আজ
|| ২৫শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ১২ই বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ২৬শে শাওয়াল, ১৪৪৬ হিজরি
বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য আরও বাড়তে পারে: বিশ্বব্যাংক
প্রকাশের তারিখঃ ২৪ এপ্রিল, ২০২৫
প্রভাত রিপোর্ট: দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের সংকট এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ধীরগতির প্রভাবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও বৈষম্য আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্বব্যাংক। বুধবার (২৩ এপ্রিল) প্রকাশিত সংস্থাটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘চলতি ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৫ সালে দেশের জাতীয় দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা ২০২২ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।’বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ‘অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার— অর্থাৎ যাদের দৈনিক আয় দুই ডলার ১৫ সেন্টের নিচে, তা দ্বিগুণ হয়ে ৯ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছাতে পারে। এতে অতিরিক্ত ৩০ লাখ মানুষ অতিদারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।’বিশ্বব্যাংক বলছে, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের কারণে নিম্নআয়ের পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক খাতে।’ তবে আশার আলো হিসেবে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, ‘২০২৬ সাল থেকে দেশের দারিদ্র্যের হার আবারও হ্রাস পেতে শুরু করতে পারে— যদি অর্থনীতির গতি পুনরুদ্ধার হয় এবং স্থিতিশীল নীতিমালা গ্রহণ করা হয়।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, দারিদ্র্য রোধে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। অন্যথায়, দেশের অর্জিত উন্নয়ন অগ্রগতি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘খাদ্য মূল্যস্ফীতির দীর্ঘস্থায়ী চাপ এবং প্রকৃত মজুরি না বাড়ায় দারিদ্র্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।’
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৪ সালের দ্বিতীয়ার্ধে দেশের প্রায় ৪ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি কমেছে ২ শতাংশ এবং উচ্চদক্ষদের মজুরি হ্রাস পেয়েছে ০.৫ শতাংশ। এমনকি টানা ৪০ মাস ধরে প্রকৃত মজুরি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ফলে প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে তিনটি তাদের সঞ্চয় ভেঙে দৈনন্দিন খরচ চালাতে বাধ্য হচ্ছে।’
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়াতে পারে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরের ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেকটাই কম। প্রবৃদ্ধি হ্রাসের কারণ হিসেবে বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ সুদহার, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নীতিগত দুর্বলতাকে দায়ী করা হয়েছে।’
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় ২৪.১ শতাংশ এবং মূলধনী পণ্যের আমদানি ১২ শতাংশ কমেছে। এছাড়া ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি মাত্র ৭ দশমিক ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে— গত তিন দশকে যা সর্বনিম্ন।’
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ‘চলতি অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশে পৌঁছাতে পারে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় বেশি। খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য, আমদানি ব্যয় এবং সরবরাহ ঘাটতির কারণে এই চাপ অব্যাহত থাকবে। তবে কঠোর মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ফলে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতির গতি কমতে পারে।’
‘এদিকে দেশের শ্রমবাজার এখনও অনানুষ্ঠানিক ও স্বল্প উৎপাদনশীল খাত নির্ভর। বিপুল সংখ্যক মানুষ স্বনিযুক্ত ও অনিরাপদ পেশায় নিযুক্ত থাকায় আয় বৈষম্য বাড়ছে।’
‘অর্থনীতিতে সামগ্রিক চাপ থাকলেও রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক খাতে রফতানি কিছুটা স্থিতি এনে দিয়েছে। চলতি হিসাবে ঘাটতি ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারে স্থিতিশীল রয়েছে।’
বিশ্বব্যাংক মনে করে, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনরারোপিত পাল্টা শুল্কনীতির ফলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি ১.৭ শতাংশ এবং জিডিপি প্রবৃদ্ধি ০.৫ শতাংশ পয়েন্ট কমতে পারে। তবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে না বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।’
বিশ্বব্যাংকের মতে, ‘বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত এখনও অস্বাভাবিকভাবে কম— মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। এই হারে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন।’ তারা মনে করে, ‘রাজস্ব আহরণ বাড়ানো না গেলে মানব উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘চলতি অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণের পরিমাণ ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশে উন্নীত হবে— যা আগের বছরের তুলনায় ১ শতাংশ পয়েন্ট বেশি। একইসঙ্গে বিদেশি ঋণের অনুপাতও বেড়ে ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশে পৌঁছাবে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন করা গেলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হতে পারে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংক ও রাজস্ব খাত সংস্কারে বিলম্ব এবং নীতির অস্থিরতা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।’ সংস্থাটির সর্বশেষ ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে অর্থনীতি চাপে পড়তে পারে।’ সংস্থাটি বলেছে, ‘অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারে উদ্যোগ নিলেও পুলিশের কার্যকারিতা, নীতির ধারাবাহিকতা এবং নির্বাচনের সময় নিয়ে রাজনৈতিক মতানৈক্য অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।’
বিশ্বব্যাংক তাদের সুপারিশে আর্থিক শৃঙ্খলা, রাজস্ব আহরণে দক্ষতা বৃদ্ধি, ব্যাংকিং খাতে সংস্কার এবং ব্যবসা সহজ করার ওপর জোর দিয়েছে।
বিশ্বব্যাংক মনে করে, ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সাহসী সংস্কার দরকার। এর মধ্যে রয়েছে—অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, আর্থিক খাত পুনর্গঠন, রাজস্ব আদায়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য সহজ করা।’
বিশ্বব্যাংক আশাবাদ ব্যক্ত করেছে, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার বাস্তবায়ন হলে মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এবং প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি— উভয়ই নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে বৈশ্বিক বাণিজ্য অনিশ্চয়তা রফতানিনির্ভর অর্থনীতিকে চাপে রাখবে’, বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
Copyright © 2025 প্রভাত. All rights reserved.