প্রভাত ডেস্ক: জনতার পেটে ভাত নেই, নেতা-মন্ত্রীদের সন্তানদের হাতে গুচির ব্যাগ, দামি গাড়ি! নেপালের বিক্ষোভে কতটা দায়ী ‘নেপো কিড’রা? নেপালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গণবিক্ষোভে। সাধারণ নেপালিরা যখন বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং গভীর দারিদ্রের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে বেঁচে রয়েছেন, তখন রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানেরা সমাজমাধ্যমে বিলাসবহুল গাড়ি,গুচির ডিজাইনার ব্যাগ এবং বিলাসী ছুটি কাটানোর নানা ছবি প্রকাশ করে চলেছেন।
এছাড়াও সমাজমাধ্যমের উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা। পুঞ্জীভূত অসন্তোষের বারুদের উপর বসে থাকা নেপালের জন্য এই স্ফুলিঙ্গটুকুই যথেষ্ট ছিল। গণবিক্ষোভের জেরে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউএমএল) এবং নেপালি কংগ্রেসের জোট সরকারের পতনের সাক্ষী রইল গোটা বিশ্ব। সূত্র : আনন্দবাজার
দীর্ঘ দিনের চাপা রোষ ফুটে বেরিয়ে যে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেই আগুনে পুড়ে যায় দেশের পার্লামেন্ট, সরকারি ভবন, প্রধানমন্ত্রী-সহ রাজনীতিবিদদের ব্যক্তিগত বাসভবনও। হাজার হাজার ছাত্র-যুব নেপালের পার্লামেন্টের বাইরে জড়ো হয়েছিলেন। বিক্ষোভ আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি চালায়। মৃত্যু হয় ১৯ জনের।
শুধু সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞাই নয়, জেন জ়ির বিক্ষোভের নেপথ্যে আরও অনেক চাপা অসন্তোষ রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। মূলধারার দলগুলির বিরুদ্ধে ক্ষোভের অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছিল ধারাবাহিক দুর্নীতির অভিযোগ। আর তাতে ইন্ধন জুগিয়েছে নেপালের সদ্য ক্ষমতাহারানো রাজনৈতিক দলগুলির নেতা-মন্ত্রীদের সন্তানদের বিলাসবহুল ও অমিতব্যয়ী জীবনযাপন।
নেপালে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গণবিক্ষোভে। সাধারণ নেপালিরা যখন বেকারত্ব, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং গভীর দারিদ্রের সঙ্গে ক্রমাগত লড়াই করে বেঁচে রয়েছেন, তখন রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানেরা সমাজমাধ্যমে বিলাসবহুল গাড়ি, ডিজ়াইনার ব্যাগ এবং বিলাসী ছুটি কাটানোর নানা ছবি প্রকাশ করে চলেছেন।
আন্দোলন চলাকালীন বিক্ষুব্ধ প্রজন্ম বিভিন্ন পোস্টারে তাঁদের প্রতিবাদের লেখা তুলে ধরেছেন। কেবল ফেসবুকের উপর বিধিনিষেধ আরোপের কারণেই নয়, নেপালের ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য, সরকারি স্তরে দুর্নীতি এবং স্বজনপোষণের কারণেও ক্ষুব্ধ সে দেশে ছাত্র-যুবদের একাংশ। রেডিট-সহ একাধিক পোস্টে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন নেপালের তরুণ-তরুণীরা।
আন্দোলনের সময় যুবকের হাতে লেখা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘‘নেতাদের সন্তানেরা গুচি ব্যাগ নিয়ে বিদেশ থেকে ফিরে আসে, আমাদের সন্তানেরা ফেরে কফিনে।’’ অনেক নেপালি তরুণ অর্থের জন্য ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ভাড়াটে সৈনিক হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে অনেকের দেহই কফিনবন্দি হয়ে ফিরে আসে।
নেতামন্ত্রীদের সন্তানদের ‘নেপো-কিড’ বলে উল্লেখ করে পোস্টে অভিযোগ তোলা হয়, তাঁরা জনসাধারণের টাকায় বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন এবং পরিশ্রম ছাড়াই সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। অভিযোগ, এঁদের কেউ ‘মিস নেপাল’-এর মতো খেতাব জিতেছেন, তো কেউ চেম্বার অফ কমার্সের নির্বাচনে বিনা বাধায় জয় পেয়েছেন।
২৯ বছর বয়সি প্রাক্তন ‘মিস নেপাল’ এবং প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিরোধ খাতিওয়াদার কন্যা শৃঙ্খলা খাতিওয়াদাকে সমাজমাধ্যমে নিশানা করে তরুণ প্রজন্ম। অনেকের মতে, প্রতিভার জন্য নয়, তাঁর বাবা নেপালের মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে প্রভাব খাটিয়ে খেতাবটি হস্তগত করেছেন।
শৃঙ্খলা সমাজমাধ্যমে প্রায়ই তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ছবি ও ভিডিয়ো পোস্ট করতেন। প্রায়ই বিদেশে ছুটি কাটাতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। জেন জ়ি আন্দোলনের সময় তিনি তাঁর ইনস্টাগ্রাম থেকে এক লক্ষ অনুগামী হারিয়েছেন। জীবনযাত্রা ও পদের জন্য নেপালি তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভের নিশানায় তিনি। বিক্ষোভের সময় আগুনে পুড়ে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে তার পারিবারিক বাড়িও ছিল।
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির প্রাক্তনী শৃঙ্খলা পেশায় স্থপতি। ২০১৮ সালে ওই প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার পর তিনি এক জন মডেল হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। ইনস্টাগ্রাম ছাড়াও তাঁর একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে যেখানে তিনি তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে বিভিন্ন ভিডিয়ো শেয়ার করে থাকেন। সেই ভিডিয়োতেও স্বাভাবিক ভাবে তাঁর অভিজাত ও বিলাসী জীবনযাত্রার ঝলক ফুটে ওঠে। তাতেই সাধারণ নেপালি জনগণের সঙ্গে তাঁদের জীবনযাত্রার ফারাকটা স্পষ্ট হয়েছে।
জনপ্রিয় নেপালি গায়িকা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার পুত্রবধূ শিবানা শ্রেষ্ঠাও সমাজমাধ্যমে আক্রমণের লক্ষ্য ছিলেন। প্রায়শই বিলাসবহুল বাড়ি এবং ব্যয়বহুল ফ্যাশনের ভিডিয়ো পোস্ট করেন তিনি। তিনি এবং তাঁর স্বামী জয়বীর সিংহ দেউবা কোটি কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক বলে অভিযোগ তুলেছেন নেটাগরিকেরা।
বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও অনলাইনে বৈভবের ছবি বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই সমালোচনার ঝড় আছড়ে পড়ে নেপাল জুড়ে। সেই সমস্ত ভাইরাল ভিডিয়োগুলিতে ডিজ়াইনার পোশাক এবং বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার ছবির সঙ্গে সাধারণ নেপালিদের সংগ্রামের তুলনা টানা হয়েছে।
শিবানার দাদু কেদার ভক্ত শ্রেষ্ঠা ছিলেন নেপালের প্রাক্তন বিদেশ সচিব এবং রাষ্ট্রদূত। গান গাওয়ার পাশাপাশি শিবানা একটি প্রসাধনী পণ্যের ব্যবসাও পরিচালনা করেন। তাঁরও ইউটিউবে নিজস্ব একটি চ্যানেল রয়েছে। ব্যাপক অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং দুর্নীতির মধ্যে এই ধরনের বিলাসী জীবনের ভিডিয়ো ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ও অনলাইনে বৈভবের ছবি বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই সমালোচনার ঝড় আছড়ে পড়ে নেপাল জুড়ে। সেই সমস্ত ভাইরাল ভিডিয়োয় ডিজ়াইনার পোশাক এবং বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার ছবির সঙ্গে সাধারণ নেপালিদের সংগ্রামের তুলনা টানা হয়েছে।
নেপালের সাধারণ নাগরিক যখন চাকরির জন্য লড়াই করছিলেন, তখন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল ওরফে প্রচণ্ডের নাতনি স্মিতা দহল লক্ষ লক্ষ টাকার গুচি হ্যান্ডব্যাগ প্রদর্শনের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচিত হয়েছিলেন।
প্রচণ্ডের পরিবারের এই সদস্যকেও ‘নেপো কিড’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। এটাই সবচেয়ে আশ্চর্যের। কারণ প্রচণ্ড নিজে এক জন মাওবাদী নেতা। নেপালে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকার কথা স্বীকার করেন প্রত্যেকেই। ছাত্র-যুব ক্ষোভ থেকেও রেহাই পায়নি তাঁর বাড়িও। মঙ্গলবার নেপালের ললিতপুর জেলার খুমলতারে প্রচণ্ডের বাসভবনে চড়াও হন বিক্ষোভকারীরা। ভাঙচুর করা হয় তাঁর বাড়ি।
প্রাক্তন আইনমন্ত্রী বিন্দুকুমার থাপার ছেলে সৌগত থাপাকে অপব্যয়ের প্রতীক হিসাবে চিহ্নিত করেছেন বিক্ষোভকারীরা। তিনি চেম্বার অফ কর্মাসের উচ্চ পদে রয়েছেন। সমাজমাধ্যমে তাঁর জীবনযাত্রা নিয়ে ব্যাপক চর্চা হয়। বিক্ষোভকারীরা বলেছেন যে, সাধারণ মানুষ যখন দারিদ্রের শিকার, তখন এই মন্ত্রীপুত্র লাখ লাখ টাকার পোশাক পরে অনলাইনে প্রদর্শন করেন।
নেপালি নেটাগরিকদের দাবি, সৌগতকে বছরের অধিকাংশ সময়ে দেশের বদলে বিদেশে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সেখানে দামি গাড়ি চালিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করেন তিনি। যদিও তাঁর বাবা এক জন রাজনীতিবিদ ছিলেন, শিল্পপতি ছিলেন না। অনেকেরই দাবি, চেম্বার অফ কমার্সের দায়িত্ব দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতার অভাব রয়েছে সৌগত থাপার। কেবলমাত্র রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সেটি অধিকার করে বসে আছেন তিনি।
সব ছবি: সংগৃহীত।