সাইফুর রহমান : ২০২৪-২৫ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন বাণিজ্য নীতিমালায় বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক (গার্মেন্টস), চামড়াজাত পণ্য ও ইস্পাতসহ বিভিন্ন খাতের রপ্তানি এই শুল্কের আওতায় পড়বে। এই প্রতিবেদনে নতুন শুল্কের বিবরণ, এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শ্রমজীবী মানুষের ওপর প্রভাব, বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া এবং বাংলাদেশ কী ধরণের পদক্ষেপ নিতে পারে তা বিশদভাবে বিশ্লেষণ করা হলো।
নতুন আরোপিত শুল্কের সংক্ষিপ্ত চিত্র
২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি সকল রপ্তানি পণ্যের ওপর ৩৫% হারে শুল্ক কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের তথাকথিত “পারস্পরিক প্রতিশোধমূলক শুল্ক” পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এই হার নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগেই ২০২৫ সালের এপ্রিলে ৩৭% হিসাবে জানানো হলেও পরে সামান্য কমিয়ে ৩৫% করা হয়েছে। এই হার বাংলাদেশের পণ্যের উপর যুক্তরাষ্ট্রে এতোদিন প্রযোজ্য গড় শুল্কের দ্বিগুণেরও বেশি (যেখানে আগে গড়ে প্রায় ১৫% শুল্ক ছিল) । অর্থাৎ এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা প্রতিটি বাংলাদেশি পণ্যের মূল্যের প্রতি ১০০ ডলারে ৩৫ ডলার শুল্ক দিতে হবে, যা আগে ছিল মোটামুটি ১৫ ডলার। ধাতব পণ্য থেকে শুরু করে তৈরিকৃত পোশাক – সব ধরনের পণ্যেই এই শুল্ক প্রযোজ্য হবে বলে ট্রাম্পের চিঠিতে স্পষ্ট জানানো হয়েছে।
নতুন এই শুল্কনীতির আওতায় বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশকে টার্গেট করা হয়েছে, যাদের পণ্যে ২৫% থেকে ৪০% পর্যন্ত শুল্ক আরোপের নোটিস দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোর ওপর শাস্তিমূলক হারে বেশি শুল্ক পড়েছে। উদাহরণসরূপ, ইন্দোনেশিয়ার জন্য ৩২%, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার জন্য ৩৬%, লাওস ও মিয়ানমারের জন্য ৪০% পর্যন্ত হার নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের জন্য ৩৫% শুল্ক ধরায় এটি ভিয়েতনাম (২০%) বা ভারত (প্রায় ২৫-২৭%) এর চেয়ে বেশি, আবার কম্বোডিয়া (৪৯%) বা চীনের (৪০%) চেয়ে কিছুটা কম। তবে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে শুল্কহার ২০%-এ নামিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে ভারত ও শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে কী হার নির্ধারণ হবে তা আলোচনাধীন, তবে তুলনামূলকভাবে তাদের জন্য হার কিছুটা কম হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতিতে ৩৫% হার বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিযোগিতা অসুবিধা তৈরি করবে।
বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি প্রধানত তৈরি পোশাকনির্ভর। ২০২৪ সালে প্রায় ৮.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাংলাদেশি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়, যার মধ্যে ৭.৩৪ বিলিয়নই ছিল প্রস্তুত তৈরি পোশাক (আরএমজি) । যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০-৮৫% আসে পোশাক খাত থেকে। এর বাইরে চামড়া ও চামড়া-পণ্য (বিশেষ করে জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি) এবং গৃহসজ্জা ও টেক্সটাইল পণ্যও উল্লেখযোগ্য অংশ দখল করে। নতুন ৩৫% শুল্ক এসব পণ্যেও সমানভাবে কার্যকর হবে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি চামড়া এবং গৃহ টেক্সটাইল শিল্পও এই শুল্কে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হবে। ইস্পাত বা ধাতব পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের পরিমাণ কম হলেও, এ ক্ষেত্রেও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে প্রতিযোগিতা শক্ত হবে। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে সাম্প্রতিককালে তামা, এ্যালুমিনিয়াম, ইস্পাতের মতো ধাতুগুলোর উপরও ৫০% পর্যন্ত শুল্ক বসানোর ঘোষণা দিয়েছে, যা ভবিষ্যতে যেকোনো ধাতব রপ্তানিকারকের জন্য খারাপ পূর্বাভাস বহন করে।
শুল্কারোপের পেছনের যুক্তি ও ট্রাম্প প্রশাসনের উদ্দেশ্য
ট্রাম্প প্রশাসন এই শুল্কনীতিকে “পারস্পরিক শুল্ক (reciprocal tariff)” বলে অভিহিত করেছে। এর মূল যুক্তি হলো, যে দেশগুলি মার্কিন পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক বা কর আরোপ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (সারপ্লাস) উপভোগ করে, তাদের পণ্যেও সমান হারে শুল্ক বসিয়ে “ন্যায্যতা” প্রতিষ্ঠা করা। ট্রাম্প সরকার দাবী করছে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে অত্যন্ত বেশি কর ও শুল্ক আরোপ করে – আনুমানিক “৭৪% কার্যকর করহার” – যা পারস্পরিক বাণিজ্যে ভারসাম্য নষ্ট করছে। তাই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭% (এবং পরবর্তীতে সামান্য হ্রাসকৃত ৩৫%) শুল্ক বসানো হচ্ছে। ট্রাম্প তার চিঠিতে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ককে “দুর্ভাগ্যবশত পারস্পরিক নয়” বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে দীর্ঘদিনের বাণিজ্য ঘাটতি ও অসম পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য এই শুল্ক প্রয়োজন।
ট্রাম্প প্রশাসনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রথমত, “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির আওতায় নিজ দেশের শ্রমিক ও শিল্পকে রক্ষা করা এবং ভোটারদের কাছে সংকেত দেয়া যে বিদেশে চাকরি যাওয়া বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশকে সরাসরি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যে তারা যেন তাদের কিছু পোশাক কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তর করে – অর্থাৎ বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা যদি আমেরিকায় কারখানা স্থাপন করেন তবে এ শুল্ক থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের শ্রম অধিকার সুরক্ষার বিষয়েও পদক্ষেপ দাবি করেছে। এই প্রস্তাবের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে: আমেরিকায় উৎপাদন ফিরে আনা ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। যদিও বাংলাদেশি পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে এভাবে কারখানা স্থানান্তর বাস্তবে অসম্ভব এবং তাতে টি-শার্টের দাম $১০ থেকে $২০০ ডলারে পৌঁছে যাবে, তবু ট্রাম্প প্রশাসনের বার্তা স্পষ্ট – আমেরিকান বাজারে প্রবেশাধিকার পেতে হলে হয় আপনি আমাদের পণ্য বেশি কিনুন, নয়তো আপনার কারখানা আমাদের দেশে আনুন।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের এই শুল্ক যুদ্ধ অনেকাংশে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর প্রচেষ্টা। এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি দীর্ঘদিনের। ট্রাম্প প্রকাশ্যে “অন্যদের সাথে বাণিজ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি”কে ন্যায্যতা হিসেবে দেখিয়ে শাস্তিমূলক শুল্ক বসাচ্ছেন। যদিও অনেক অর্থনীতিবিদ এই যুক্তির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তবু রাজনৈতিকভাবে এটি ট্রাম্পের সমর্থকগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করে। বিশ্লেষকরা ইঙ্গিত করছেন, ট্রাম্প হয়তো আসলে চীনের বিরুদ্ধে অবস্থান আরও কঠোর করার কৌশল হিসেবে এশিয়ার অন্য দেশগুলোকে টার্গেট করছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যেসব দেশে চীনা বিনিয়োগ বেশি (যেমন কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার), সেগুলোকেও সর্বোচ্চ হারে শুল্ক দিয়ে চীনের প্রভাবিত সরবরাহ শৃঙ্খলে আঘাত করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও গত এক দশকে চীনের বিনিয়োগ ও প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে – অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক সহায়তা পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে। ট্রাম্প প্রশাসন হয়তো প্রত্যক্ষভাবে না বললেও, এই ধরণের নীতির মাধ্যমে পরোক্ষভাবে চীনকে চাপ দিতে চাচ্ছে। এছাড়া, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সস্তা শ্রমের সুবিধায় যে সেক্টরগুলো (পোশাক, চামড়া ইত্যাদি) ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল, সেগুলোকেই নিশানা করে মার্কিন প্রশাসন বোঝাতে চাচ্ছে যে কম খরচের উৎপাদন দিয়ে মার্কিন বাজার দখল করা এত সহজ হবে না।
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে অর্থনৈতিক ধাক্কা
৩৫% শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানি খাতকে বহুমুখী চাপের মধ্যে ফেলেছে। সবচেয়ে বড়ো প্রভাবটি পড়বে তৈরি পোশাক শিল্পে, যা একাই বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০% এর বেশি অবদান রাখে এবং প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান করে। এই শুল্কের কারণে মার্কিন ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশি পোশাক ২০% শুল্কযুক্ত ভিয়েতনামী পণ্যের তুলনায় অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। ফলে মার্কিন আমদানিকারকরা সহজেই বিকল্প সরবরাহকারীর দিকে ঝুঁকতে পারেন। বিশেষত, ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তি করে শুল্ক কমিয়ে আনায় তাদের প্রতিযোগিতায় বাড়তি সুবিধা হবে। ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর ক্ষেত্রেও শুল্কহার কিছুটা কম থাকলে (ভারতের জন্য ২৭%, পাকিস্তান ৩০% প্রস্তাবিত হয়েছে) অনেক ব্র্যান্ড তাদের অর্ডার সেসব দেশে স্থানান্তর করতে পারে। বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বেড়ে গেলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে। ব্লুমবার্গ ইকোনমিক্সের একটি অনুমানে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বিরূপ পরিস্থিতি মিলিয়ে ২০২৫ সালে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে ২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতি হতে পারে, যার বড় অংশই আসবে নতুন মার্কিন শুল্কের ধাক্কা থেকে।
এই ধাক্কার সরাসরি প্রতিফলন হবে চাকরির বাজারে। দেশে বৈদেশিক বাজারের অর্ডার কমে গেলে অসংখ্য পোশাক কারখানা সাময়িকভাবে উৎপাদন কমাতে বা কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্প মালিক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি রুবানা হক সতর্ক করে বলেছেন, ৩৫% শুল্ক কার্যকর থাকলে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য তা “ধ্বংসাত্মক” হবে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে ভিয়েতনাম যেখানে ২০% হারে রপ্তানি করছে, সেখানে আমাদের ৩৫% দিতে হলে আমরা মারাত্মক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ব। তার আশঙ্কা, এই শুল্কের সাথে আগের ১৬% হার যদি যোগ হয় (যদিও সরকারিভাবে স্পষ্ট নয় ঠিক কীভাবে হিসাব হবে), তাহলে কার্যকর মোট শুল্ক প্রায় ৫০% ছুঁয়ে ফেলবে – যা বাংলাদেশের পণ্যের জন্য মার্কিন বাজার কার্যত বন্ধ হওয়ার শামিল। বাস্তবেও এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না; তথ্য অনুযায়ী নতুন ৩৫% শুল্ক আগের বিদ্যমান শুল্কের ওপর অতিরিক্ত হিসেবেই আরোপিত হবে বলে ধরে নেওয়া হলে মোট করহার ৫০% ছাড়িয়ে যাবে। এতো উচ্চ হারে কর দিয়ে কোন পণ্যই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না।
শুল্কবৃদ্ধির প্রভাব কেবল পোশাকেই সীমাবদ্ধ নয়। এর ঢেউ দেশের অন্যান্য রপ্তানি খাতেও লাগবে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন। পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি উপখাত (টেক্সটাইল, সুতা, বোতাম, প্যাকেজিং, লজিস্টিকস ইত্যাদি) চাপ অনুভব করবে, কারণ প্রধান রপ্তানি কমলে এদের ব্যবসাও কমবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন মন্তব্য করেছেন, “৩৫% শুল্ক আরোপ হলে শুধু পোশাক নয়, ব্যাংক-বীমা থেকে শুরু করে সামগ্রিক বাণিজ্য পরিবেশ সবই ঝাঁকুনি খাবে” । একজন রপ্তানি নির্দেশিত অর্থনীতির জন্য এটি এক বিরাট আঘাত। বাংলাদেশের জিডিপিতে রপ্তানির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে; রপ্তানি আয় কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মুদ্রার বিনিময় হার এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন যে এর ফলে বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) সংকট আরও তীব্র হতে পারে এবং উচ্চ প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধি এমন এক সময় এলো যখন বাংলাদেশের পোশাক খাত ইতোমধ্যে কিছু অন্য সমস্যার মুখোমুখি। জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটছে দেশের ভেতরে, এবং প্রতিবেশী ভারতের সাথেও বাণিজ্য নিয়ে কিছু টানাপোড়েন চলছে যা রপ্তানিতে প্রভাব ফেলছিল। এর সাথে এই নতুন শুল্ককে অনেকেই “পারফেক্ট স্টর্ম” বা সকল ঝড়ের মিলিত আঘাত হিসেবে বর্ণনা করছেন। ব্লুমবার্গের হিসাবে তিন দিক থেকে (ভারতের সাথে বিরোধ, দেশের ভেতরে শক্তি সংকট, এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক) আঘাত একসাথে আসায় পোশাক রপ্তানি ক্ষতির পরিমাণ বিরাট হবে। মোট কথা, অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি রপ্তানি খাতটি এখন এক অনিশ্চয়তার মুখে।
ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলোর অনেক কারখানা আংশিক বা সম্পূর্ণ বন্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে, যা বেকারত্ব বাড়িয়ে সামাজিক অস্থিরতার শঙ্কাও তৈরি করছে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে লাখ লাখ পরিবার সরাসরি রপ্তানি শিল্পের নিম্নআয়ের চাকরির ওপর নির্ভরশীল, তাদের দৈনন্দিন জীবনে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে – যা আমরা পরের অংশে বিস্তারিত দেখব।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক ও আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া
ট্রাম্পের এই শুল্কাযুদ্ধ শুধু অর্থনৈতিক নয়, কূটনৈতিক সম্পর্কেও এক উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী এবং রপ্তানি বাজার, আর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় একটি মিত্রসুলভ রাষ্ট্র। কিন্তু বাণিজ্য বিষয়ে এই কঠোর অবস্থান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েনের ইঙ্গিত বহন করছে। বাংলাদেশ সরকার প্রকাশ্যে খুব কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বটে, তবে কৌশলগতভাবে এই চাপ মোকাবিলায় অন্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারে। এর মধ্যে আঞ্চলিক পরাশক্তি চীন ও ভারতের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
চীনের প্রতিক্রিয়া: চীন স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের একতরফা শুল্কনীতির সমালোচক। বেইজিং থেকে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র একে “মৌখিক জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে মিথ্যা ঢাল” উল্লেখ করে বলেছেন যে, “এই ধরনের স্বেচ্ছাচারী শুল্ক যুদ্ধের কোনো বিজয়ী নেই এবং কারও স্বার্থে আসে না” । যুক্তরাষ্ট্র যখন বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চাপে ফেলছে, চীন তখন নিজেকে উদার বাণিজ্যের সমর্থক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করবে, যা বাংলাদেশের জন্য এক কৌশলগত সুযোগও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কে টান ধরলে বাংলাদেশ চীনের দিকে আরও ঝুঁকতে পারে উন্নয়ন প্রকল্প, ঋণ বা বাজার প্রবেশাধিকারের জন্য। ইতোমধ্যেই চীন বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কোটায় ৯৮% পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, যা রপ্তানি বহুমুখীকরণে কিছুটা সহায়ক হয়েছে। সুতরাং, যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ ব্যয়বহুল হয়, বাংলাদেশ চীনা বাজারে আরো রপ্তানি বৃদ্ধির চেষ্টা করতে পারে বা চীনের বিনিয়োগ বাড়াতে আরও উৎসাহী হতে পারে। তবে এটাও মাথায় রাখা দরকার যে, চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অসন্তোষ বাড়তে পারে, বিশেষ করে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভূরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া: ভারত নিজেও ট্রাম্পের এই “পারস্পরিক শুল্ক” তালিকার আওতায় রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ভারতের জন্য প্রস্তাবিত হার প্রায় ২৫-৩০% হতে পারে। ভারতের বাণিজ্য বিশাল এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের ঘাটতিও উল্লেখযোগ্য, তাই ভারতও আলোচনায় লিপ্ত। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পিয়ুশ গোয়াল ইতোমধ্যে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সাথে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন ও দ্রুত এগোনোর কথা বলেছেন, যাতে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ করে তারা শুল্ক যুদ্ধের ধাক্কা সামলাতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, ভারত এই পরিস্থিতিকে কিছুটা দ্বিমুখী দৃষ্টিতে দেখছে। একদিকে বাংলাদেশ তাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বন্ধুদেশ; অন্যদিকে পোশাক-টেক্সটাইল রপ্তানিতে বাংলাদেশ তাদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়লে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের সুযোগ বাড়বে বলে অনেকেই ধরে নিচ্ছেন। বাস্তবেই, বাংলাদেশের ওপর ৩৫% শুল্ক ঘোষণার খবরের পরদিনই ভারতে কিছু বড় টেক্সটাইল ও পোশাক কোম্পানির শেয়ারের দাম লাফিয়ে বেড়ে যায়, কারণ বিনিয়োগকারীরা মনে করেছেন আমেরিকান ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে সরে গিয়ে ভারত থেকে বেশি পোশাক কিনবে। হিন্দুস্তান টাইমসের একটি প্রতিবেদনের বরাতে বলা হচ্ছে, এই শুল্ক বাংলাদেশের মতো প্রধান গার্মেন্ট রপ্তানিকারকের জন্য বড় আঘাত এবং এর ফলে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
তবে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের জন্য কিছু সতর্কতাও আছে। বাংলাদেশ প্রচুর ভারতীয় সুতি সুতা ও কাপড় আমদানি করে পোশাক বানায় (বাংলাদেশ হচ্ছে ভারতীয় তুলা ও কাপড়ের অন্যতম বড় ক্রেতা) । যদি বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমে যায়, তাহলে বাংলাদেশ হয়তো ভারতের কাছ থেকেও কাঁচামাল কম নেবে – যা ভারতের টেক্সটাইল খাতের জন্য নেতিবাচক হতে পারে। ফলে ভারতের নীতি-নির্ধারকদের জন্য এটি মিশ্র ফলাফলের বিষয়। আপাতত তারা নিজেদের চুক্তি করতে ব্যস্ত এবং বাংলাদেশকে প্রকাশ্যে তেমন সাহায্যের আশ্বাস শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু আঞ্চলিকভাবে বাংলাদেশ-ভারত একসাথে যেন বাণিজ্য সুবিধা পায় সে বিষয়ে আলোচনা হতে পারে, উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (সাফটা) বা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সহজীকরণ।
সার্বিকভাবে, ট্রাম্পের শুল্ক নীতিতে বাংলাদেশের মতো দেশের উপর চাপ পড়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে সূক্ষ্ম পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ বিকল্প বাজার ও জোটের সন্ধান করবে, যা তাকে চীন, রাশিয়া, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর সাথে আরো বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে উৎসাহিত করতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও চাইবে না যে তারা চাপ দিতে গিয়ে পুরো বাংলাদেশকে হারিয়ে ফেলুক; ফলে কূটনৈতিক দর কষাকষি চলতেই থাকবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই সময়ে গুরুত্বপূর্ণ – কারণ ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার, এবং যদি যুক্তরাষ্ট্রের দরজা কিছুটা বন্ধ হয় তবে বাংলাদেশ ইউরোপে বেশি রপ্তানির চেষ্টা করবে। তবে ইউরোপীয় ক্রেতারাও এই সুযোগে দাম কমানোর চাপ বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা আছে, কারণ অনেক সরবরাহকারী একই বাজারে প্রতিযোগিতা করবে। তাই বাংলাদেশকে খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ ও বিবেচনাপূর্ণ কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে যেন এক পাশে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনাও চালিয়ে যায়, অন্যদিকে বিকল্প প্রস্তুতিও থাকে।
শ্রমিক-মজুরদের জীবনে আঘাতের গল্প
বাংলাদেশের শত শত পোশাক কারখানায় কর্মরত লাখো শ্রমিকের জীবনজীবিকা বর্তমানে এই অনিশ্চিত শুল্ক পরিস্থিতির কারণে ঝুলন্ত সূতার ওপরে ঝুলছে। আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানার সেলাই মেশিন অপারেটর রহিমা বলছেন, প্রতিদিনই তিনি ভয়ে থাকেন চাকরিটা না জানি কবে চলে যায়। গত কয়েক মাস ধরে কারখানার ফ্লোরে একটাই আলোচনা – অর্ডার কমে যাচ্ছে, ছাঁটাই আসছে। রহিমা জানান, “কারখানায় কেউ এলেই বুক ধড়ফড় করে – মনে হয় যেন আমাকে এসে বলে যাবে, ‘তোমার চাকরি নেই’” । এই আতঙ্কের কারণ সহজ: যুক্তরাষ্ট্রে নতুন শুল্ক বাড়ার গুজবে অনেক ক্রেতা এখন “দেখি-না-ভবিষ্যতে কী হয়” মুডে আছে, নতুন অর্ডার দেওয়া স্থগিত রেখেছে ফলে কারখানা মালিকরাও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় শ্রমিক সংখ্যা কমানোর কথা ভাবছেন।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের একটি বিরাট অংশই নারী। এরা গ্রামের দরিদ্র পরিবেশ থেকে উঠে এসে শহরে রুটিরুজির ব্যবস্থা করেছেন। উচ্চ শুল্কজনিত অর্ডার পতনের ধাক্কা সবচেয়ে বেশি লাগবে এই শ্রমিক পরিবারগুলিতে। কাজ কমে গেলে প্রথমেই কারখানা শ্রমিকদের ওভারটাইম কিংবা বোনাস কাটবে, পরে সাময়িক ছুটিতে পাঠানো বা স্থায়ীভাবে চাকরি কাটার মত পদক্ষেপ আসতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। অর্থনীতির এক অধ্যাপক সেলিম রায়হান সতর্ক করেছেন, এই শুল্কবৃদ্ধির ভার মূলত পোশাক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ও তাদের লাখো শ্রমিকের ওপর পড়বে, যা প্রবৃদ্ধি মন্থর করা থেকে শুরু করে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য বাড়িয়ে দিতে পারে। বহু পরিবার যেখানে মাস শেষে মজুরির টাকায় কোনমতে খেয়ে-পরেই টিকে থাকে (Paycheck-to-paycheck), তাদের জীবনে এই আয়ের অনিশ্চয়তা চরম দুর্দশার কারণ হতে পারে।
শ্রমিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই শুল্ক যুদ্ধ তাদের জীবনে এক অদৃশ্য যুদ্ধের মত। কারখানার ফ্লোরে গুঞ্জন চলছে – “অর্ডার কমে যাচ্ছে”, “ফ্যাক্টরি নাকি বন্ধ হবে”, “ছাঁটাই লিস্ট হচ্ছে” – যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে। যে নারীরা ঢাকার বস্তিতে ভাড়া বাড়িতে থাকেন, তারা ইতোমধ্যেই খরচ কমাতে শুরু করেছেন: কারো সন্তানকে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছেন খরচ বাঁচাতে, কেউ খাবারে মাংস-ডিম কমিয়ে দিচ্ছেন, আবার কেউ বা আগাম অন্য কোথাও কাজ খুঁজছেন। রাইমনী বালা যেমন বলেন, “এই চাকরিটা আমার কাছে শুধুই পরিশ্রমের নয়, সম্মানের। এটা থাকলে আমার ছেলেদের স্বপ্ন দেখতে পারি। যদি এটা চলে যায়, জানি না আমাদের কী হবে” । শ্রমিকদের এই মানবিক সংকটময় অবস্থাই স্পষ্ট করছে যে শুল্ক সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত আসলে কাগজ-কলমের হিসাব ছাড়িয়ে কেমন ব্যাপক সামাজিক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ ও রপ্তানিকারকদের প্রতিক্রিয়া
শুল্ক ঘোষণার পর ঢাকায় সরকার ও ব্যবসায়ী মহল উভয়ই নড়েচড়ে বসেছে। সরকারিভাবে বলা হচ্ছে, এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার দরজা খোলা আছে এবং আলোচনা চালিয়ে প্রত্যাশিত “উইন-উইন” সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, “আমরা এমন একটি শুল্ক চুক্তির দিকে তাকিয়ে আছি যা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হবে” । অর্থাৎ, বাংলাদেশ এখনো আশাবাদী যে আলোচনার মাধ্যমে হার কমানো যাবে বা আপোসের কোনো সমাধান বের হবে।
আলোচনার কৌশল হিসেবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ বেশ কিছু মার্কিন পণ্যে শুল্ক-কর রেয়াত দিতে প্রস্তুত, যার মধ্যে গম, সয়াবিন, তুলা, এমনকি বোয়িং বিমান ক্রয়ও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় অভিযোগ যে বাংলাদেশের সাথে তাদের বছরে প্রায় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি থাকে (বাংলাদেশ বেশি রপ্তানি করে, কম আমদানি করে) । সেই ফাঁক কমাতে বাংলাদেশ এই পদক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছে – অর্থাৎ বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে তেল, তুলা, ভোগ্যশস্য ও বিমান বেশি কিনবে যাতে ঘাটতি কমে। এমনকি বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ সরকারি কেনাকাটায় যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেবে – যেমন খাদ্যশস্য, সামরিক সরঞ্জাম ইত্যাদি ক্ষেত্রে আমেরিকান যোগানদাতাদের থেকে কেনার চেষ্টা করবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানিকারকরাও লাভবান হবে এবং তারা হয়তো বাংলাদেশের পণ্যের ওপর শুল্ক কমাতে রাজি হবে। এই প্রস্তাবগুলো আলোচনার টেবিলে রয়েছে এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে ট্রাম্প প্রশাসনের লক্ষ্যও আসলে বাংলাদেশকে কিছু মার্কিন পণ্য কেনাতে বাধ্য করা, যাতে দ্বিপাক্ষিক ঘাটতি কমে।
বাংলাদেশের বাণিজ্য আলোচনা দল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও বাণিজ্য সচিবসহ একটি প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করছেন। সেখানে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছে যে বাংলাদেশ তাদের আমদানি শুল্ক, ভ্যাট এবং বিভিন্ন কর কমিয়ে মার্কিন পণ্যের বাজার আরও খুলে দিক; এর বিনিময়ে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি শুল্ক কমানো যেতে পারে। ঢাকার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রস্তাব নিয়ে তারা দেশে ফিরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সাথে আলোচনা করবেন যাতে দেশের স্বার্থ রক্ষা করে যতটা সম্ভব সমঝোতা করা যায়। অর্থমন্ত্রী (অর্থ উপদেষ্টা) সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ভিয়েতনামের মতো বড় ঘাটতির দেশও যখন ২০% এ নামিয়ে নিতে পেরেছে, তখন বাংলাদেশের মাত্র $৫ বিলিয়নের ঘাটতি থাকার পরও এত বেশি শুল্ক আরোপের যুক্তিসংগত কারণ নেই – এই যুক্তি তারা আলোচনায় তুলে ধরছেন।
ব্যবসায়ী মহলের প্রতিক্রিয়া বেশ জোরালো। বিশেষ করে পোশাক রপ্তানিকারকরা এই ঘোষণায় ভীষণ উদ্বিগ্ন ও হতাশ। বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি রুবানা হক খোলাখুলি বলেছেন, শুল্কটি যদি বহাল থাকে তবে তা “বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে” । তিনি ইতোমধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন সরকার আলোচনায় কী করছে, এবং জানিয়েছেন যে আগস্টের আগে কূটনৈতিক তৎপরতার সুযোগ আছে – সেটা কাজে লাগাতে হবে। বিজিএমইএ’র বর্তমান সভাপতি মহমুদ হাসান বাবু (মহমুদ হাসান খান) বলেছেন, “আমরা শুরু থেকে সরকারকে বলেছি জোরালোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় নামতে; কিন্তু শুধু আশ্বাস পেয়েছি, ফল পাইনি” । তিনি সতর্ক করেছেন যে যদি ১ আগস্ট এই শুল্ক কার্যকর হয়ে যায়, যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভর অনেক কারখানা রপ্তানির সংকটে পড়বে এবং অনেকের টিকে থাকা কঠিন হবে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ (নিট পোশাক মালিক সমিতি) উভয় সংস্থা থেকেই সরকারকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওয়াশিংটনে শক্তিশালী লবিস্ট নিয়োগ করার এবং বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিদেরও আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো জায়ান্টের সাথে লবিং ছাড়া আলোচনায় সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব – ভিয়েতনাম ও অন্যান্য দেশ এই কাজটি সুচারুভাবে করেছে, কিন্তু বাংলাদেশ সময়মতো সে পথে হাঁটেনি। অবশ্য এখনো দেরি হয়নি, তাই জরুরি ভিত্তিতে অভিজ্ঞ লবিস্ট সংস্থার সহায়তা নিতে ব্যবসায়ীরা আহ্বান জানাচ্ছেন।
অন্যান্য খাত থেকেও শঙ্কার কথা উঠে আসছে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এর সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম বলেছেন, এই শুল্কের ফলে শুধু পোশাক নয়, সামগ্রিক অর্থনীতিতেই আঘাত আসবে – কারণ রপ্তানি আয়ে ধস নামলে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, প্রবৃদ্ধি সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি উল্লেখ করেন, পোশাক খাত জিডিপির বড় অংশ জুড়ে আছে এবং এর সফলতা অনেকাংশে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে জড়িত। তাই এতবড় একটা ঝাঁকুনি সামলাতে সরকারকে দ্রুত ও দক্ষ পদক্ষেপ নিতে হবে।
অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা সর্বসম্মত যে ৩৫% শুল্ক বাংলাদেশের জন্য এক যুগান্তকারী চ্যালেঞ্জ। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “এতো উচ্চ শুল্কের মধ্যে রপ্তানি ব্যবসা চালানো বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন হবে” । তার মতে, এই শুল্কের প্রভাব বহুস্তরে পড়বে – শুধু তৈরি পোশাক নয়, তার সাথে সংশ্লিষ্ট পশ্চাৎসংযোগ শিল্প (যেমন কাপড়, সুতা, অ্যাক্সেসরিজ) ও পূর্বরূপ সংযোগ (ব্যাংক, বিমা, পরিবহন) সবখানেই এর ঢেউ যাবে। ফলে বাংলাদেশের গ্লোবাল মার্কেটে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা গুরুতর হুমকির মুখে পড়বে।
আরেকজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সিপিডির ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বাংলাদেশের পক্ষে স্বল্প সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করা কিংবা আমদানি বিপুল বাড়িয়ে ঘাটতি কমানো কঠিন ছিল। সরকার কিছু শুল্ক হ্রাসের উদ্যোগ নিলেও ব্যবসায়ীরা যেখান থেকে সস্তায় সুবিধা পান সেখান থেকেই আমদানি করেন – শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে তারা বেশিরভাগ কাঁচামাল আমেরিকা থেকে কিনবেন, এ বাস্তবতা নয়। মুস্তাফিজ বলেন, “বাংলাদেশ এলডিসি বলে বাড়তি সুবিধা আশা করা বাস্তবসম্মত নয়; যুক্তরাষ্ট্র ঐতিহাসিকভাবেই এলডিসিদের বিশেষ সুবিধা দেয়নি” । তার প্রশ্ন, যখন বাংলাদেশের সঙ্গে মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি, আর ভিয়েতনামের ১২৫ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি সত্ত্বেও ওরা রেহাই পেল – তখন আমাদের এতটা চাপে ফেলার যুক্তি দুর্বল। তারপরও তিনি আশা রাখেন যে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করলে পরিস্থিতি কিছুটা বদলানো যেতে পারে।
বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা RAPID-এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এই ফলাফল প্রমাণ করে দিয়েছে যে বৈদেশিক বাণিজ্য চুক্তি করতে বাংলাদেশের দুর্বলতা আছে। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, “বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত কোনো পূর্ণাঙ্গ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির অংশ হয়নি – এটাই আমাদের দুর্বলতা” । তার বিশ্লেষণ, আমরা সময় মতো আলোচনা না বাড়ানো এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারকে সম্পৃক্ত না করার মাশুল দিচ্ছি। একই সঙ্গে তিনি ও অন্য বিশেষজ্ঞরা জোর দিচ্ছেন যে ফেলে আসা তিন মাসের সময়টুকু আমরা যথার্থ কাজে লাগাতে পারিনি – শুল্ক মওকুফে যেসব তালিকা দেওয়ার কথা ছিল বা দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার ছিল, সেখানে শ্লথতা দেখা গেছে। উদাহরণ হিসেবে, বাংলাদেশ ৬২৬টি আমদানি পণ্যে শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি কমাতে, কিন্তু সেসব সুফল দেখানোর মতো সময়ে বা সঠিক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করা হয়নি। অন্যদিকে ভিয়েতনাম খুব দ্রুত স্পষ্ট তালিকা দিয়ে আলোচনা এগিয়ে নিয়েছে, ফলে সুবিধা আদায় করেছে।
আরেক বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান (প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত সদস্য, ট্যারিফ কমিশন) বলেন, চূড়ান্ত প্রভাব আসলে অনেকটাই নির্ভর করবে চীন, ভারত, পাকিস্তানের মতো বড় খেলোয়াড়দের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কী হার বসায় তার ওপর। তার বক্তব্য, এখনও যদি দেখা যায় চীনের ওপর ৫০% আর ভারতের ওপর ৩০% শুল্ক বসে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা আপাতত বাংলাদেশের ৩৫%-কে মেনেও নেবে (কেননা চীনে ৫০% হলে সেখানকার পণ্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে যাবে) । একই কথা বিকেএমইএ’র একজন নেতা ফজলে শামীম এহসানও বলেছেন – যদি চীন-ভারতের ওপরও উচ্চ শুল্ক বসে, তবে উল্টো বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বাড়তেও পারে। কিছু উদ্যোক্তা এই পরিস্থিতিকে তাই শেষ কথা হিসেবে দেখছেন না, বরং交 আশা করছেন যে ৩৫% হারটিকে আলোচনার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং শেষমেশ এটি কমিয়ে আনা হবে। যেমন, বিখ্যাত পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ মন্তব্য করেছেন, “৩৫% হার বাস্তবে কার্যকর হবে বলে আমি মনে করি না; এটি আলোচনা জোরদার করতে একটা চিপ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে” । অবশ্য তা হবে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য সবাই ওয়াশিংটনের দিকে তাকিয়ে আছেন।
সামগ্রিকভাবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো: এই ধাক্কা বাংলাদেশকে শিক্ষা দিচ্ছে যে দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির বাইরে থাকা আর চলে না। বিশ্ব বাণিজ্য এখন ক্ষমতার খেলায় পরিণত হয়েছে, যেখানে বড় অর্থনীতির দেশের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি না থাকলে বিপদে পড়তে হয়। বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি বাজার বহুমুখী করতে হবে এবং কূটনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হতে হবে যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের একতরফা শুল্ক আঘাত এড়ানো যায়।
সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয়
শুল্ক সংকটের তাৎক্ষণিক প্রভাব সামলাতে এবং ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশ কিছু নীতি-কৌশলগত পদক্ষেপ নিতে পারে:
১. রপ্তানি বাজার বহুমুখীকরণ: দীর্ঘমেয়াদে একই সঙ্গে একটি বা দু’টি বড় বাজারের উপর এতটা নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বাংলাদেশের রপ্তানি ভূগোল সম্প্রসারণ জরুরি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখনো আমাদের জন্য শুল্কমুক্ত বাজার (এলডিসি সুবিধা হিসাবে) প্রদান করছে, তবে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সেই সুবিধা সীমিত সময়ের জন্য থাকবে। তাই ইউরোপীয় বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। পাশাপাশি, আঞ্চলিক ও উদীয়মান অর্থনীতির বাজারগুলোতে প্রবেশ বাড়াতে হবে – যেমন পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার কিছু দেশে বাংলাদেশি পোশাক, ওষুধ, চামড়া পণ্য বিক্রির সুযোগ আছে। এই বাজারগুলো বিকশিত করতে সরকার ও রপ্তানিকারকদের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে (বাণিজ্য মিশন, মেলা, ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি ইত্যাদি মাধ্যমে)। রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য বাড়িয়ে যেমন কৃষিপণ্য, হালকা প্রকৌশল, আইটি সেবা ইত্যাদিতেও জোর দেওয়া উচিত, যাতে কোন একটি খাতে সমস্যা হলে অন্য খাত দিয়ে সামাল দেওয়া যায়।
২. মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও বাণিজ্য সমঝোতা: বাংলাদেশের জন্য এটি স্পষ্ট সতর্কসংকেত যে এখন বৈশ্বিক বাণিজ্যে সরাসরি চুক্তি না থাকলে অসুবিধায় পড়তে হয়। ইতোমধ্যে অনেক দেশের সাথে আলাপচারিতা শুরু হয়েছে – যেমন ভারতের সাথে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি (সেপা), চীনের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা, থাইল্যান্ডের সাথে এফটিএ নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি চলছে। এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হিসেবে কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ইত্যাদি উন্নত দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য সুবিধা বাড়াতে পারলে উত্তরণের পথ বের হতে পারে। বাংলাদেশ বিমসটেক, ডি-৮, আইওআরএ ইত্যাদি আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য – এগুলোকে সক্রিয় করে আঞ্চলিক বাণিজ্য জোট শক্তিশালী করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় সাফটা এখন নিষ্ক্রিয়, তবে দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানের সাথে বাণিজ্য সহজীকরণ ও শুল্ক ছাড় বাড়ানোর সুযোগ আছে। এলডিসি থেকে বের হওয়ার পর বাংলাদেশকে WTO-স্বীকৃত বিশেষ সুবিধা (যেমন ইউরোপের GSP+) পেতে হবে, সে ব্যাপারেও কূটনীতি জোরদার করা দরকার।
৩. পণ্য উৎপাদনে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানো: উচ্চ শুল্কের ধাক্কা সামলে উঠতে হলে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে এবং পণ্যের মূল্য সংযোজন বাড়াতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি, কারখানায় প্রযুক্তির ব্যবহার, সরবরাহ শৃঙ্খলে দক্ষতা উন্নয়ন – এইসব পদক্ষেপ বাংলাদেশি পণ্যকে কিছুটা হলেও সস্তা করতে ও মান বাড়াতে সহায়তা করবে। যদি আমরা এমন উদ্ভাবনী পণ্য বানাতে পারি যেগুলোর বিকল্প বাজারে কম, তাহলে ক্রেতারা কিছুটা বেশি দামেও সেগুলো কিনতে রাজি হবে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চমানের ফ্যাশন পণ্য, জটিল পোশাক বা বিশেষায়িত চামড়া সামগ্রী যেগুলো অন্যরা সহজে তৈরি করতে পারে না – সেদিকে মনোযোগ দেয়া যেতে পারে। এভাবে ভ্যালু-চেইনে উপরের দিকে উঠে গেলে শুল্ক বাড়লেও মুনাফা বজায় রাখা তুলনামূলক সহজ হবে।
৪. সরকার-ব্যবসায়ী অংশীদারিত্ব ও কূটনৈতিক লবিং: বর্তমান সংকট দেখিয়েছে যে বেসরকারি খাতের সাথে সমন্বয় না করে কেবল সরকারি উদ্যোগে এমন সমস্যা মোকাবিলা কঠিন তাই এখন থেকে বড় বাণিজ্য আলোচনায় ব্যবসায়ী নেতাদের সম্পৃক্ত করা, যৌথ কৌশল নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে পেশাদার লবিস্ট নিয়োগ এবং বাংলাদেশের পক্ষে সেখানে জনমত তৈরিতে কাজ করা দরকার। কংগ্রেসম্যান, সেনেটর ও ইউএস প্রশাসনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ বাড়িয়ে বাংলাদেশের পক্ষ তুলে ধরতে হবে যে এত উচ্চ শুল্ক দিলে উভয় পক্ষেরই ক্ষতি (আমেরিকায় পোশাকের দাম বাড়বে, ক্রেতারা বিপদে পড়বে)। অনেক মার্কিন ব্র্যান্ড এবং ক্রেতা প্রতিষ্ঠানও চাইবে না যে হঠাৎ করে তাদের সোর্সিং ধাক্কা খাক; সে বিষয়টি তুলে ধরে তাদেরকেও আলোচনায় নিয়োগ করা যেতে পারে। ইতোমধ্যে শোনা যাচ্ছে বড় বড় মার্কিন পোশাক ক্রেতারা বাংলাদেশি সরবরাহকারীদের বলছে যেন তারা বাড়তি শুল্কের খরচ ভাগাভাগি করে নেয়– অর্থাৎ ক্রেতা কিছু শতাংশ বেশি দেবে, বিক্রেতা কিছু কম দামে দেবে, এভাবে শুল্কের ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা চলছে। এসবই অস্থায়ী সমাধান, তাই সবার আগে কূটনৈতিক পথেই মূল সমস্যার সমাধান করতে হবে।
৫. শ্রমিক কল্যাণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনা: সম্ভাব্য বেকারত্ব ও ছাঁটাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ও কারখানা মালিকদের এখনই পরিকল্পনা করতে হবে। অতীতে যেমন কোভিড মহামারীর সময় প্রণোদনা দিয়ে শ্রমিকদের বেতন কিছু মাস চালু রাখা হয়েছিল, তেমনই যদি শুল্কের ধাক্কায় অনেক অর্ডার বাতিল হয় তবে একটি বিশেষ সহায়তা তহবিল গঠন করে শ্রমিকদের কিছু মাস বেতন বা খাদ্যসহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে হবে। এছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য দক্ষতা প্রশিক্ষণ (স্কিল ট্রেনিং) কর্মসূচি নিতে হবে, যেন যারা চাকরি হারাবেন তারা অন্য খাতে কাজ পেতে সক্ষম হন। মালিকরাও যেন অপ্রয়োজনে ছাঁটাই না করে, বরং শ্রমিক ধরে রাখতে সব চেষ্টাই করেন – এ জন্য আর্থিক প্রণোদনা বা ব্যাংক ঋণে সুবিধা দেওয়ার বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
৬. আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি: বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO) এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই ইস্যু তুলে ধরতে পারে। ট্রাম্পের শুল্ক অনেক ক্ষেত্রেই WTO নিয়মের বিরোধী (যেমন একই পণ্যের ওপর দেশে দেশে ভিন্ন হার, যা Most Favoured Nation নীতির ব্যত্যয়) । যদিও মার্কিন প্রশাসন জাতীয় নিরাপত্তা বা প্রতিশোধের যুক্তিতে এটা করছে, তবু আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করা যেতে পারে। কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান প্রভৃতি যেসব দেশ একই চাপে আছে তাদের সাথে মিলে একটি যৌথ অবস্থান নেয়া যেতে পারে, যাতে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো যায় এই শুল্ক উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতিতে কতটা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে আগামী বছরের মার্কিন নির্বাচনের আগমুহূর্তে এই বিষয়টি জোরালোভাবে তুলে ধরা গেলে হয়তো ট্রাম্প প্রশাসন কিছুটা চাপ অনুভব করবে।
৭. সংহত দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন: সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের উচিত বর্তমান সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য কৌশল তৈরি করা। এতে অপ্রত্যাশিত শুল্ক বা বাণিজ্য বাধা এলে কীভাবে রপ্তানি খাত টিকে থাকবে তার রূপরেখা থাকতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ, নতুন শিল্পায়ন – সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিকে আরও বহুমুখী ও স্থিতিস্থাপক (resilient) করতে হবে।
শেষ পর্যন্ত, ট্রাম্প-যুগের নতুন শুল্কনীতি বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে এক কঠিন পরীক্ষার সময় নিয়ে এসেছে। এটি একদিকে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের অস্বস্তিকর দুর্বলতাগুলো উন্মোচিত করেছে (যেমন সীমিত বাজারে নির্ভরতা, নীতি-নির্ধারণে ধীরগতি, চুক্তি না থাকা) এবং অন্যদিকে নতুন করে পরিবর্তনের তাগিদ জাগিয়েছে। সরকার ও ব্যবসা মহল যদি মিলে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, তাহলে সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব – হয়তো কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। সর্বোপরি, আমাদের মনে রাখতে হবে এই ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধের শেষে কোনো পক্ষই আসলে পুরোপুরি বিজয়ী হয় না; কাজেই দরকষাকষি ও সমঝোতার মাধ্যমেই একটি ভারসাম্যমূলক সমাধানে পৌঁছানো সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত পথ। বাংলাদেশ সেই সমাধানের পথেই হাঁটছে এবং বিশ্ববাসী নজর রাখছে – এই ছোট দেশের শ্রমিক-মালিক-মন্ত্রীরা মিলেই কি বড় কূটনীতিক চ্যালেঞ্জকে জয় করতে পারে!