• শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ১১:৪৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম
নকশা না মানা ভবনের বিদ্যুৎ-পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করবে রাজউক নতুন রাজনৈতিক দলের আবেদন যাচাই-বাছাইয়ে কমিটি গঠন ইসির ভারতের ১৫ শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পাকিস্তানের ‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’ পারফরম্যান্স সিরিজ ১৪ ৫জি উন্মোচন করতে যাচ্ছে রিয়েলমি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ না করলে আন্দোলন : রাশেদ খাঁন চলতি মাসে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে ২৩টি মিটিং করেছে: হাসনাত পাকিস্তানে ভারতের হামলা, সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ভীতির কোনও কারণ নাই, আমাদের সীমান্ত সম্পূর্ণ নিরাপদ: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিজেদের ‘বিশ্বব্যবস্থার রক্ষক’ হিসেবে উপস্থাপন করলেন পুতিন-শি

গ্যাসের শুল্ক বৃদ্ধি : বিনিয়োগ আকর্ষণে বাধা

প্রভাত রিপোর্ট / ২১ বার
আপডেট : বুধবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৫

প্রভাত অর্থনীতি: বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ১৩ এপ্রিল নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টায় বাধা সৃষ্টি হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) দেশকে একটি উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ মূল্যবৃদ্ধি দেশের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতার সক্ষমতাকেও দুর্বল করতে পারে। যেমন, ভিয়েতনাম ও ভারত এলএনজি আমদানিতে যথাক্রমে কেবল ২ দশমিক ৭৫ ও ২ শতাংশ শুল্ক নেয়, অথচ বাংলাদেশে এ হার ৩৭ শতাংশ। এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যায়, যদিও সরকার ব্যয় কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সমালোচকদের মতে, এলএনজির ওপর শুল্ক এখন শিল্পকে সহায়তা করার বদলে রাজস্ব আদায়ের মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পেট্রোবাংলা শুধু শুল্ক বাবদ দিয়েছে ৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা—যা সরকার দেয়া ভর্তুকির চেয়ে ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেশি।
কেন গ্যাসের দাম এত বেশি?: সরকারি কর্মকর্তারা বিশ্ববাজারের দাম ও ভর্তুকির কথা বললেও পদ্ধতিগত সমস্যার দিকটি প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে গ্যাসের অপচয় বা সিস্টেম লস ছিল ১৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ, যেখানে গ্রহণযোগ্য সীমা মাত্র ২ শতাংশ। শুধু তিতাস গ্যাস কোম্পানিই ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হারিয়েছে ১ হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস, যার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা—এটি এলএনজির ভর্তুকির প্রায় অর্ধেক। যদিও গত বছর আড়াই লাখ অবৈধ সংযোগ ও ৪২০ কিলোমিটার পাইপলাইন অপসারণ করা হয়েছে, তবুও অবৈধ ব্যবহার বন্ধ হয়নি।
বিশ্ববাজার বনাম স্থানীয় দাম: বর্তমানে স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ১৩ দশমিক ১২ ডলার। এ দামে বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানিকৃত এলএনজির ওপর নির্ভর করলে গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে হতো ৫৬ দশমিক ৬ টাকা। এর সঙ্গে অপারেশন খরচ ও শুল্ক যোগ করলে খরচ আরও বাড়ত। তবে সৌভাগ্যবশত, আমদানিকৃত এলএনজি দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের মাত্র ৩০ শতাংশ। বাকি ৭০ শতাংশ আসে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে।
১৬ এপ্রিল দেশে মোট সরবরাহকৃত ২ হাজার ৭১৭ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাসের মধ্যে ৮৩৪ মিলিয়ন ঘনমিটার এসেছে আমদানিকৃত এলএনজি থেকে। বাকি গ্যাস এসেছে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে, যেগুলো পরিচালনা করে শেভরন, টালো ও বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত স্পট রেট ছিল ৩ দশমিক ৯৭ ডলার, যা ধরে দেশীয়ভাবে উৎপাদিত গ্যাসের দাম হওয়া উচিত ২৯ টাকা প্রতি ঘনমিটার। শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য হিসাব করলে এ দাম দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৫ টাকা। এ তুলনায় অনেক সস্তা গ্যাসের উৎস থাকা সত্ত্বেও সরকার ১৩ এপ্রিল থেকে শিল্প ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করেছে। এ সিদ্ধান্ত বিডার জন্যও আচানক ছিল, বিশেষ করে ঢাকায় সংস্থাটির বড় একটি বিনিয়োগ সম্মেলন শেষ হওয়ার কয়েকদিন পরই এ ঘোষণা আসে। বিডা এ সিদ্ধান্তকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়ে দ্রুত মূল্য পর্যালোচনার দাবি জানায়।
এ মূল্যবৃদ্ধি কি অপরিহার্য ছিল?: এ শুল্কবৃদ্ধির নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোর বিপরীত পথে হাঁটতে হচ্ছে। জ্বালানিনির্ভর দেশে সাধারণত বাজারের অস্থিরতা সামাল দিতে সরকারগুলো বিভিন্ন সুরক্ষা ব্যবস্থা নেয়। যেমন, ভারত মার্চ মাসে অভ্যন্তরীণ গ্যাসের দাম নির্ধারণ করেছে ৭ দশমিক ৮০ ডলার, যদিও তারা সে সময় আমদানি করেছিল ১৩ দশমিক ৪০ ডলারে। দেশটি ২০২৩ সাল থেকে একটি পূর্বনির্ধারিত মূল্যের ফর্মুলা অনুসরণ করে।
বাংলাদেশে গ্যাসের দাম পরিবর্তন অনেক সময় হঠাৎ এবং বড় আকারে হয়। যেমন, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শিল্প ও বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের দাম এক লাফে ১৪ টাকা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়—যা ছিল ১১৪ শতাংশ বৃদ্ধি। ২০২২ সালের আগস্টে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম সর্বোচ্চ ৫৪ ডলার প্রতি এমএমবিটিইউতে পৌঁছেছিল। এরপর ২০২৩ সালের মার্চে তা কমে দাঁড়ায় ১৩ ডলারে। ২০২৪ সালের মার্চে দাম আরও কমে ৯ ডলারে নামলেও বছরের শুরুতে আবার তা ১৩ ডলারের ওপরে ওঠে। তবে দাম ওঠানামা করলেও বর্তমানে যে হারে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে, তাতে আরেক দফা বড় ধরনের মূল্যবৃদ্ধির তেমন যুক্তি নেই—বিশেষ করে যখন শিল্প খাত আগে থেকেই গ্যাসের ঘাটতির কারণে ভুগছে।
দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়লেও গ্যাস অনুসন্ধানের গতি কম এবং এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদন ২০১৫ সালের তুলনায় কমে গেছে। বিদ্যুৎ খাতের চাহিদা মেটাতে সরকার মে মাসে স্পট এলএনজি আমদানির পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে। এ জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানী লিমিটেড ছয়টি কার্গোর জন্য দরপত্র ডেকেছে। এগুলোর প্রতিটিতে ৩২ লাখ এমএমবিটিইউ এলএনজি যা রিগ্যাসিফিকেশনের পর প্রায় ৩,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসে রূপান্তর হবে। কিন্তু দেশের বিদ্যমান রিগ্যাসিফিকেশন অবকাঠামো দিনে সর্বোচ্চ ১,১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস প্রক্রিয়াজাত করতে পারে, ফলে সরবরাহে সীমাবদ্ধতা থেকেই যাচ্ছে।
এ পরিস্থিতিতে শিল্প খাতে গ্যাস রেশনিংয়ের পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং রপ্তানিমুখী ইউনিটগুলোকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তবে কাঠামোগত সমস্যাগুলো ঠিক করার বদলে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আবার সহজ পথ বেছে নিচ্ছে—শিল্প খাতের ওপর ব্যয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। অথচ শিল্প খাতই দেশের মোট গ্যাসের ৩৭ শতাংশ ব্যবহার করে, যার ১৯ শতাংশ যায় উৎপাদনে আর ১৮ শতাংশ ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
ন্যায্য দাম কত হওয়া উচিত?: বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, ‘এ দাম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ তার মতে, প্রতি ঘনমিটারে গ্যাসের দাম ২০ টাকার মধ্যে নামিয়ে আনা সম্ভব।
বর্তমান দামের কাঠামো অনুযায়ী পুরোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর নবায়নকৃত চুক্তিও নতুন সংযোগ হিসেবে ধরা হচ্ছে—যাকে বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফরেইন ইনভেস্টরস চেম্বারের সভাপতি জাভেদ আখতারও সতর্ক করে বলেন, এ ধরনের নীতির ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যেতে পারে। বিশেষ করে এখন, যখন সম্প্রতি বিডার এক শীর্ষ সম্মেলনে ৫০টির মতো দেশের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন।
বিইআরসি দাম বাড়ানোর আগে জনশুনানির আয়োজন করলেও ফেব্রুয়ারির সে শুনানিতে শিল্প নেতাদের মতে দাম বৃদ্ধির যথার্থতা দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে বিশ্ববাজারে দাম স্থিতিশীল থাকলেও তাদের মতামত গুরুত্ব পায়নি।
বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে গ্যাস অনুসন্ধান জোরদারের আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এখনো খনন কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। নতুন কূপ খনন শুরু হলেও ফল পেতে কয়েক বছর লাগতে পারে। তাই আপাতত এলএনজিই একমাত্র বিকল্প। এদিকে, গ্যাসের লিকেজ, রিগ্যাসিফিকেশন, সংরক্ষণ ও বিতরণে অদক্ষতা এবং অতিরিক্ত খরচের দায় সরকারেরই নেওয়া উচিত বলে মনে করছেন অনেকে। এলএনজি টার্মিনাল ও পাইপলাইনের সক্ষমতা বাড়াতেও জরুরি বিনিয়োগ প্রয়োজন।
গ্যাসের দাম যেন প্রতিযোগিতামূলক ও বিনিয়োগবান্ধব হয়, সে জন্য শিল্প নেতারা কর ও শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন—সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান বাড়ানো, যা বহুদিন ধরে অবহেলিত থেকেছে। এ অন্তর্বর্তী সময়ে সরকারকে এমন একটি পথ বের করতে হবে, যা একদিকে বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে, অন্যদিকে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিও নিশ্চিত করবে।


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরও