প্রভাত রিপোর্ট: গুম হওয়া পারভেজের কিশোরী মেয়ে বাবাকে দেখে না অনেক বছর। তার ছোট্ট ভাইটিও বাবাকে দেখতে পায়নি। এখন তার একটাই প্রশ্ন ‘আমি আর আমার ভাই বাবাকে কি কোনোদিন জড়িয়ে ধরতে পারবো না’? এমন প্রশ্নে আসলে থমকে যায় পুরো পৃথিবী। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও সেই প্রশ্নে থমকে যান, চোখ থেকে জল ফেলে কষ্ট ভাগাভাগি করেন সেই কিশোরীর সঙ্গে।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) স্বৈরাচারের বিনাশ ঘটানো গৌরবের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ পরিবারের সম্মানে বিএনপি ‘জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করে। ওই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুমের শিকার ছাত্রদল নেতা পারভেজের কিশোরী মেয়ে রিধি এমন প্রশ্ন তোলেন।
অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বাবাকে জড়িয়ে ধরতে কিশোরীর আকুতি শুনে এ সময় কেঁদে ফেলেন তিনি। জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখা যায় চশমার ফাঁক দিয়ে বার বার চোখ মুছছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সভায় সারা দেশ থেকে আসা নির্যাতিত ব্যক্তি ও তাদের স্বজনরা কষ্ট ও ভোগান্তির গল্পগুলো তুলে ধরেন। জানান স্বজন হারানোর বেদনার সঙ্গে আর্থিক টানাপোড়েন, সন্তান আর তার ভবিষ্যতের চিন্তা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ভুক্তভোগীদের।
অনুষ্ঠানে জুলাই আন্দোলনে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ ওয়াসিম আকরামের বাবা শুধু নিজের সন্তানের কথাই বলেননি, তুলে ধরেন অন্য শহীদদের অভিভাবকের কষ্টও। রাষ্ট্রের কাছে শহীদ পরিবারগুলোর দাবি, বিচারের মুখোমুখি করা হোক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের।
এসময়য় ‘আমি আর আমার ভাই বাবাকে কি কোনোদিন জড়িয়ে ধরতে পারবো না’?- গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা পারভেজের মেয়ের কান্নাভেজা এমন প্রশ্নে ‘জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’য় লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি অংশ নেয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কাঁদলেন। মঙ্গলবার (১ জুলাই) জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ পরিবারের সম্মানে বিশেষ এই আলোচনা সভায় পারভেজের কিশোরী মেয়ে রিধি জানায়, অনেক বছর সে এবং তার ছোট ভাই বাবাকে দেখতে পায়নি।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। অনুষ্ঠানটি ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত থেকে উদ্বোধন করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিএনপির আয়োজিত দগণঅভ্যুত্থান ২০২৪: জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক আলোচনা সভা মঙ্গলবার (১ জুলাই) বিকেল ৩টায় ওই কেন্দ্রে এ অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অংশ নেন।
উদ্বোধনী বক্তব্য দেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেন। সভাপতিত্ব করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে জাতীয় নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে গুম, খুন ও নিপীড়নের শিকার পরিবারগুলোর সদস্যরা উপস্থিত রয়েছেন।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন এবং জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। এরপরই ফ্যাসিবাদী শাসনের ছায়ায় হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মৃতি এবং গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের গল্প উঠে আসে মঞ্চে।
এ সময় গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন ও ‘মায়ের ডাক’র আহ্বায়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, আমাদের অনেক বাধা অতিক্রম করে আজকে এখানে আসতে হয়েছে। বিগত সময়ে যত গুম-খুন হয়েছে, জুলাইতে আমাদের ছাত্র-জনতা, কৃষক-মজুর সবার আত্মত্যাগের মাধ্যমে এখানে আমরা এসেছি। ভিক্টিমদের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি, গুমের মহাকৌশলে যারা যুক্ত ছিলেন, যাদের মদদে আয়নাঘরে আমাদের ভাইদের ধরে নেওয়া হয়েছে এবং নির্যাতন করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের হত্যার বিচার আমরা চাই। যতদিন আমাদের শরীরে রক্ত আছে, আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু লড়বো।
আওয়ামীলীগের আমলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হাতে নিহত বিশ্বজিৎ দাসের বাবা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমার ছেলেকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে, এর বিচার এখনো হয়নি।
বক্তব্য রাখতে গিয়ে বুয়েট ছাত্রলীগের হাতে নিহত শহীদ আবরার ফাহাদের বাবা বলেন, আমার ছেলের হত্যার বিচার আমি এখনো পাইনি। কী অপরাধ ছিল আবরার ফাহাদের? সে দেশের পক্ষে কথা বলায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড আর না ঘটে। নতুনভাবে দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছে, এই স্বাধীনতা যেন অব্যাহত থাকে।
আন্দোলনের ঢাকায় প্রথম শহীদ ফারহান ফাইয়াজের বোন বলেন, আমার ভাই ২৮ জুলাই শহীদ হয়। সে ছিল ঢাকার প্রথম শহীদ। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আমরা যে বিজয় এনেছি, তা আমরা ধরে রাখতে পারছি কি না, তা প্রশ্ন থেকে যায়। জুলাইতে দল-মত নির্বিশেষে প্রতিবাদ করেছিল, কিন্তু এক বছর পর আমার মনে হয় সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারছি না। এই বিপ্লবের ফলে আমাদের আশা ছিল নতুন কিছু দেখতে পাবো। স্বৈরাচার হাসিনা যত অপকর্ম করেছে, এর দৃষ্টান্তমূলক বিচার আমরা দেখতে চাই। এরপর যেন কেউ এমন অপকর্ম না করতে পারে। শহীদরা যে বৈষম্যবিরোধী দেশ চেয়েছিল, সেটা যেন আমরা দেখতে পাই।
গণঅভ্যুত্থানে বুক পেতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়া আবু সাঈদের বড় ভাই বলেন, আবু সাঈদ বুক পেতে দেশের সবার সাহস জুগিয়েছিল, তাই ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে। কইসঙ্গে তিনি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে শহীদ পরিবারের পাশে থাকার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
এ ছাড়া গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া অনেকের পরিবারের সদস্যরা এবং আহতরা অভিযোগ করে বলেন, তাদের আন্দোলনে নতুন বাংলাদেশ পেলেও তাদের পরিবারের পাশে অথবা তাদের চিকিৎসায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার এবং জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সমন্বয়কদের কয়েকজনের নামোল্লেখ করে এ সময় শহীদদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।