আজ
|| ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ৫ই মহর্রম, ১৪৪৭ হিজরি
বাতিল হচ্ছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ
প্রকাশের তারিখঃ ১৯ জুন, ২০২৫
প্রভাত রিপোর্ট: ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাদ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। আগামী ২২ জুন নতুন করে বাজেটের সংশোধিত অধ্যাদেশে এ ঘোষণা থাকতে পারে। এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বরার পর বিষয়টি জানা গেছে। তবে এনিয়ে সরকারের ‘সর্বোচ্চ মহলের সিদ্ধান্ত’ উল্লেখ করে নাম প্রকাশ করতে চাননি কেউ। তারা বলছেন, ঢালাওভাবে এবার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আসেনি। নানান জটিলতায় আবাসন খাতে অনেক সময় বৈধ অর্থ অপ্রদর্শিত থাকে। এই বিষয়ে ভিন্ন মত থাকলেও এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারে সরকার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাজেট ঘোষণার পর উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। পরে তা বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া অপরিদর্শিত অর্থে আবাসন খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেভাবে কর বাড়ানো হয়েছে তা দিয়ে কেউ এলেও সুবিধা নিতে পারবে না।
এ বিষয়ে এনবিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় পদ্ধতিগত জটিলতায় কালো টাকা সৃষ্টি হয়। এজন্য এবার জরিমানা বাড়িয়ে তা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। গত ২ জুন নতুন অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকার বাজেট উত্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। সেখানে অপ্রদর্শিত অর্থ আবাসন খাতে বিনিয়োগ করে বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়। তবে এর জন্য আগের তুলনায় পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেশি কর দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়।
বাজেট ঘোষণার পরের দিন সংবাদ সম্মেলনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিলের বিষয়ে ইঙ্গিত দেন অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আমরা বাতিলের চিন্তা-ভাবনা করছি।’ ওই সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যানও একই রকমের আভাস দেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেদিন অর্থ উপদেষ্টা বলেন, অনেকের একটা প্রশ্ন যে কালো টাকা সাদা করতে দেওয়া হলো কেন? কালো টাকা কিন্তু ঠিক কালো টাকা না। আমরা যেটা বলেছি যে অপ্রদর্শিত টাকা। কোনো কারণে যদি আপনার কাছে থাকে, শুধু ফ্ল্যাটের ব্যাপারে একটা বিধান দেওয়া হয়েছে। দুটো দিক আছে। একটা নৈতিক দিক হলো কালো টাকা সাদা করা। আরেকটা হলো প্র্যাক্টিক্যাল দিক- টাকা-পয়সা, আমরা ট্যাক্স পাব কিনা। দুই দিকেই কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে অবশ্যই কিছুৃ সেটা আমরা বিবেচনা করবো। ওই সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেন, ২০২৪ সালে আগস্টের পর থেকে কালো টাকা বৈধ করার বিশেষ সুযোগ পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। এবারও তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কেউ যদি অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে কোনো ফ্ল্যাট বা জমি কেনেন, তাহলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কিছুটা বাড়তি হারে কর দিয়ে সেটি বৈধ করতে পারবেন। একইসঙ্গে যদি কেউ নিজের নামে থাকা জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থে বাড়ি নির্মাণ করেন, তাহলে তাকে দ্বিগুণ হারে কর দিতে হবে। এই অতিরিক্ত কর পরিশোধ করলেই তার বিনিয়োগ আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।
তিনি বলেন, এটা মূলত কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নয়। বরং নির্দিষ্ট খাতে অতিরিক্ত কর দিয়ে যেকোনো অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের একটা পথ রাখা হয়েছে।
বর্তমানে ঢাকার গুলশান মডেল টাউন, বনানী, বারিধারা, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা ও দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত ২০০ বর্গমিটারের আয়তনের ভবন বা অ্যাপার্টমেন্টে প্রতি বর্গমিটারে ছয় হাজার টাকা বিনিয়োগে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে।
বাজেটে বলা হয়েছিল, আগামী অর্থবছর থেকে প্রতি বর্গফুটে দুই হাজার টাকা করে অর্থাৎ বর্গমিটারে (১০ দশমিক ৭৬৩৯ বর্গফুট) ২১ হাজার ৫৩০ টাকা খরচ করলে এই সুবিধা পাওয়া যাবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৫ শতাংশ করপরিশোধ করলে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ, নগদ টাকা ও শেয়ারসহ যেকোনো বিনিয়োগ ঢালাওভাবে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি জমি, ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট কিনে থাকলেও এলাকা অনুযায়ী বেঁধে দেয়া কর দিয়ে প্রশ্ন ছাড়াই সেগুলো বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছিল।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত সেপ্টেম্বরে সরকার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করে। তবে তখন আবাসন খাতে বিনিয়োগের এ সুযোগ রেখে দেওয়া হয়েছিল।
বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, এই সুযোগ নৈতিক করদাতাদের প্রতি অবিচার, যা বৈধ আয় করা মানুষদের প্লট বা ফ্ল্যাট কেনা কঠিন করে দেবে। এছাড়া এতে রাজস্ব আদায়ের খুব বেশি সম্ভাবনাও নেই। অপ্রদর্শিত আয় দিয়ে ভবন বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সুযোগ সমাজে আরও বৈষম্য তৈরি করবে। কালো টাকা সাদা করার নীতি নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়, আমরা এটি সমর্থন করি না।
আর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, সরকার দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের অঙ্গীকার উপেক্ষা করে রিয়েল এস্টেট লবির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সংবিধানের ২০(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অনুপার্জিত আয় রাষ্ট্র দ্বারা বৈধ হতে পারে না। অথচ এই সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অবিচার সৃষ্টি করছে এবং ভবিষ্যৎ দুর্নীতিকে উৎসাহ দিচ্ছে। স্বাধীনতার পর অনেকবারই কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১-৭৫ সাল পর্যন্ত দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা সাদা করা হয়। সেখান থেকে তৎকালীন সময়ে সরকার মাত্র ১৯ লাখ টাকা আয়কর পায়। এ পর্যন্ত ২০ বারের বেশি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তখন রেকর্ড পরিমাণ ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছিল।
Copyright © 2025 প্রভাত. All rights reserved.