আজ
|| ২৭শে অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ১১ই কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ || ৪ঠা জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি
ডাকসুতে শিবিরের বিশাল জয়
প্রকাশের তারিখঃ ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
প্রভাত রিপোর্ট: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভিপি, জিএস ও এজিএস এবং ১২টি সম্পাদক পদের মধ্যে ৯টিতে জয় পেয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের’ প্রার্থীরা।
ভিপি (সহসভাপতি) পদে শিবিরের নেতা মো. আবু সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান পেয়েছেন ৫ হাজার ৭০৮ ভোট। এরপর স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম হোসেন পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৮৩ ভোট। স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের উমামা ফাতেমা পেয়েছেন ৩ হাজার ৩৮৯ ভোট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের আবদুল কাদের ১ হাজার ১০৩ ভোট এবং প্রতিরোধ পর্ষদের তাসনিম আফরোজ ইমি পেয়েছেন ৬৮ ভোট।
জিএস (সাধারণ সম্পাদক) পদে বিজয়ী ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি এস এম ফরহাদ পেয়েছেন ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের শেখ তানভীর বারি হামিম পেয়েছেন ৫ হাজার ২৮৩ ভোট। এরপর প্রতিরোধ পর্ষদের প্রার্থী ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মেঘমল্লার বসু পেয়েছেন ৪ হাজার ৯৪৯ ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থী আরাফাত চৌধুরী ৪ হাজার ৪৪ ভোট এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদের আবু বাকের মজুমদার পেয়েছেন ২ হাজার ১৩১ ভোট।
এজিএস (সহসাধারণ সম্পাদক) পদে শিবিরের মুহা. মহিউদ্দিন খান পেয়েছেন ১১ হাজার ৭৭২ ভোট, ছাত্রদলের তানভীর আল হাদী মায়েদ ৫ হাজার ৬৪ ভোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমীদ আল মুদাসসীর পেয়েছেন ৩ হাজার ৮ ভোট। আর প্রতিরোধ পর্ষদের জাবির আহমেদ জুবেল পেয়েছেন ১ হাজার ৫১১ ভোট। এ ছাড়া মহিউদ্দিন রনি ১ হাজার ১৩৭, আশরেফা খাতুন ৯০০, আশিকুর রহমাস জিম ৭৯৬ ও হাসিব আল ইসলাম ৫২০ ভোট পেয়েছেন।
এ ছাড়া ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ফাতেমা তাসনিম জুমা (১০ হাজার ৬৩১ ভোট), বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ইকবাল হায়দার (৭ হাজার ৮৩৩ ভোট), আন্তর্জাতিক সম্পাদক খান জসিম (৯ হাজার ৭০৬ ভোট ), ছাত্র পরিবহন সম্পাদক আসিফ আবদুল্লাহ (৯ হাজার ৬১ ভোট), ক্রীড়া সম্পাদক আরমান হোসাইন (৭ হাজার ২৫৫ ভোট), কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে উম্মে ছালমা (৯ হাজার ৯২০ ভোট), মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক সাখাওয়াত জাকারিয়া (১১ হাজার ৭৪৭), স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে এম এম আল মিনহাজ (৭ হাজার ৩৮ ভোট) এবং ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম (৯ হাজার ৩৪৪ ভোট) বিজয়ী হয়েছেন।
শিবিরের প্যানেলের বাইরে সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবাইর বিন নেছারী (৭ হাজার ৬০৮ ভোট), সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ (৭ হাজার ৭৮২ ভোট) এবং গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বি (১১ হাজার ৭০৮ ভোট) বিজয়ী হয়েছেন।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের প্রকাশ্য রাজনীতির সুযোগ ছিল না। বিভিন্ন আবাসিক হলে শিবির সন্দেহে মারধরের ঘটনা ঘটত প্রায়ই। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে ছাত্রশিবির। প্রকাশ্যে আসার এক বছরের মাথায় ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিশাল জয় পেল তারা।
গত বছর শিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্য কার্যক্রম শুরু করার পর জানা যায়, নেপথ্যে থেকে জুলাই অভ্যুত্থানের সময় বিভিন্ন কর্মসূচি নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন সাদিক কায়েম। তিনি যে শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি, সেটিও তখন সামনে আসে। এখন অবশ্য তিনি সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রকাশনা সম্পাদক।
নির্বাচন প্রত্যাখ্যান
গতকাল মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ডাকসুর ভোট গ্রহণ হয়। এর পর থেকে ভোটগণনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কেন্দ্রভিত্তিক ফল ঘোষণা শুরু হয় মঙ্গলবার দিবাগত রাত দেড়টায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে ডাকসুর পূর্ণাঙ্গ ফল ঘোষণা করা হয় বুধবার সকাল সাড়ে আটটায়।
তবে ডাকসু নির্বাচনের এই ফল প্রত্যাখ্যান করেছেন ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী উমামা ফাতেমা। ভোট গণনা চলার মধ্যে গতকাল দিবাগত রাত সোয়া দুইটার পর এক ফেসবুক পোস্টে আবিদ লেখেন, ‘পরিকল্পিত কারচুপির এই ফলাফল দুপুরের পরপরই অনুমান করেছি। নিজেদের মতো করে সংখ্যা বসিয়ে নিন। এই পরিকল্পিত প্রহসন প্রত্যাখ্যান করলাম।’
এর ঘণ্টাখানেক পর এক ফেসবুক পোস্টে ডাকসু বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন উমামা ফাতেমা। তিনি লেখেন, ‘বয়কট! বয়কট! ডাকসু বর্জন করলাম।’ ডাকসু নির্বাচনকে ‘সম্পূর্ণ নির্লজ্জ কারচুপির নির্বাচন’ আখ্যায়িত করে উমামা ফাতেমা লেখেন, ‘৫ আগস্টের পরে জাতিকে লজ্জা উপহার দিল ঢাবি প্রশাসন। শিবির পালিত প্রশাসন।’
ছাত্রদলের প্যানেলের জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিমও নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেছেন। রাতে এক ফেবসুক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি মনে করেন—এটিই তাঁদের রায়, তবে এই রায়কে আমি সম্মান জানাই। আমি শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষমাণ।’ তিনি আরও লেখেন, ‘আজকে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চলা এ ভোটানুষ্ঠানে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও কয়েকটি কেন্দ্রে অনিয়ম দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে গণনার ক্ষেত্রে মেশিনের ত্রুটি, জালিয়াতি ও কারচুপি পরিলক্ষিত হয়েছে।’
শান্তিপূর্ণ ভোট শেষে কারচুপির অভিযোগ
এবার ডাকসু নির্বাচনে ১০টি প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। স্বতন্ত্রভাবেও অনেকে নির্বাচন করেন। ডাকসুর ২৮ পদে সব মিলিয়ে প্রার্থী ছিলেন ৪৭১ জন। আর ১৮টি হল সংসদের ২৩৪টি পদে প্রার্থী হন ১ হাজার ৩৫ জন। গত ২৬ আগস্ট থেকে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নির্বাচনী প্রচারে নানা প্রতিশ্রুতি দেন প্রার্থীরা। সবার প্রতিশ্রুতিতেই ক্যাম্পাসে আধিপত্য ও দখলদারির রাজনীতির বিলোপ এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিষয়টি ছিল।
গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্যাম্পাসের বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবনে স্থাপিত আটটি কেন্দ্রে ভোট দেন শিক্ষার্থীরা। উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে প্রাথমিক হিসাবে ৭৮ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে। গতকাল সকাল আটটা থেকেই ভোটকেন্দ্রগুলোর সামনে ছিল ভোটারদের দীর্ঘ সারি। অনেকে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থেকে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। ভোটের লাইনে ছাত্রীদেরও ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যায়। অনাবাসিক শিক্ষার্থীদেরও বিপুল উৎসাহে ভোটকেন্দ্রে আসতে দেখা যায়।
অবশ্য গতকাল বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্যানেলের ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থীরা আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করতে থাকেন। কেউ কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষপাত থাকার অভিযোগও করেন।
ভোট গণনায় কারচুপির অভিযোগ তুলে সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে টিএসসি কেন্দ্রের সামনে অবস্থান নেন কয়েকটি প্যানেলের প্রার্থীরা। ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থীর নেতৃত্বে উত্তেজনা শুরু হলেও পরে তাঁর সঙ্গে স্বতন্ত্র এজিএস প্রার্থী হাসিবুল ইসলাম যোগ দেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, তাঁরা গণনা দেখতে ভেতরে যেতে চাইলেও প্রশাসন বাধা দিয়েছে।
আধা ঘণ্টার মতো টিএসসিতে অবস্থানের পর তাঁরা সিনেট ভবনের দিকে যান। এ সময় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ‘ভোট চোর, ভোট চোর, জামায়াত-শিবির ভোট চোর’ বলে স্লোগান দেন। এ ঘটনার সময় টিএসসি কেন্দ্রের সামনে থাকা এলইডি স্ক্রিন কিছু সময় বন্ধ থাকার পর রাত পৌনে আটটার দিকে আবার চালু হয়।
রাত আটটার দিকে ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের সামনে ছাত্রদল ও শিবিরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হট্টগোল হয়। এরপর বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে গিয়ে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা ‘ভোট চোর’ বলে স্লোগান দেন।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ভিপি প্রার্থী আবদুল কাদের রাতে টিএসসিতে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পক্ষপাত করেছে।
শান্তিপূর্ণভাবে এই নির্বাচন হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। আজ সকালে ডাকসুর ফল ঘোষণার সময় তিনি বলেন, ‘এই ডাকসুর মাধ্যমে আমরা একটা সুন্দর একটা মডেল সেট করতে পেরেছি। যেটা বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ বড় বড় কলেজ আমাদেরকে অনুসরণ করবে আমরা আশা রাখি।’
Copyright © 2025 প্রভাত. All rights reserved.