• বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম

প্রভাত রিপোর্ট / ২৬ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ২৭ মে, ২০২৫

প্রভাত অর্থনীতি: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র বা এলসি খোলা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ কমেছে। একই সময়ে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। মূলধনি যন্ত্রপাতির ঋণপত্র খোলা ও নিষ্পত্তি হ্রাস পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, নতুন বিনিয়োগ বা সম্প্রসারণ কমেছে।
ব্যাংকঋণের সুদহার দীর্ঘদিন ধরে ১৫ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। অতিরিক্ত সুদের হারের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণ নেওয়া কমেছে। গত জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ, যা স্বাভাবিক সময়ে ১০ শতাংশের বেশি থাকে।
জুলাই-মার্চ সময়ে মধ্যবর্তী পণ্য (যা সাধারণত কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়) আমদানি কমেছে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ। যদিও শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ১০ শতাংশ।
গ্যাসের সংকটে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের শিল্পকারখানা ভুগছে। সংকট আরও আছে ব্যাংকঋণের সুদের হার চড়া, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ আছে, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় পণ্যের চাহিদায়ও গতি কম। এসবের সঙ্গে দুর্নীতি, কর-জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বন্দরে দীর্ঘ সময় লাগা ইত্যাদি সমস্যা তো আছেই। সব মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো নয়। ব্যবসা ভালো না থাকলে, বিনিয়োগ বেশি না হলে বাড়তি কর্মসংস্থান তৈরি হয় না। বেকারত্ব বাড়ে। আবার কাজপ্রত্যাশীদের যেনতেন আয়ের উপায় নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে আগামী ২ জুন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করবেন। সংসদ না থাকায় এবার টেলিভিশনে বাজেট বক্তব্য দেওয়া হবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে বিনিয়োগকে দেখা হয় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির অনুপাতে। দেশে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের হার ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ, যা এর আগের অর্থবছর ছিল ২৪ দশমিক ১৮। অর্থাৎ গত অর্থবছর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমেছে। জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে অপেক্ষা করতে হবে চলতি অর্থবছর শেষ হওয়া পর্যন্ত। তবে বিনিয়োগের পরিস্থিতিতে শিল্পের যন্ত্রপাতি কতটা আমদানি হচ্ছে, কাঁচামাল কতটা আসছে, ঋণ বিতরণ কতটা বেড়েছে—এসব সূচক দিয়ে বোঝা যায়।
বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘদিন ধরেই এফডিআইয়ে গতি নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ (জুলাই-মার্চ) মাসে ৮৬ কোটি ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১৬ কোটি ডলার। তার মানে এ সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৬ শতাংশ। একাধিক উদ্যোক্তা নাম প্রকাশ না করার শর্ত বলেছেন, দেশি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা যদি মসৃণ হয় তাহলে বিদেশি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে উৎসাহী হন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনোটাই হচ্ছে না।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে শিল্পকারখানা ব্যাপকভাবে ভুগছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। ব্যাংকগুলো ব্যাপকভাবে অসহযোগিতা করছে। ঋণ দিতে চায় না। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত ও ব্যাংকের সুদের হার কমানোর পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরানো না গেলে ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি হওয়া কঠিন।
বিদ্যমান ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) সভাপতি মো. আলমগীর কবির। তিনি বলেন, মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দেওয়ায় নির্মাণ খাতের ব্যবসা কমে গেছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা আছে। তা না কাটলে ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হবে না। নতুন বিনিয়োগও হবে না।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জের পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স বা পিএমআই সূচকেও দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি কমে যাওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। অর্থনীতির প্রধান চারটি খাত উৎপাদন, কৃষি, নির্মাণ ও সেবা নিয়ে এই সূচক প্রণয়ন করা হয়। পিএমআই সূচক অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে প্রতি মাসেই অর্থনীতির সম্প্রসারণের গতি কমছে। গত এপ্রিলে পিএমআই সূচকের মান কমেছে ৮ দশমিক ৮ পয়েন্ট।
গাজীপুরের টঙ্গীর মাজুখানে এক্সক্লুসিভ ক্যান নামের একটি কারখানায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের রঙের ছোট-বড় ক্যান, আইসক্রিমের বাক্স, ওষুধের বোতল ইত্যাদি তৈরি হয়। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ নাসির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। তবু আমরা ঋণ পাচ্ছি না। ব্যাংকে তারল্যসংকট প্রকট। গত মাসে আমার কারখানায় ১৩০ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, সরকারি দপ্তরে আগের মতোই দুর্নীতি হচ্ছে। কোনো উন্নতির লক্ষণ নেই।
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি ও চলমান প্রক্রিয়া। এটি কখনোই রাতারাতি ঘটে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অথবা নির্বাচিত সরকার আজ কোনো নীতিগত বা প্রশাসনিক উদ্যোগ নিলেই কাল বিনিয়োগ বেড়ে যাবে, ব্যাপারটা এমন নয়। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় দরকার, যাতে বিনিয়োগকারীরা পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে, তা সমাধানের জন্য আমরা এখন নানাবিধ সংস্কার করছি।’
দেশের বস্ত্র খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গত দুই বছরে কারখানা সম্প্রসারণে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে। যদিও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ায় বস্ত্রকলগুলো বাড়তি উৎপাদন সক্ষমতা অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এমন দাবি করে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, গ্যাস–সংকটের কারণে অধিকাংশ বস্ত্রকল উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছে না। তাতে প্রতিনিয়ত লোকসান বাড়ছে। তিনি বলেন, নতুন নিয়োগ নেই বললেই চলে; বরং কোনো কোনো কারখানায় ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
এদিকে জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাঁরা সংকটে রয়েছেন।
ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে গতি কম থাকায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে কম। তাতে বেকার পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হচ্ছে। ২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে দেড় লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সাল শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। তার আগের বছর (২০২৩ সাল) এই সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৫ লাখ। তার মানে গত বছর বেকারের হার ছিল ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ায় সামষ্টিক অর্থনীতি, বিশেষ করে লেনদেন ভারসাম্যে উন্নতি হয়েছে। তবে অর্থনীতিতে নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ এসেছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না; নতুন কর্মসংস্থানও নেই। তার বড় কারণ হচ্ছে, গত ৯ মাসে বিনিয়োগ পরিবেশ ও বাণিজ্য সক্ষমতার তেমন কোনো সংস্কার হয়নি।’
মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, বিনিয়োগের মূল বাধা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এমন প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি নিয়ে কেউ আসবে না। বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান কমলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫-৬ শতাংশে নেওয়া কঠিন হবে।


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরও