আজ
|| ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ৫ই মহর্রম, ১৪৪৭ হিজরি
ফারুক শাহ : : : :---
নিশাত ইসলাম। একাধারে যিনি শিক্ষক, নাট্যকার, সাহিত্যিক ও কলামিস্ট। কবিতা, গল্প, ভ্রমণকাহিনি ও উপন্যাস নিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৫। তার লেখার ভেতর উপন্যাসের সংখ্যা বেশি। লেখক নিশাত ইসলামের সাথে আমার পরিচয় লেখালেখি সূত্রে। যার সুবাদে তার প্রকাশিত গ্রন্থগুলো পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। সে-হিসেবে আমি তাকে একজন সাহিত্যিক হিসেবে জানি। কিন্তু এবার সাহিত্যিক নিশাত ইসলাম বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি নক্ষত্র শিরোনামে গ্রন্থ প্রকাশ করছেন। যার গ্রন্থ আলোচনা আমাকে লিখতে হবে। সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়টি আমার কাছে খুব কঠিন। যদিও লেখক নিশাত ইসলামের অনুরোধে আমার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি নক্ষত্র এক মলাটে ভাবা যায়? কিন্তু লেখক নিশাত তার নিপুণ লেখনীতে এটি সম্ভবপর করেছেন। মানুষের জীবনে যা কিছু ক্ষণিকের, তাকে চিরদিনের করে ধরে রাখার যে কৌশল বা প্রক্রিয়া সেটাই হচ্ছে আর্ট বা শিল্প। অর্থাৎ ছন্দ, ধ্বনি, রূপ-এর বাক্সময় প্রকাশই শিল্প। এই ক্ষণস্থায়ী প্রাকৃতিক নিয়মে প্রকৃতি ও বস্তুজগতে প্রতিনিয়ত যে পরিবর্তন হচ্ছে ও নতুন নতুন রূপ নিচ্ছে, তেমনি করে তার সৃষ্টিশক্তি, আবেগ, ধ্বনি ও ছন্দের সংমিশ্রণে কাব্যের সৃষ্টি করছে এবং তাকে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন এসব সাহিত্যিক।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঊনবিংশ শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ ও গদ্যকার। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৯ সালে তাকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি দেওয়া হয়। সংস্কৃত ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিশেষ অবদান ছিল। বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক রূপকার তিনিই। সমাজসংস্কারক এবং বিধবাবিবাহ ও স্ত্রীশিক্ষার প্রচলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অভিশাপ দূরীকরণে তার অক্লান্ত সংগ্রাম আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। বাংলার নবজাগরণের এই পুরোধা ব্যক্তিত্ব দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দয়ার সাগর’ নামে। দরিদ্র, আর্ত ও পীড়িত কখনও তার দ্বার থেকে শূন্য হাতে ফিরত না। এমনকি নিজের চরম অর্থ সংকটের সময়ও তিনি ঋণ নিয়ে পরোপকার করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের ‘প্রথম শিল্পী’ বলে অভিহিত করেছেন।
আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল একজন বৈজ্ঞানিক মানুষের মতো। সৌন্দর্যকে তিনি মনে করতেন নিখুঁত সংগতি, যার অবস্থান বিশ্বজনীন সত্তা। আর সত্যকে মনে করতেন বিশ্বজনীন মনের নিখুঁত উপলব্ধি। তার কাজের ক্ষেত্র এত বিচিত্র, সৃষ্টিশীলতা এত বিশাল এবং ভাবনা এত পরিশীলিত যে, সাধারণ মানুয়ের পক্ষে তাকে ঠিকমতো জানা ও এর কাছাকাছি পৌঁছানো সহজতর নয়। অথচ বাংলাভাষী প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনে রবীন্দ্রনাথ কোনো-না-কোনোভাবে তার চিহ্ন এঁকে গেছেন আপন মনে আপন মহিমায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের অনন্যধারক। যার কারণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস লাভ করে নতুন প্রাণ। সাহিত্যের সকল শাখায়ই রবীন্দ্র সাহিত্যের ভাণ্ডার বিশাল বিস্তৃত। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের শক্ত পদার্পণ নেই। সর্বজনস্বীকৃত সাহিত্যের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা তারই কথা বলে। শুধু বাঙালি জাতির নয়, বাংলা সাহিত্যের মর্যাদাকে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্ব সাহিত্যের ভাণ্ডারে। এশিয়ার মধ্যে তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বসভায় বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যকে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
উনিশ শতকের বাংলাদেশের মরমি দার্শনিক কবিদের মধ্যে লালন শাহ সুবিখ্যাত। আল্লাহর পথে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন বলে তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘লালন ফকির’, ‘ফকির লালন’, ‘দরবেশ লালন’, ‘অবোধ লালন’ বা ‘লালন শাহ’ নামে। নিজে নিজেকে যে নামেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন তাতে কী? তিনি হিন্দু-শিষ্যদের কাছে ‘সাঁই’ বা ‘গোঁসাই’ এবং মুসলমান-শিষ্যদের কাছে ‘ফকির’ নামেই বেশি পরিচিত। তবে বাংলা সাহিত্যে তার নাম ‘লালন ফকির’ বাউল সাহিত্যে তিনি ‘সর্বশ্রেষ্ঠ বাউল’।
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত এদেশে যেসব দর্শন আছে। তার মধ্যে লালন শাহ-র দর্শন এদেশেরই দার্শনিক ঐতিহ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তার মধ্যে জ্ঞানতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, বিবর্তনবাদ নূর-নবীতত্ত্ব¡, প্রজ্ঞাতত্ত্ব, পরম সত্তাতত্ত্ব, সূক্ষ্ম ধর্ম। লালন সাহিত্যের গবেষকগণ তার গানে প্রকাশিত জ্ঞানতত্ত্বের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে গবেষণা করেননি, তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্য রচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশিছে।’ লালন শাহ পুথি পড়া পণ্ডিত ব্যক্তিদের এবং পরের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের কৃপার চোখে দেখেছেন। কারণ তারা জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের কারও ভাবনাচিন্তা ও যুক্তিবুদ্ধির প্রতি অনুগত প্রকাশ করেন।
বাংলার সোনার পরশ বুলিয়ে গ্রাম-বাংলার দুঃখ, দারিদ্র্য, স্বপ্ন, আশা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রচনায় পরিস্ফুটন হয়েছে নানাভাবে। শুধুমাত্র পল্লিপ্রকৃতি নয়, মানুষের স্বভাবপ্রকৃতিও তার রচনায় ধরা পড়েছে সজীব রূপে। বাংলার এমন কোনো সৌন্দর্য নেই যা তার রচনায় স্থান পায়নি। তার রচনাবলি পড়লে মনের পর্দায় আসল রূপ ধরা পড়ে খুব সহজে। তাই তো এত বছর পরেও তার রচিত গ্রন্থ আজও মানুষের কাছে অধিক প্রিয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মানবমনে বেঁচে আছেন তার কর্মগুণে। সাহিত্যভুবনে বেঁচে আছেন তার সাহিত্য অবদানে।
আধুনিক বাংলা কাব্য ও বাংলা সাহিত্যের দরজা উন্মুক্ত করতে একের পর এক স্বর্ণসন্তান জন্ম নিল বাংলার ঘরে। কায়কোবাদ একজন বাঙালি কবি ও মহাকবি। মীর মশাররফ, মোজাম্মেল হকের মধ্যে কায়কোবাদই হচ্ছেন সর্বতোভাবে একজন কবি। কাব্যের আদর্শ ও প্রেরণা তার মধ্যে লীলাময় হয়ে ওঠে। সেজন্য এ-কথা বেশ জোরের সঙ্গে বলা যায়, কবি কায়কোবাদই হচ্ছেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মুসলিম কবি। কায়কোবাদ ছিলেন বাঙালি মুসলিম কবিদের মধ্যে প্রথম সনেট রচয়িতা।
সিকান্দার আবু জাফর একজন শব্দসচেতন, সমাজসচেতন সংগ্রামী মানুষ। কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে বা ছকে বাঁধা পড়ে থাকেননি। বক্তব্যে স্পষ্টভাষী আর মেজাজে বলিষ্ঠ পক্ষপাতী ছিলেন। কাব্যের মূল সুর খুঁজেছেন সমাজ-সংঘাতের দুঃখবেদনার মধ্যে। তিনি সময়ের বিকার ও অন্যায়কে পরিহাস তিক্ততার মধ্যে প্রকাশ করেছেন কবিতায়। সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষের সপক্ষে সোচ্চার ছিল তার কলম। দুর্ভিক্ষ, গণতন্ত্রহীনতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন তিনি। নাগরিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য সবসময় ছিলেন সম্মুখসারির যোদ্ধা।
এক ধর্মপ্রাণ দরবেশ এসে বদলে দিলেন সব কিছু। তিনি বললেন, এ মেয়ের নাম হবে ‘বেগম সুফিয়া’। এই নাম এ শিশুর জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। দরবেশের কথা কি ফেলা যায়? শিশুটির নাম হাসনাবানু বদলে রাখা হলো বেগম সুফিয়া। প্রথম বিয়ের পর বেগম সুফিয়া বদলে হন সুফিয়া এন হোসেন। সর্বশেষ হন সুফিয়া কামাল। সারাবিশ্ব তাকে চেনে সুফিয়া কামাল নামে। সুফিয়ার ভেতর সৃষ্ট প্রতিভা জাগরিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থ পড়ে। তিনি কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও তার সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল গদ্য লিখে।
বাংলাদেশের মরমি দার্শনিক কবিদের মধ্যে লালন শাহ সুবিখ্যাত। গবেষণার মাধ্যমে লালনের প্রতিটি গান বা মর্মবাণীর যে ভাবার্থ বের করা হচ্ছে, তাতে লালন শাহ সম্পর্কে তার গুণাগ্রাহীদের আনুগত্য আরও বেড়ে যাচ্ছে। বর্তমানে লালনসংগীত বাংলার দ্বার ভেদ করে বিশ্ব দরবারে তার নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে। বাংলার ভাবসংগীতকে নতুন করে পরিচয় করে দিয়েছে বিশ্বের কাছে আপন মহিমায়। আল্লাহ্র পথে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন বলে তিনি তার গানে ‘লালন ফকির’ বা ‘আরোধ লালন’ নামে নিজের পরিচয় দেন। পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘লালন ফকির’ নামেই পরিচিত হন। বাউল সাহিত্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বাউল। সাধক ফকির লালন শাহ-র চিন্তা-চেতনায়, ভাবে-ভাবনায় ও বিশ্বাসে গুরুবাদী দর্শনে মূলত মানুষকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। মানুষকে তার গানে দ্বিধাহীনভাবে আনন্দচিত্তে চরম ভালোবাসা আর বিশ্বাসের জায়গা থেকে জয়গান গেয়েছেন; মানুষকে পরমাত্মার অংশ হিসেবে মানবিক আধ্যাত্মিক এবং দার্শনিকভাবে তুলে ধরেছেন।
১৯১৩ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রথম বাঙালি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ের পর আরেক বাঙালি নোবেল পুরস্কার পেলেন। তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথের অতি প্রিয় অমর্ত্য সেন। ১৯১৩ থেকে ১৯৯৭ সাল ৮৪ বছরের সুদীর্ঘ ব্যবধানে বাঙালির এই দুই বীর সন্তানের অবদান বিরাট অর্জন। জন্মস্থান শান্তিনিকেতন, পশ্চিম বাংলা। মতান্তরে সোনারং গ্রাম, বিক্রমপুর, মুন্সিগঞ্জ, বাংলাদেশ। অমর্ত্য সেনের মাতা অমিতা সেনেরও জন্ম সোনারং, বিক্রমপুর, বাংলাদেশ, আর পিতা ড. আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ, বাংলাদেশ। সে-কারণে মহান এই অমর্ত্য সেনের নাগিরকত্ব ভারতীয় হলেও জাতীয়তা বাঙালি আর ধর্ম সনাতন।
অমর্ত্য সেন ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষকে নিয়েই শুরু করেছিলেন তার সাড়া জাগানো গবেষণাকর্ম। সেই দুর্ভিক্ষের ছবি এখনও মূর্ত হয় অমর্ত্য সেনের গবেষণার বিষয়বস্তু সম্পর্কে রিপোর্ট প্রচারের সময়। সেখানে তিনি নিশ্চিত করেন, ১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবে হয়নি। খাদ্যের সুষ্ঠু পরিবহণের অভাবে ঘটেছে।
কাজী নজরুল ইসলামের ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। মাত্র ৯ বছর বয়সে তার পিতা জান্নাতগামী হলে পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাকে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয়। তিনি তার মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করে সেই মক্তবে শিক্ষকতা কাজে নিয়োজিত হন। একই সাথে তিনি কবরের সেবক এবং মসজিদের আজানদাতা হিসেবে কাজ করেন। এসব কাজের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয় তার। যা কি না পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাহিনীর ইরাক যাওয়ার কথা ছিল; কিন্তু যুদ্ধ থেমে যায়। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে তিনি সৈনিক-জীবন ত্যাগ করে করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসেন। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিস থেকে কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়।
উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের নাম মীর মশাররফ হোসেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন পিতার জমিদারি দেখাশোনা দিয়ে। বঙ্কিম যুগের অন্যতম প্রধান গদ্যশিল্পী ও উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। কৈশোর-যৌবনের সন্ধিতে এসে মীর মশাররফ হোসেন শ্বাস ফেললেন গদ্য-গগনে।
মধ্যযুগ আর আধুনিক যুগের যুগসন্ধিক্ষণের কবি হচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাল্যে বা যৌবনে ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত কোনোটা রীতিসম্মত উপায়ে শেখেননি। অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে লালিত-পালিত হয়েও শুধু তীক্ষè প্রতিভার গুণে এবং স্বভাবসিদ্ধ প্রসন্ন পরিহাসের কল্যাণে কলকাতার অভিজাত সমাজে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘যুগসন্ধির কবি’ হিসেবে পরিচিত। কারণ সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তার ভাষা, ছন্দ ও অলংকার ছিল মধ্যযুগীয়।
প্যারীচাঁদ মিত্র টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে কয়েকটি গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন এবং সেই নামে পরিচিত হন। সে-কালের শিক্ষিত বাঙালি সমাজে প্যারীচাঁদ মিত্র গণ্য এবং মান্য-সম্মনীয় ছিলেন। সাহিত্যক্ষেত্রে প্যারীচাঁদ মিত্র সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব আলালের ঘরের দুলাল, যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে খ্যাত। রচনারীতি ও ভাষাগত দিক থেকে এ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে নবধারার সূচনা করে। এ উপন্যাসে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত গদ্যরীতির নিয়ম ভেঙে চলিত ভাষারীতি প্রয়োগ করেন। নতুন নতুন চিন্তা ও ভাব-ভাবনা, স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ও সমাজ সংস্কার ক্ষেত্রে তার অবদান স্মরণযোগ্য। কৃষিবিদ্যা ও কৃষিচর্চা, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রেও দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়।
গিরিশচন্দ্র সেন, যিনি অন্য ধর্মের ওপর গবেষণা করে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলা ভাষাভাষীর কাছে প্রথম বাংলা ভাষায় পূর্ণাঙ্গ কোরআন প্রকাশের কৃতিত্ব তার। যদিও বাংলা ভাষায় কোরআন শরিফ প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক মৌলভী নাঈমুদ্দীন। তবে গিরিশচন্দ্র সেন ভাষা সহজতর করাতে বেশি গ্রহযোগ্যতা হয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু এবং ইসলামি বিষয়াবলি সমন্ধেও বিশেষ জ্ঞানী ছিলেন।
লেখক গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন মমতাজউদদীন আহমদকে। যিনি একজন প্রখ্যাত নাট্যকার, অভিনেতা ও ভাষাসৈনিক। তিনি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ যিনি এক অঙ্কের নাটক লেখায় বিশেষ পারদর্শী। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম, নানা দাবিতে সক্রিয় থাকায় ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে কারাভোগও করতে হয়েছিল তাকে।
হাছন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারি চালাতে লাগলেও এক আধ্যাত্মিক স্বপ্ন-দর্শনে হাছন রাজার জীবন-দর্শন আমূল পরিবর্তন হয়। তার মনের দুয়ার খুলে যেতেই চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা, বৈরাগ্য। তার ছিল না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। স্বশিক্ষিত সহজ-সরল সুরে আঞ্চলিক ভাষায় প্রায় সহস্রাধিক গান রচনা করেন। মরমি গানের ছকবাঁধা বিষয়-ধারাকে অনুসরণ করেই হাছনের গান রচিত হয়।
একজন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং প্রথম বাঙালি নারীবাদী কণ্ঠ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বেগম রোকেয়া নামে অধিক পরিচিত। তার শিক্ষাজীবন তেমন সুখকর ছিল না। তার পিতা আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হলেও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি ছিলেন রক্ষণশীল। সমাজ ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্য তাও বন্ধ হলে বেগম রোকেয়া দমে যাননি। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও শ্লেষাত্মক রচনায় তার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
অনুরূপা দেবী ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন প্রভাবশালী জনপ্রিয় বাঙালি নারী ঔপন্যাসিক। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন সে-সময়কার এক বিশিষ্ট ছোট গল্পকার, কবি, একই সঙ্গে সমাজ সংস্কারকও। তার প্রথম প্রকাশিত গল্পের জন্য তিনি ‘কুন্তলীন’ পুরস্কার লাভ করেন।
বাংলা সাহিত্যে শতায়ু লাভ করেছেন যে দু-একজন সাহিত্যিক, তাদের মধ্যে লীলা মজুমদার একজন। তিনি ভারতীয় বাঙালি মহিলা লেখক। ‘বিশ্বভারতী’তে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে আশুতোষ কলেজে যোগ দেন। বেশিদিন শিক্ষকতায় না থেকে স্বাধীনভাবে সাহিত্যচর্চা করেন। তার সাহিত্য-জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে নিয়েছেন চিরায়ত বাংলাকে, ফলত বাংলা শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক যারা, তাদের পাশাপাশি লীলা মজুমদারের নাম উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধার সঙ্গে। লীলা মজুমদার বহু সংখ্যক বাংলা গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস রচনা করে বহু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হন।
বাঙালির সাহিত্যকর্ম সকল যুগে, সকল কালে, সকল স্থানে নতুনই থেকে যাবে। লেখক তার লেখা বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি নক্ষত্র গ্রন্থে বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সম্মিলন ঘটিয়েছেন দারুণভাবে। প্রতিটি লেখার সময়কালও দিয়েছেন। এটি থেকে বোঝা যায়, গ্রন্থটি তিনি হঠাৎ করে প্রকাশের চিন্তা করেননি। বুঝেশুনে সময়কাল বিবেচনা করে তিনি গ্রন্থ আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ১৪৪ পৃষ্ঠার বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি নক্ষত্র গ্রন্থটি অন্যন্যা প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে। গ্রন্থটির প্রচ্ছন এঁকেছেন ধ্রুব এষ। মূল্য ৩০০ টাকা। সবশেষে বলছি, গ্রন্থটি সংগ্রহে রাখার মতো। আমি লেখক এবং তার গ্রন্থের সাফল্য কামনা করছি।