু সহজে জিততে দিই না।’
জুনিয়ররা পাঁচ ভাইবোন। সে সবার বড়, জন্ম ২০১০ সালের ১৭ জুন, যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁর বয়স যখন ৭ বছর, ২০১৭ সালে সেই যুক্তরাষ্ট্রে, সেই জুনেই পেল দুই যমজ ভাই–বোন এভা ও মাতেওকে। সারোগেট করে জুনিয়রকে একটি ভাই ও বোন এনে দেন রোনালদো ও জর্জিনা রদ্রিগেজ। এর কয়েক মাস পরে নভেম্বরে জর্জিনার গর্ভে জন্মায় অ্যালানা। ফুটফুটে আরেকটি বোন। এরপর ২০২২ সালে জর্জিনার গর্ভে জন্মায় আরও দুই যমজ সন্তান বেলা ও অ্যাঞ্জেল। তবে জন্মের কিছুক্ষণ পরেই মারা যায় অ্যাঞ্জেল।
জর্জিনাকে জুনিয়র মায়ের মতোই ভালোবাসে। পাঁচ-ছয় বছর বয়স থেকে মায়ের আদরে তাকে আগলে রেখেছেন জর্জিনা। জন্ম দিয়েছেন যিনি, সেই মা কে, সে জানে না। একটু বড় হওয়ার পর জেনেছে, বাবা এ কথা কাউকে বলেননি। তার জন্মের পর বাবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে শুধু বলেছিলেন, ‘বাচ্চার মায়ের চাওয়ায় ও দুই পক্ষের সম্মতিতে তার পরিচয় গোপন রাখা হবে…।’
তিন বছর আগে ১৯ এপ্রিল রোনালদো ইনস্টাগ্রামে খবরটি জানিয়েছিলেন বিশ্বকে। জুনিয়রও জীবনে আরেক জোড়া যমজ ভাই-বোনের দেখা পায়নি। শুধু বোনকে পেয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, শুধু মেয়ে শিশুটির জন্মই আমাদের এ মুহূর্তত পার করার শক্তি ও আশা দিতে পারে। জুনিয়র এখন নিশ্চয়ই বোঝে, বাবা আসলে বেলাকে আঁকড়ে অ্যাঞ্জেলের মৃত্যুর শোক ভোলার চেষ্টা করেছেন।
প্রায় আটে পা রাখতে যাওয়া মাতেও বাবার মতোই আত্মবিশ্বাসী। বাবাকে সে বলে এমবাপ্পে তোমার চেয়ে ভালো।’ সে এমবাপ্পের বড় ভক্ত। ফুটবলেও মন্দ না। তবে কোনো একাডেমিতে আছে বলে শোনা যায়নি। জুনিয়র সৌদি আরবের রিয়াদে মাহধ স্পোর্টস একাডেমিতে ভর্তি হয়েছে বলে ২০২৩ সালে খবর বের হয়েছিল।
বয়সে দুই বছরের বড়দের সঙ্গে সে নাকি সেখানে অনুশীলন করেছে। নির্মাণকাজ শেষে এটি হবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্পোর্টস একাডেমি। জুনিয়র কোন স্কুলে ভর্তি হয়েছে সৌদি আরবে, সেটা এখনো অজানা। তবে মাহধ স্পোর্টস একাডেমিতে লেখাপড়ার ব্যবস্থাও আছে। যদিও আল নাসরের একাডেমিতে যোগ দেওয়ায় তাঁর লেখাপড়ার ভার ক্লাবটিরই নেওয়ার কথা।
বড় হয়ে জুনিয়র কোন জাতীয় দল বেছে নেবেন, সেটা একটা প্রশ্ন। তিনটি দেশের প্রতিধিত্ব করার সুযোগ রয়েছে তার। বাবার সূত্রে পর্তুগাল, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়ায় সে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগও রয়েছে। তাঁর বাবা রিয়াল মাদ্রিদে থাকতে স্পেনে তিন বছরের বেশি সময় কেটেছে জুনিয়রের। দেশটির নিয়ম অনুযায়ী, স্পেনেরও প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ রয়েছে জুনিয়রের। তবে সে পর্তুগালের বড় সমর্থক। বাবার পথ ধরে তাঁর পর্তুগাল জাতীয় দল বেছে নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
সৌদি আরবে আরবি ভাষাটাও রপ্ত করে ফেলেছে রোনালদো পরিবার। জুনিয়রের আরবিতে কথা বলার ভিডিও ইউটিউব থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আছে। বেলা ও অ্যালানা শুধু কথা বলা নয়, আরবিতে গানও গাইতে পারে।
জুনিয়রের কষ্ট আছে আরও। তিন বছর আগে তাঁর বাবা বিষয়টি বলেছিলেন, প্রযুক্তির প্রতি অবসেসড হয়ে ছেলে যেন নিজের সম্ভাবনা নষ্ট করতে পারে, সে জন্য ততদিন পর্যন্তও হাতে ফোন তুলে দেননি।
জুনিয়র জেনেছে, বিখ্যাত বাবার সন্তান হিসেবে সব সময় ভালো অভিজ্ঞতা হয় না। গত বছর সেপ্টেম্বরে স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এএস জানিয়েছিল, লিসবনের কাসকাইসে ম্যানশন থাকায় সন্তানদের পর্তুগালে লেখাপড়া করানোর চেষ্টা করেছিলেন রোনালদো-জর্জিনা। অভিজাত সেন্ট জুলিয়ান স্কুলে ভর্তির চেষ্টা করেন। কিন্তু রোনালদোর খ্যাতির কারণে স্কুলটি তাঁর সন্তানদের ভর্তি নেয়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ চাননি, তাদের প্রতিষ্ঠান সার্বক্ষণিক খবরের উৎস হোক।
জুনিয়রের নিজেরই কি কম ঝক্কি? বাবার সঙ্গে জিমে কাটিয়ে শরীরটা বেশ শক্তপোক্ত হয়েছে, দু-একজন মেয়ে বন্ধু তো থাকলে ক্ষতি কি! কিন্তু বাড়ির বাকি সদস্যের ভাবখানা দেখলে! নেটফিক্সের ‘আই অ্যাম জর্জিনা’ তথ্যচিত্রের তৃতীয় মৌসুমে দেখা যায়, প্যারিসের ডিজনিল্যান্ডে জুনিয়রকে দেখে কম বয়সী মেয়েরা কাত হয়ে গেছে।
জর্জিনার ব্যক্তিগত ট্রেনার সরায়া আলভারেজ জুনিয়রের কাছে জানতে চান, গার্লফ্রেন্ড আছে কি না? জুনিয়র ভাজা মাছটি উল্টে খেতে না পারার মতো পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কি? গার্লফ্রেন্ড কী? আমার গার্লফ্রেন্ড নেই।’ এর কিছুক্ষণ পরই জর্জিনা বলেছেন, ‘আমি জানি ওর গার্লফ্রেন্ড আছে, কেউ একজন বলেছে।’ জুনিয়র তখন ভাবমূর্তি বাঁচাতে মরিয়া, ‘না সে আমার গার্লফ্রেন্ড না, বন্ধু ছিল। শুধুই বন্ধু। কিন্তু আমাদের এখন কথা হয় না।’
জুনিয়রের কষ্ট আছে আরও। তিন বছর আগে তাঁর বাবা বিষয়টি বলেছিলেন, প্রযুক্তির প্রতি অবসেসড হয়ে ছেলে যেন নিজের সম্ভাবনা নষ্ট করতে পারে, সে জন্য ততদিন পর্যন্তও হাতে ফোন তুলে দেননি। জুনিয়র বারবার ফোনের কথা বললে রোনালদো স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘ক্রিস, তোমার হাতে সময় আছে।’
কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিনের সাজ–পোশাকে ক্রিস গেইল
জুনিয়র চাইলেই সবকিছু পেয়ে যাবে, তা কখনো হতে দেননি রোনালদো। তাঁর ভাষায়, ‘লেখাপড়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যেটা আমি তাকে দিতে পারি। এই প্রজন্মকে কিছু বলা কিংবা করানোও কঠিন। তারা সব সময় বাবাকেই উদাহরণ হিসেবে পাবে। প্রতিদিনই তারা দেখে আমি কী করি, ঘরে কিংবা বাইরে কতটা অনুশীলন করি, ম্যাচে নিজেকে কতটা নিংড়ে দিই।’
ঘরে যদি রোনালদোর মতো বাবা থাকেন, জর্জিনার মতো মমতাময়ী মা থাকেন, তাহলে সন্তানদের আর কী লাগে! রোনালদোর আদর্শ নিয়েই বেড়ে উঠছে জুনিয়র, বাকি সন্তানেরাও নিশ্চয়ই আরেকটু বড় হয়ে বাবা-মায়ের আদর্শই ধারন করবে।


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরও