প্রভাত সংবাদদাতা,রূপগঞ্জ: বর্ষাকাল এলেই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের নিচু এলাকাগুলো যেন পরিণত হয় একেকটি জলবন্দী জনপদে। টানা কয়েকদিন বৃষ্টি হলেই উপজেলার ৩০ থেকে ৪০টিরও বেশি এলাকায় সৃষ্টি হয় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। এ অবস্থায় লাখো মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাতে হয়।
বৃষ্টি নামলেই রাস্তা-ঘাট, দোকানপাট, বাসাবাড়ির নিচতলা ডুবে যায় কোমর সমান পানিতে। থমকে যায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না, কর্মজীবীরা যেতে পারে না অফিসে । মসজিদে নামাজ পড়া, কবরস্থানে দাফন সবকিছুই হয়ে উঠে দুঃসাধ্য। অচল হয়ে আছে সেচ প্রকল্প, অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে হওয়া খাল-বিল। জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সেচ প্রকল্পগুলোর মেশিন গুলো অচল অবস্থায় পড়ে আছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও আবাসন প্রকল্পের কারণে খাল-বিল ভরাট হয়ে গেছে। ফলে স্বাভাবিক পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
বৃষ্টি হলে পানি জমে থাকে দিনের পর দিন। সেই সঙ্গে আশপাশের ঘরবাড়ির ময়লা, ড্রেনের দুর্গন্ধযুক্ত আবর্জনা, এমনকি শিল্পকারখানার গরম কালো বর্জ্য মিশে তৈরি করছে ভয়াবহ দূষণ। রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা এই পানিতে বাড়ছে চর্মরোগ, ডায়রিয়া, টাইফয়েডসহ পানিবাহিত রোগের ঝুঁকি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রূপগঞ্জের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার নিম্নাঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তারাবো পৌরসভা: বরপা, তেতলাবো, মাসাবো, কান্দাপাড়া, কর্নগোপ, কাহিনা দৈবই, গন্ধবপুর, দীঘিবরাবো, খাদুন, মৈকুলী, কাঞ্চন পৌরসভা: হাটাবো, বারৈপাড়া, নবারুণ, কুশাব, পিঠা গুঁড়ি, আমলাবো, ভূলতা ইউনিয়ন: আউখাব, বলাইখা, টেলাপাড়া, পাচাইখা, ছোনাবো, মাসুমাবাদ
গোলাকান্দাইল ইউনিয়ন: নতুন বাজার, বাঘমোছড়া, নাগেরবাগ, বউ বাজার, ৫ নম্বর ক্যানেল, বলায়া,
মুড়াপাড়া ইউনিয়ন: গঙ্গনগর, দরিকান্দি, শিবগঞ্জ, মিরকুটিরছেও।
স্থানীয়রা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে একই সমস্যা চললেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা হলেও বাস্তবায়নের কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে দুর্ভোগকে মেনে নিচ্ছে। অনেকেই বলছেন, জলাবদ্ধতা যেন আমাদের নিয়তি হয়ে গেছে।
নাগের বাগ এর আব্দুর রহমান বলেন,বৃষ্টি শুরু হলেই দুশ্চিন্তা শুরু হয়। কোমর পানি পার হয়ে বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাতে হয়। দোকানে পানি, অফিসে পানি জীবনটা যেন থমকে যায়। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান নেই।
বরপা শান্তি নগর এর বাসিন্দা কাসেম ড্রাইভার বলেন, আমরা প্রায় প্রতি বর্ষায় পানির নিচে ডুবে থাকি। একটু বৃষ্টি হলেই শান্তি নগর শান্তিতে থাকে না। রাস্তা-ঘাট, ঘরের উঠান—সব জলে ভরে যায়। স্কুলগামী শিশু, অফিসগামী মানুষ, রোগী—সবাই ভোগান্তিতে পড়ে। আমি পেশায় ড্রাইভার, গাড়ি বের করাই মুশকিল হয়ে যায়। এই সমস্যা বছরের পর বছর চলছে। কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই বললেই চলে।
মৈকুলী গ্রামের গৃহবধূ শামীমা আক্তার বলেন, কত বছর আগে যে আমাদের এলাকাটা ভালোভাবে শুকাইছিলো, সেটা আমি মনে করতে পারি না। এখানে বছরের আট-দশ মাসই পানি জমে থাকে। মিল-ফ্যাক্টরিগুলো আশেপাশের খাল দখল কইরা রাখছে, পানি যাওনের কোনো রাস্তা নাই। বৃষ্টি একটু বেশি হইলেই তো ঘরে পানি ঢুইকা যায়। আমরা তো গরিব মানুষ, কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই—এই কষ্টের মাঝেই থাকতে হয়।
আল্লাহ চাইলে কোনো সময় শুকায়, না হইলে পানি আর যায় না। এভাবে থাকলে কয়দিন আর মানুষ থাকবে বলেন? আমাদের আশেপাশের অনেকেই তো বাড়িঘর বিক্রি কইরা চলে গেছে। আমরা টিকতে পারতেছি না, শুধু কষ্ট পাই।
আমি কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল অনুরোধ করি দয়া করে খালগুলা দখলমুক্ত করেন, পানি যাইবার ব্যবস্থা করেন। গরিব মানুষরে আর কষ্টে ফালাইয়া রাখবেন না।
কর্নগোপের বাসিন্দা মাওলানা মাহাবুবুর রহমান বলেন কর্নগোপ এলাকার জলাবদ্ধতা আজ আর শুধু একটি মৌসুমি সমস্যা নয়, এটি এখন জনজীবনের স্থায়ী দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। প্রতি বর্ষায় কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টিই পুরো মহল্লা ডুবিয়ে দেয়। মসজিদে যেতে কষ্ট হয়, স্কুলে বাচ্চারা যেতে পারে না, এমনকি কবরস্থানে জানাজাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এটা শুধু অবকাঠামোগত ব্যর্থতা নয়, এটি মানবিক ও সামাজিক ব্যর্থতাও।
আমি একজন ধর্মীয় মানুষ হিসেবে বলবো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। কিন্তু পানি জমে থাকার কারণে এলাকায় ময়লা-আবর্জনার গন্ধ, মশা-বাহিত রোগ, ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়ছে। আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি একটি পরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা গড়ে তুলুন। খাল-বিল দখলমুক্ত করে পানি চলাচলের পথ খুলে দিন।
আমরা চাই না শুধু ওয়াদা, আমরা চাই বাস্তবিক পদক্ষেপ। কর্নগোপের মানুষ শান্তিতে বাঁচতে চায়, সেটা নিশ্চিত করাটা দায়িত্বশীলদের কর্তব্য।
তেতলাবো এলাকার বাসিন্দা জিল্লুর রহমান বলেন, বর্ষা আসলেই আমরা আতঙ্কে থাকি। রাস্তাঘাটে তো সবসময়ই পানি জমে থাকে, আর বৃষ্টি হলে সেই পানি ঢুকে পড়ে ঘরের ভেতরেও। খালের পানি কালচে হয়ে থাকে শোনা যায় কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য পানি মিশে যাচ্ছে। এই পানি শুধু অসুবিধা নয়, একেকটা রোগের উৎস হয়ে উঠছে, বিশেষ করে চর্মরোগ,এলার্জি, ঘা, চুলকানি লেগেই থাকে। আমরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, আমাদের কেউ দেখে না। কতবার কতজনের কাছে গেছি, কেউ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এখন শুধু আল্লাহর দিকেই তাকিয়ে আছি।
কলেজ ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, অল্প বৃষ্টি হলেই প্রতিদিন পানির মধ্যে দিয়ে কলেজে যেতে হয়। কখনো কোমর পানি, কখনো হাঁটুর ওপরে উঠে যায়। বই-খাতা ভিজে যায় বলে খুব ভয় লাগে। সময়মতো পৌঁছাতে পারি না, ক্লাস মিস হয়ে যায়। অনেক সময় তো বেরই হতে পারি না। মেয়েদের জন্য এটা আরও বেশি কষ্টের—পানি, কাদা, ভেজা জামাকাপড়ে দিনের শুরুটা যেন যুদ্ধের মতো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি গত ১১ মাসে ৮টি খাল পুনরুদ্ধার করেছি। পাশাপাশি কয়েকটি খাল পুনঃখনন করেছি। ইস্ট ওয়েস্ট আবাসন কোম্পানি একটি পুরো খাল দখল করে ভরাট করেছিলো সেটি আমরা উদ্ধার করে আবার পুনরায় খনন করেছি। আমাদের এখানে একটি বড় গ্রুপ কোম্পানি -সিটি গ্রুপ একটি খাল দখল করে মাটি ভরাট করে রেখেছে আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডে কে পত্র দিয়েছি তারা কথা দিয়েছে আগামী মাসে উদ্ধার করে দিবে ।
অপরিকল্পিত নগরানের কারণে মূলত আরো বেশি জলাবদ্ধতা বেড়েছে । জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খনন ও ড্রেন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এটি সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়। দরকার একটি মাস্টারপ্ল্যান, যাতে রূপগঞ্জের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা টেকসই হয়।
উপ-পরিচালক, পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাকিবুল আলম রাজিব বলেন, রূপগঞ্জে জলাবদ্ধতার মূল কারণ হলো এখানকার অধিকাংশ খাল দখল হয়ে গেছে। বিশেষ করে তারাবো পৌরসভার খালগুলো এখন নানা শিল্পগ্রুপের দখলে। সিটি গ্রুপ, গাজী গ্রুপ, অন্তিম নিট কম্পোজিট, মজুমদার গ্রুপসহ বেশ কিছু গ্রুপ কোম্পানি খালের স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে রেখেছে।
আবার কাঞ্চন, ভুলতা, গোলাকান্দাইল—এই সব এলাকায় আবাসন প্রকল্প ও সড়ক উন্নয়ন (চার লেন প্রকল্প) কাজের ফলে খালগুলো প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ফলে পানি বের হতে পারছে না, আর জলাবদ্ধতা এখন স্থায়ী রূপ নিচ্ছে।
এছাড়া বিগত সময়ে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার কারণে পাম্পগুলো নষ্ট থাকলেও মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে বর্তমানে সেগুলো সচল করা হয়েছে। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে চেষ্টা করছি দখল হওয়া খালগুলো উদ্ধার করতে, যাতে স্বাভাবিক পানি নিস্কাশনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা যায়।
উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী (পানি নিষ্কাশন) প্রকৌশলী মো. আক্তার হোসেন বলেন, খাল-বিল ভরাট হওয়া, অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ও অচল পাম্পমেশিন এই তিনটি কারণেই মূলত জলাবদ্ধতা হচ্ছে। আপাতত আমরা নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছি জলাবদ্ধতা নিরসনে জন্য আশা করি যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করবো ।
এই বিষয়ে পরিবেশবিদরা বলছে এভাবে পানি জমে থাকলে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। পানি নিষ্কাশনের জন্য আধুনিক ও টেকসই পরিকল্পনা ছাড়া রূপগঞ্জ জলবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে ।
জলাবদ্ধতা যেন রূপগঞ্জবাসীর জন্য দুর্বিষহ এক যন্ত্রণার নাম। অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা, স্বাস্থ্যঝুঁকি আর সামাজিক স্থবিরতা যেন নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামীতে এর ভয়াবহতা আরও বাড়বে—এমনটাই বলছেন স্থানীয়রা।