প্রভাত রিপোর্ট: পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে আনা হয়েছে, থানায় জিডি রেকর্ড, মামলা রুজু তদন্ত ও পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে থানায় জিডি বাধ্যতামূলক, কোনোক্রমেই জিডি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। পুলিশ সংস্কার কমিশনের এমন ১৩ প্রস্তাবের মধ্যে ১১টি বিবেচনায় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সমস্যা সমাধানে অনলাইন জিডি গ্রহণ সর্বোত্তম সমাধান কারণ অনলাইনে জিডি দায়ের করা হলে তা গ্রহণ না করার কোনো অবকাশ নেই।
জানা গেছে, গত ২৩ জুলাই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিটের আয়োজনে পুলিশ সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত সুপারিশ বাস্তবায়নবিষয়ক প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া। পুলিশ কমিশনারের আশু বাস্তবায়নযোগ্য বিভিন্ন প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এতে।
সভায় পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশে এটি শুরু হয়েছে। সারাদেশে কার্যক্রমটি শুরু করতে প্রায় ৪০ হাজার জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসহ ভেস্ট পোশাক প্রয়োজন হবে। সুপারিশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। রাতের বেলায় (সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়) বৃহৎ তল্লাশি করার ক্ষেত্রে অবশ্যই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট/স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি/স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে বলে প্রস্তাবে বলা হয়। বর্তমানে প্রচলিত আইনে বিষয়টি সন্নিবেশিত আছে এবং এর কার্যকর প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
থানায় মামলা রুজু তথা এফআইআর গ্রহণ ও তদন্ত কঠোরভাবে সার্কেল অফিসার বা পুলিশ সুপার কর্তৃক নিয়ম করা হচ্ছে মর্মে পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, এই কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। কেস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশ ব্যতীত কোনোক্রমেই এফআইআর বহির্ভূত আসামি গ্রেফতার করা যাবে না বলে সুপারিশে বলা হয়। এ বিষয়ে সিনিয়র সচিব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পুলিশ মহাপরিদর্শক জানান, প্রতিক্ষেত্রে কেস ডায়েরি আদালতে দাখিল করে আদালতের আদেশক্রমে আসামি ধরতে হলে প্রকৃত অপরাধীর পালিয়ে যাওয়ার অবস্থা, ধরা না পড়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে প্রচলিত পদ্ধতি অধিক কার্যকর বিধায় তা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
ভুয়া গায়েবি মামলায় মৃত, নিরপরাধ নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দায়ের প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য করতে হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। সভায় জানানো হয়, প্রচলিত আইনের বিধান রয়েছে এর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে হবে। প্রয়োজনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। অজ্ঞাতপরিচয়ের আসামির নামে মামলা দেওয়ার অপচর্চা পরিহার করতে হবে। কোনো পুলিশ সদস্য যদি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে কাউকে এ ধরনের মামলা বা হয়রানি করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়। টিআই প্যারেডের মাধ্যমে অজ্ঞাতপরিচয়ের আসামি শনাক্তকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এর অপপ্রয়োগ অবশ্যই পরিহার করতে হবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্টের পর গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে যে জন-আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তা বাস্তবায়নে ১১টি কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। এই কমিশনের ১৩টি (মূলত ১১টি) সংস্কার প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি এসব প্রস্তাবের বিষয়ে প্রথম সভা হয়।
পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম বলেন, এরইমধ্যে ৭৫ শতাংশ থানা ইউনিটে অনলাইন জিডি কার্যক্রম চালু হয়েছে। সব থানায় পর্যায়ক্রমে অনলাইন জিডি কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) গ্রহণে কোনোরকম অনীহা বা বিলম্ব করা যাবে না, সংস্কার কমিশনের এ প্রস্তাবের ব্যাপারে বলা হয় নির্দেশনা বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়া অনলাইন এফআইআর চালুর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এরইমধ্যে পুলিশ অধিদপ্তর থেকে অনলাইন এফআইআর চালু করার জন্য প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে ফৌজদারি কার্যবিধিতে সংশোধনী প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনলাইন এফআইআরের ফরমেট তৈরির কার্যক্রম চলছে। এ কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে।
ফৌজদারি মামলার তদন্তের জন্য একটি বিশেষায়িত দল গঠন করতে হবে যাদের তদন্ত সংক্রান্ত ইউনিট ও থানা ব্যতীত অন্যত্র বদলি করা যাবে না। ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনা ও তদন্ত একটি ক্যারিয়ার প্ল্যানিংয়ের অধীনে পরিচালিত হতে হবে এবং ফৌজদারি মামলা প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত একটি বিশেষ তদন্ত দল হবে। এ সংস্কার প্রস্তাবের ব্যাপারে বলা হয়, বর্তমানে সিআইডি এবং পিবিআই বিশেষায়িত ইউনিট হিসেবে ফৌজদারি মামলা তদন্ত করছে। সভায় উপস্থিত স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজিপির ভাষ্যমতে, প্রতিটি থানায় মামলা তদন্তের জন্য ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োজিত আছেন। বিদ্যমান কাঠামোতে আলাদা বিশেষায়িত দল গঠন করা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এর জন্য নতুন নিয়োগের প্রয়োজন হবে এবং পৃথক ক্যারিয়ার প্লানিংয়ের প্রয়োজন হবে। তবে বিদ্যমান কাঠামোতে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এমতাবস্থায় এ বিষয়ে আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় যে অন্ততপক্ষে পাইলটভিত্তিক হলেও পৃথক বিশেষায়িত তদন্ত ইউনিট প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা করতে হবে।
বিদ্যমান কাঠামোতে কর্মরতদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। চাকরিপ্রার্থীর বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষা সনদপত্র যাচাই-বাছাই করার দায় দায়িত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তাবে। এগুলো পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হবে না। পুলিশ ভেরিফিকেশনের ক্ষেত্রে চাকরিপ্রার্থীর রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই বাছাইয়ের প্রয়োজনীয়তা বন্ধ করাসহ এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট বিধিমালা সংস্কার করা যেতে পারে। তবে চাকরিপ্রার্থী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা সংক্রান্ত কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে তা ভেরিফিকেশন রিপোর্টে প্রতিফলিত করতে হবে, চাকরির জন্য সব ভেরিফিকেশন সর্বোচ্চ এক মাসের মধ্যে সমাপ্ত করতে হবে এবং অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হলে সর্বোচ্চ ১৫ দিন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সবার মতামতের ভিত্তিতে চাকরিপ্রার্থীর বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষা সনদপত্র ট্রান্সক্রিপ্ট, মার্কশিট যাচাই-বাছাই পুলিশ ভেরিফিকেশনের অংশ হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব সুপারিশে গ্রেফতার তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশনা অবিলম্বে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সুপারিশ করা হয়। অধিকন্তু রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক দায়েরকৃত আপিল বিভাগের পুনঃবিবেচনার আবেদনটি প্রত্যাহার কিংবা দূরত্ব নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করে এর আলোকে প্রয়োজনে ফৌজদারি কার্যবিধিসহ সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি প্রবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয় পুলিশ সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশটি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর (সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স ২০২৫ জারি হয়েছে। আটক ব্যক্তি বা রিমান্ডে নেয়া আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রতিটি থানায় স্বচ্ছ কাচের ঘেরাটোপ দেওয়া একটি আলাদা জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ অবশ্যই থাকবে। নির্মিতব্য/নির্মাণাধীন থানার সময়ে এ ধরনের জিজ্ঞাসা বাদকক্ষ স্থাপন করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অন্যান্য সব থানায় এ ধরনের কক্ষ স্থাপনের সম্ভাব্যতার বিষয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা ক্রমে প্রতিবেদন প্রদান করার জন্য বলা হয়। পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানা ও কোট হেফাজতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং বন্দিদের কোর্ট থেকে আনা নেওয়ার সময় ব্যবহারকারী যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়। পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানা, কোর্ট হাজতের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং বন্দিদের কোর্ট থেকে আনা নেওয়ার ব্যবহৃত যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিচ্ছন্নতায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। নারী আসামিকে যথেষ্ট শালীনতার সঙ্গে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে, এ মর্মে পুলিশ মহাপরিদর্শক সভাকে অবহিত করেন। বিষয়টি অব্যাহত রাখতে হবে এবং এর যেন কোন ব্যত্যয় না ঘটে তা নিশ্চিত করতে হবে বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
তল্লাশির সময় পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে অথবা সার্চ ওয়ারেন্ট না থাকলে জরুরি যোগাযোগের জন্য নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে একটি জরুরি কল সার্ভিস চালু করা যায় বলে প্রস্তাবে বলা হয়। এছাড়া জব্দকৃত মালামালের যথাযথ তালিকা না হলে এবং তল্লাশি কার্যক্রমটি সন্দেহজনক মনে হলে তা তাৎক্ষণিকভাবে জানানোর জন্য মেট্রো এলাকায় ডেপুটি পুলিশ কমিশনার জেলা পুলিশ সুপারের বরাবর জরুরি কল সার্ভিস চালু করা যায় বলে উপস্থাপনায় বলা হয়। পৃথক হেল্পলাইন চালু পরিবর্তে বর্তমানে জাতীয় জরুরি সভা ট্রিপল নাইন এর সক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রস্তাবিত সুপারিশ ট্রিপল নাইনের সংযুক্ত করা যেতে পারে। ট্রিপল নাইনের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এরইমধ্যে একটি প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। অভিযান পরিচালনা করার সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের কাছে জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসহ ভেস্ট পোশাক পরিধান করতে হবে।
বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যগ্রহণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না বলে সুপারিশে উল্লেখ করা হয়।