আজ
|| ১২ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ২৮শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ১৬ই মহর্রম, ১৪৪৭ হিজরি
প্রভাত রিপোর্ট: বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়। অর্থাৎ এই পদ্ধতিতে একজন ভোটার শুধুমাত্র একজন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন এবং যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান তিনিই জয়ী হন। এই পদ্ধতিতে একটি নির্বাচনী এলাকা থেকে শুধুমাত্র একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কয়েকটি রাজনৈতিক দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক (পিআর) নির্বাচনের দাবি তুলছে। তবে, বিএনপিসহ কিছু দল এর বিরোধিতা করছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘স্বল্প সময়ের মধ্যে পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন’।
পিআর পদ্ধতিতে জটিল কিছু বিষয় আছে— উল্লেখ করে এই নির্বাচন বিশ্লেষক বলেন, ‘এটি আগে বুঝতে হবে। বিভিন্ন দেশে পরিচালিত এই পদ্ধতির ওপর গবেষণা করতে হবে। এরপর কোনটা আমাদের জন্য উপযুক্ত, সেটি বের করতে হবে। তাই বাংলাদেশে এই মুহূর্তে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করাটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে আমার মনে হয়। যদি ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতিতে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, মানুষকে তো এই পদ্ধতি আগে বুঝতে হবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, পিআর পদ্ধতির ভালো দিক হলো- যে দল নির্বাচনে যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে। এতে করে ছোট-বড় সব দলের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকবে। সংসদে কোনো দলের একক কর্তৃত্ব থাকবে না। তখন রাজনৈতিক দলগুলো নীতিকেন্দ্রিক অর্থাৎ নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে। তবে তারা এটিও বলছেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পদ্ধতি হঠাৎ করে চালু করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আগামী ছয় মাসের মধ্যে যদি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে জনসাধারণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে এই পদ্ধতি বোঝাতে সময়ই থাকবে না।’
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫৪ বছরে ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নির্বাচন নিয়ে বিতর্কও দেখা হয়। দীর্ঘ পথচলায় দেশে এখন পর্যন্ত একটি স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সাম্প্রতিক সময়ে তিনটি নির্বাচনকে ঘিরে যেমন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, তেমনি আসন্ন নির্বাচনে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়টিও বেশ বিতর্কের মুখে পড়েছে। এবার মূল আলোচনার বিষয়— ‘নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে’।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পিআর পদ্ধতির প্রয়োগ হয়। সেখানে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় এটির প্রয়োগ হয়। আমরা তো সেই পদ্ধতিতে নেই। আমাদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলও নেই। সুতরাং এখানে ব্যাপক প্রতিনিধিত্বের জন্য আনুপাতিক নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। সেই কারণে আনুপাতিক নির্বাচনের যে ন্যায্যতা, সেটি খুব বেশি আমাদের দেশে টেকে না।’তিনি আরও বলেন, ‘সব দল মনে করলে এটি চালু করতে পারে। কিন্তু এটি যারা চাচ্ছে তারা যদি শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে— এ চিন্তা করে, তাহলে ঠিক হবে না। কারণ, আমরা তো রাজনৈতিক দলের অংশ চাই না, চাই ভোটারদের অংশ কিংবা প্রতিনিধিত্ব।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে এখনও রাজনৈতিক দলগুলোর মনোনয়ন প্রক্রিয়া পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। পিআর পদ্ধতিতে আগে ৩০০ জনের মনোনয়ন একবারে দিয়ে দিতে হবে দলগুলোকে। মানুষ দলের প্রতীকে ভোট দেবে। নির্বাচনে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুযায়ী সংসদে আসন পাবে। এর বাইরে সর্বনিম্ন কত শতাংশ পর্যন্ত ভোট না পেলে সংসদে আসন পাবে না, সেটিও ঠিক করতে হবে।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে বাংলাদেশে কোনো দল এককভাবে সরকার গঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে পারবে না— বলেও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সরকার গঠনের জন্য ছোট ছোট দলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হবে বড় দলগুলোকে। ফলে সংসদে অনৈক্য তৈরি হবে। এছাড়া, ছোট দলগুলোর নানা চাহিদা তৈরি হবে। ফলে বাংলাদেশের বিশৃঙ্খল রাজনীতি আরও বেশি বিশৃঙ্খল হয়ে উঠবে।
এ প্রসঙ্গে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে গেলে তো ৩০০ জনের নমিনেশন (মনোনয়ন) একবারে দিয়ে দিতে হবে দলগুলোকে। মানুষ দলের প্রতীকে ভোট দেবে। এখন আপনি ভোট পেলেন ৩০ শতাংশ। তাহলে সংসদে আনতে পারবেন ৩০ শতাংশ প্রতিনিধিকে। আপনি এই ৩০০ জন প্রার্থীর মধ্যে কাদেরকে সংসদে আনবেন, এজন্য নির্দিষ্ট একটি ফর্মুলা লাগবে।’ ‘সেটি নির্ধারণে গণতান্ত্রিক নীতিমালা থাকতে হবে। এখন প্রশ্ন আসছে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র কি সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে? এখনও আমাদের এখানে এই নীতি চলছে যে, আমি মারা যাওয়ার পর আমার ছেলে, মেয়ে কিংবা স্ত্রী এমপি হবে। এই জাতীয় জায়গাগুলো কীভাবে ঠিক করবেন? আগে এগুলোতে আমাদের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা পরিবারকেন্দ্রিক নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
বাংলাদেশে আনুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালু হলে তা বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকবে— মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক মাহবুব রহমান। তার মতে, ‘এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তখন সরকার গঠনের জন্য ছোট ছোট দলগুলোর সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে। তখন সংসদে থাকবে অনৈক্য। সরকারগুলো হবে দুর্বল এবং উদ্ভূত সরকারের পতন ঘটবে। এতে বাংলাদেশ আরও সংকটে পড়ে যাবে।’
অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীর বাইরে বাংলাদেশে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন অনেকে। পিআর পদ্ধতিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ খুবই কম। তাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া কী হবে সেটিও আগে নির্ধারণ করতে হবে— মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে স্থানীয় সরকারের কিছু কিছু নির্বাচন বিশেষ করে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পিআর পদ্ধতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এমনকি সংসদের উচ্চকক্ষের (যদি গঠন করা হয়) ৫০ শতাংশ আসনও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করা যেতে পারে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতি অনেক ভালো ব্যবস্থা। যদি এটি ঠিকভাবে প্র্যাকটিস করা যায়। এটিকে ফেলে দেওয়া যাবে না। কলম্বো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে পরিচালিত হয়। আমরাও পরীক্ষামূলকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অর্থাৎ দু-একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এটি প্রয়োগ করতে পারি।’‘এছাড়া সংসদের উচ্চকক্ষের ৫০ শতাংশ আসন পিআর পদ্ধতিতে করা যেতে পারে’— মনে করেন তোফায়েল আহমেদ।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ বেশ কয়েকটি দল আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করার দাবি তুলেছে। অন্যদিকে, বিএনপি এবং তাদের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোসহ একাধিক দল প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সংসদে তারা সেই অনুপাতে আসন পাবে। অর্থাৎ কোনো দল যদি ৩০ শতাংশ ভোট পায়, ওই দল সংসদের ৩০ শতাংশ আসন পাবে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৮০টির বেশি দেশে এই পদ্ধতিতে ভোট হচ্ছে। তবে, দেশভেদে এই ব্যবস্থার রূপ ও কাঠামো আলাদা।
বাংলাদেশে বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোট সবচেয়ে বেশি। এরপর জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন ভোটের শতাংশে এগিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রচলিত ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ পদ্ধতিতে একটি আসনে চারজন প্রার্থী থাকলে সেখানে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনিই বিজয়ী হন। এখানে ভোটের শতকরা হার বিবেচ্য নয়।
দেশে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। এই নির্বাচনে ভোট পড়ে ৫৫.৪ শতাংশ। বিএনপি সারাদেশে ৩০.৮১ শতাংশ ভোট পায় এবং ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ শতাংশ ভোট পায়, ৮৮টি আসনে জয়লাভ করে তারা। জামায়াত ১২.১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৮ আসনে জয়লাভ করে। একইভাবে জাতীয় পার্টি ১১.৯২ শতাংশ ভোট পেয়ে ৩৫টি, কৃষক শ্রমিক লীগ ১.৮১ শতাংশ ভোট পেয়ে পাঁচটি, সিপিবি ১.১৯ শতাংশ ভোট পেয়ে পাঁচটি, ইসলামী ঐক্যজোট ০.৭৯ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি এবং ন্যাপ ০.৭৬ শতাংশ ভোট পেয়ে একটি আসনে জয়লাভ করে। ওই নির্বাচনে জাকের পার্টি ১.২২ শতাংশ ভোট পেলেও কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি।
কিন্তু ওই নির্বাচন যদি পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক) পদ্ধতিতে হতো তাহলে প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে সম্ভাব্য ফলাফলে বিএনপির আসন অনেক কমে যেত। মোট ৫৫.৪ শতাংশের ভোটের ফলাফলের হিসাবে সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে বিএনপি ৩০.৮১ শতাংশ ভোটের জন্য আসন পেত ৯২টি। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ শতাংশ ভোটের হিসাবে আসন পেত ৯০টি। একইভাবে ১২.১৩ শতাংশ ভোটের হিসাবে জামায়াত পেত ৩৬টি আসন, ১১.৯২ শতাংশ ভোটে জাতীয় পার্টি পেত ৩৫টি, ১.৮১ শতাংশ ভোটে কৃষক লীগ পেত ৫-৬টি, ১.২২ শতাংশ ভোটে জাকের পার্টি পেত ৩-৪টি, ১.১৯ শতাংশ ভোটে সিপিবি পেত ৩-৪টি, ০.৭৯ শতাংশ ভোটে ইসলামী ঐক্যজোট পেত ২-৩টি এবং ০.৭৬ শতাংশ ভোটে ন্যাপ পেত ২টি আসন। ফলে, ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সম্ভাব্য ফলাফল মূল্যায়ন করলে এতে স্পষ্ট হয় যে, ছোট দলগুলো সংসদে বেশি আসন পেত। ধর্মভিত্তিক দলগুলো আরও বেশি আসন পেত। অর্থাৎ, সংসদে বড় দলগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য কমত।
নির্বাচন বিশ্লেষক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচনের এই আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি যদি চালু হয় তাহলে সুশাসন নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে ছোট-বড় সব দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবে। এটি হচ্ছে পিআর পদ্ধতির ভালো দিক। তবে, এই পদ্ধতিতে গঠিত সরকার স্থিতিশীল নাও হতে পারে। কারণ, পিআর পদ্ধতিতে ভোট হলে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না।’
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে সব ভোটারের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব। অনেক সময় খুব সামান্য পার্থক্য থাকলেও অনেক দল সংসদে একটি আসনও পায় না। কিন্তু এই পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে তাতে ন্যূনতম ভোট পেলে সব রাজনৈতিক দলেরই প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ থাকবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টিসহ বেশকিছু রাজনৈতিক দল। তবে দলগুলোর নেতারা বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে তারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচনে পিআর পদ্ধতিতে করা সম্ভব নয় বলে জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করার শর্তে নিম্নকক্ষে প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচনে রাজি হয়েছে। কিন্তু বিএনপি যদি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে রাজি না হয় তাহলে তারা তাদের পূর্বের দাবিতে ফেরত যাবে।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব মাওলানা ইউনুছ আহমাদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এতদিন যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে বেশিরভাগ সময় দেখেছি কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি সংসদে গিয়েছেন। আবার দেখা গেছে, ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে কোনো দল সরকার গঠন করেছে। অন্যদিকে, কোনো কোনো দল ১০ ও ১৫ শতাংশ করে— এভাবে ৭০ শতাংশ ভোট পেয়েও তারা সরকারে যেতে পারেনি। ফলে ৩০ শতাংশ সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে ৭০ শতাংশ মানুষের ওপর তাদের একক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা চাই, প্রতিটি ভোটারের মূল্যায়ন হোক। এই কারণে আমরা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের কথা বলেছি।’ পিআর পদ্ধতির সুফল সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘এটি হলে প্রতিটি দলের প্রতিনিধি থাকবে। তখন একটি জাতীয় সরকারের রূপ দেওয়া যাবে। জাতীয় সরকার থাকলে তখন সংঘাত কমে আসবে। পরামর্শের ভিত্তিতে দেশ সুন্দরভাবে পরিচালিত হবে। এছাড়া ভালো প্রার্থীকে সংসদে আনা যাবে।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা পিআর ব্যবস্থার পক্ষে। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে জাতীয় স্বার্থ এবং উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের প্রস্তাব থেকে আমরা সরে এসেছি। এখন যদি উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু না হয় তাহলে আমরা নিম্নকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক দাবিতে ফেরত যাব।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘যারা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়, তারা আসলে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চায়। তারা অন্ধকারের শক্তিকে ফিরিয়ে আনতে চায়। জনগণ এই ষড়যন্ত্র বুঝে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি কেউ পিআর পদ্ধতি চালু করতে চায়, তাহলে সোজাসুজি জাতির সামনে এসে নিজেদের রাজনৈতিক প্রস্তাব তুলে ধরুক, নির্বাচন করুক, জয়লাভ করুক; তারপর পিআর আনুক। কিন্তু বিএনপির ঘাড়ে চেপে কিংবা রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে কিছু আদায় করা যাবে না। জাতি এসব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।’
যদিও ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব ইউনুছ আহমাদ বলেন, ‘কাউকে চাপে রাখার উদ্দেশ্যে আমরা পিআর পদ্ধতি দাবি করছি না। আমরা তো নিজেরাই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে সময় পাই না, অন্য দল নিয়ে গবেষণা করার সময় কোথায়? যে যার অবস্থান থেকে কাজ করবে। কাউকে দুশমন করে কেন সময় নষ্ট করব।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তনই ছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষা। সেই জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে ভারসাম্যপূর্ণ ও গণপ্রতিনিধিত্বশীল সংসদের জন্য আনুপাতিক হারে নির্বাচনের বিকল্প নেই। আনুপাতিক হারে নির্বাচন হলে সংসদে সব দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। আর সংসদে সব দলের প্রতিনিধি থাকলে কেউ স্বৈরাচার হতে পারবে না। ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ঠেকানোর জন্য এটি একটি কার্যকর মাধ্যম হতে পারে।’