প্রভাত রিপোর্ট: বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ। বাঙালির সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও উৎসবের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে এই মাছের নাম। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে ইলিশ সাধারণ মানুষের কাছে নাগালের বাইরে চলে গেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে বড় আকারের এক কেজি ইলিশ কিনতে খরচ হচ্ছে ২,২০০ থেকে ২,৫০০ টাকা। অনলাইনে প্রিমিয়াম ইলিশের দাম ছুঁয়েছে ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ টাকা। অথচ মাত্র চার বছর আগেও ২০২১ সালে পাইকারি বাজারে এক কেজি ইলিশ পাওয়া যেত ৫৫০ টাকায়।
প্রশ্ন উঠছে কোন শক্তি ইলিশকে এমন বিলাসবহুল পণ্যে পরিণত করল? উৎপাদন খরচ যেখানে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা কেজি, সেখানে ভোক্তাকে কেন দিতে হচ্ছে আড়াই হাজার টাকা?
জানা গেছে, জেলেদের অভিজ্ঞতায় ইলিশ ধরতে সবচেয়ে বড় খরচ হয় জ্বালানি ও শ্রমে। একটি মাঝারি ট্রলার সাধারণত ১০ দিনের জন্য নদীতে যায়। ধরা যাক ট্রলারে শ্রমিক আছে ১০ জন। প্রত্যেকের দৈনিক মজুরি ১,০০০ টাকা। ফলে শ্রম খরচ দাঁড়ায় ১,০০,০০০ টাকা। একই সময়ে ট্রলার দিনে গড়ে ১৫০ লিটার ডিজেল খরচ করে। ১০ দিনে লাগে প্রায় ১,৫০০ লিটার। প্রতি লিটার ১১০ টাকা দরে খরচ হয় ১,৬৫,০০০ টাকা। বরফ, খাবার, রসদ, জাল মেরামত ও অন্যান্য খরচ যোগ করলে পুরো অভিযানের ব্যয় দাঁড়ায় আনুমানিক ৪,১০,০০০ টাকা। একটি অভিযানে গড়ে ধরা হয় প্রায় ১০ টন বা ১০,০০০ কেজি মাছ। সে হিসেবে প্রতি কেজি ইলিশের উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় ৪১-৫০ টাকা। তবে সব সময় মাছ মেলে না। অনেক সময় ট্রলার খালি হাতে ফিরে আসে। সেই ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়ায় ৮০-১০০ টাকা প্রতি কেজি। অর্থাৎ ঘাটে পৌঁছানো পর্যন্ত উৎপাদন খরচ সর্বোচ্চ ১০০ টাকা হলেও পাইকারি বাজারে একই মাছ বিক্রি হয় ১,৬০০-১,৮০০ টাকায়, আর খুচরা বাজারে পৌঁছাতে গিয়ে দাম দাঁড়ায় ২,২০০-২,৫০০ টাকা।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে: ২০২১-২২ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৫,৬৫,০০০ টন। ২০২২-২৩ সালে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৫,৭১,৩৪২ টন, যা রেকর্ড হিসেবে গণ্য হয়। ২০২৩-২৪ সালে উৎপাদন হঠাৎ কমে দাঁড়ায় প্রায় ৫,২৯,০০০ টনেÍপ্রায় ৪২,০০০ টন হ্রাস। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পূর্ণাঙ্গ তথ্য এখনও প্রকাশিত হয়নি। অর্থাৎ উৎপাদন সামান্য ওঠানামা করেছে, কিন্তু বাজারে দামের ঊর্ধ্বগতি হয়েছে রকেটের গতিতে।
২০২১ সালে ৫৫০, এখন ২,৫০০
২০২১ সালে পাইকারি বাজারে ১ কেজি ইলিশের দাম ছিল মাত্র ৫৫০ টাকা, খুচরায় ৭০০-৮০০ টাকা। ২০২৫ সালে পাইকারি দরে দাঁড়িয়েছে ১,৬০০-১,৮০০, আর খুচরায় ২,২০০-২,৫০০ টাকা।
এই চার বছরে ইলিশের দাম প্রায় চারগুণ বেড়ে গেছে। অথচ উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ ধরলেও প্রতি কেজিতে ১০০ টাকার বেশি হয় না।
অবৈধ রপ্তানি ও পাচার
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অবৈধ রপ্তানি ইলিশের বাজারকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কন্টেইনারভর্তি ফ্রোজেন ফিশ চালানে প্রায় ৭০ শতাংশ ঘোষিত মাছ থাকে, বাকি ৩০ শতাংশ থাকে ইলিশ। কাগজে কলমে থাকে রুই বা পাঙাশ, বাস্তবে বিদেশে পৌঁছে যায় ইলিশ। এছাড়া নৌপথে রাতের আঁধারে ট্রলার ও স্পিডবোটে পশ্চিমবঙ্গে পাচার হয়। স্থলপথে বেনাপোল, আখাউড়া ও হিলি সীমান্ত দিয়ে সবজির চালানের আড়ালে ইলিশ পাঠানো হয়। সীমান্তবর্তী হাটবাজারে সরাসরি ভারতীয় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। এমনকি প্রবাসীদের লাগেজ বা কুরিয়ারের মাধ্যমেও নিয়মিত ইলিশ বিদেশে যাচ্ছে।
ফলে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ কমে যায়, আর দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
কোল্ড স্টোরেজে মজুত
বড় ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শুরুতে প্রচুর মাছ কিনে কোল্ড স্টোরেজে রাখেন। বাজারে সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। পরে যখন মাছের জোগান কমে, তখন সেই মাছ দ্বিগুণ দামে ছাড়েন।
এ কারণে মৌসুমেও বাজারে ইলিশের দাম কমে না।
জনগণের ভোগান্তি
ঢাকার এক গৃহবধূ বলেন, “ইলিশ খাওয়াটা এখন স্বপ্ন। আগে ঈদে বা পূজায় দু’টো মাছ কিনতাম, এখন একটা কিনতেই কয়েক হাজার টাকা লাগে।”
ভোলা জেলার এক জেলে বলেন, “আমরা সারারাত নদীতে মাছ ধরি, কিন্তু শহরে গিয়ে দেখি আমাদের ধরা মাছ চারগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে। লাভ পাচ্ছে সিন্ডিকেট, আমরা না।”
জনগণের হাতে সমাধান?
অর্থনীতির মৌলিক নিয়ম হলো, চাহিদা কমলে দামও কমে। কয়েক বছর আগে তরমুজ বর্জনের আন্দোলনে মাত্র দুই সপ্তাহেই দাম অর্ধেক নেমে এসেছিল। অনেকে মনে করছেন, ইলিশ বর্জন করলে সিন্ডিকেটের গুদামে মাছ আটকে যাবে, তারা বাধ্য হবেন দাম কমাতে। তবে এজন্য সংগঠিত প্রচারণা ও দীর্ঘমেয়াদী সচেতনতা প্রয়োজন।
করণীয়
১. প্রতিটি ফ্রোজেন ফিশ কন্টেইনার স্ক্যান বাধ্যতামূলক করা।
২. কোল্ড স্টোরেজে মজুতের সঠিক হিসাব রাখা, ২৫ দিনের মধ্যে সকল ইলিশ বিক্রি তে বাধ্য করা ।
৩. দেশীয় বাজারে যোগান নিশ্চিত না করে রপ্তানি বন্ধ রাখা।
৪. সীমান্তে নজরদারি জোরদার করা। জাপানি ইলিশ নামে অবৈধ ইলিশ রপ্তানি আটকানো ।
৫. জনগণকে অযৌক্তিক দামে ইলিশ না কিনতে উদ্বুদ্ধ করা।
ইলিশের উৎপাদন খরচ যেখানে মাত্র ১০০ টাকা, সেখানে চার বছরে দাম ৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে ২,৫০০ টাকা হওয়া কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়। এই অস্বাভাবিকতা তৈরি করেছে অবৈধ রপ্তানি, কোল্ড স্টোরেজ সিন্ডিকেট ও বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা।
সরকার যদি কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং জনগণ সচেতনভাবে অতিরিক্ত দামে ইলিশ না কেনে, তবে জাতীয় মাছ আবারও সাধারণ মানুষের টেবিলে ফিরতে পারে। নইলে ইলিশ থেকে যাবে শুধু স্মৃতির গল্পে, বাস্তব জীবনে নয়।