প্রভাত ডেস্ক: ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যেগুলোতে দাবি করা হয় সেগুলোই নাকি সাম্প্রতিক দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার চিত্র। তবে সংবাদ সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, ভাইরাল হওয়া এসব ছবি ও ভিডিও প্রকৃত ঘটনাস্থলের ছবি-ভিডিওর সঙ্গে মেলে না এবং এগুলোতে এমন কিছু অসামঞ্জস্যতা রয়েছে যা স্পষ্টতই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির ব্যবহার নির্দেশ করে।
২০২৫ সালের ২১ জুলাই ফেসবুকে পোস্ট করা দুটি ছবির বাংলা ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘আমার হৃদয় থেমে যাচ্ছে……. একটি প্রশিক্ষণ বিমান ভয়াবহভাবে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ মাঠে বিধ্বস্ত হয়েছে।’ ছবিগুলোতে দেখা যায়, একটি খেলার মাঠের মাঝে একটি ব্যক্তিগত জেট বিমানে আগুন লেগেছে, আশপাশে জরুরি উদ্ধারকর্মীরা এবং উৎসুক জনতার ভিড়।
ছবিগুলো ছড়ানো হয় সেই সময়, যখন একটি বাংলাদেশি যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিধ্বস্ত হয়, ঠিক সেই সময় যখন ক্লাস শেষ করে শিক্ষার্থীরা বাইরে আসছিল। ওই ঘটনায় ৩২ জন নিহত হয়, যাদের বেশিরভাগই শিশু। আহত হয় ১৭০ জনের বেশি, এর মধ্যে ৬৯ জন এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
একই ধরনের আরেকটি ছবি, যেখানে একটি যুদ্ধবিমান ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন একটি ভবনের পাশে দেখা যায়, সেটিও ২১ জুলাই ফেসবুকে ছড়ায়। তার বাংলা ক্যাপশন ছিল, ‘কিছু তরুণ এখন চালকের ব্যর্থতা নিয়ে গল্প বানাচ্ছে, কেন? ছাত্রদের বক্তব্য অনুযায়ী কি ১০০+ ছাত্র মারা যাওয়া সম্ভব?’
একটি ভিডিও, যাতে দাবি করা হয় যে সেটিই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার দৃশ্য, সেটি ফেসবুকে ৩ লক্ষাধিক বার দেখা হয়েছে। ভিডিওটির বাংলা ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘যেভাবে দুর্ঘটনাটি হয়েছিল’।
এ ধরনের ছবি ও ভিডিও শুধু বাংলায় নয়, থাই, মালয় ও বর্মী ভাষাতেও অনুরূপভাবে ছড়ানো হয়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি চিত্র
এএফপি জানায়, ছড়ানো ছবিগুলো বাস্তব ঘটনাস্থলে ধারণ করা তাদের নিজস্ব ছবি ও ভিডিওর সঙ্গে মেলে না। ২১ জুলাই দুর্ঘটনার পরপরই এএফপির আলোকচিত্রীরা ঘটনাস্থল থেকে যুদ্ধবিমানটির ধ্বংসস্তূপ, পোড়া ফিউজেলাজ ও ইঞ্জিনের ছবি তোলেন, যেগুলো স্কুল ভবনের অভ্যন্তরে ছিল। এএফপির একজন আলোকচিত্রীর নিশ্চিত বিবৃতি অনুযায়ী, ভাইরাল হওয়া ছবিগুলোর কোনোটিই আসল দুর্ঘটনাস্থলের চিত্র নয়।
প্রথম দুটি ভাইরাল ছবিতে দেখা যায়, দুটি আলাদা যাত্রীবাহী বিমান খোলা মাঠে আগুনে পুড়ছে— যেগুলো যুদ্ধবিমান নয়। পাশাপাশি, ছবিতে থাকা ‘ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের’ পোশাক বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে মেলে না।
ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে কিছু স্পষ্ট দৃশ্যগত ত্রুটি, যেমন— বিকৃত দেহ, হাত বা পা নেই এমন মানুষের অবয়ব— যা সাধারণত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়।
তৃতীয় ভাইরাল ছবিতে একটি যুদ্ধবিমান একটি ভবনের আঙিনায় দেখা যায়, তবে সেটি প্রায় অক্ষত এবং পাশে আরেকটি বিমানের ধ্বংসাবশেষও দেখা যায়— যা বাস্তবতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করে দেখা গেছে, ছবিটি আগে অন্য পোস্টেও ব্যবহৃত হয়েছে এবং গুগলের ‘About this image’ অপশন অনুযায়ী, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মাধ্যমে তৈরি।
এই চিহ্নিত করার প্রক্রিয়ায় গুগলের SynthID প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যা তাদের ডিপমাইন্ড ল্যাব ২০২৩ সালে চালু করে।
ভুয়া ভিডিওতেও ‘এআই’-এর প্রমাণ
যে ভিডিওটিকে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার দৃশ্য বলা হচ্ছে, সেটিতেও রয়েছে কিছু ইঙ্গিত। ভিডিওটির নিচের ডান পাশে ‘Veo’ নামের একটি ওয়াটারমার্ক দেখা যায়। Veo হলো গুগলের একটি এআইচালিত ভিডিও নির্মাণের সফটওয়্যার, যা মাত্র আট সেকেন্ডের রিয়ালিস্টিক ভিডিও তৈরি করতে পারে— ভাইরাল ভিডিওটির দৈর্ঘ্যও ঠিক আট সেকেন্ড। এছাড়াও ভিডিওতে ‘Milestone’ শব্দটি ভুল বানানে ‘Milesttone’ লেখা হয়েছে।
এএফপি স্পষ্ট করে জানিয়েছে, ঢাকায় যে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে তার প্রকৃত ছবি ও ভিডিও তাদের নিজস্ব আলোকচিত্রীরা সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু যে ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি ও বিভ্রান্তিকর।