প্রভাত রিপোর্ট: ঢাকার সাতটি বড় সরকারি কলেজ একীভূত করে সরকার যে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করতে যাচ্ছে, তার কাঠামো মানবেন না ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীরা। প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশের যে খসড়া প্রকাশ করেছে সেটি প্রত্যাখ্যান করেছেন তাঁরা। ছাত্রীরা হুমকি দিয়েছেন বাস্তবসম্মত সমাধান না হলে রাজপথে আন্দোলনে নামবেন। তাঁরা চান এ ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি মডেল অনুসরণ করা হোক। যেখানে সব কলেজের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে এবং প্রতিটি বিভাগে অন্তত ১৬ জন শিক্ষক ও গবেষণা বাজেট থাকবে।
সোমবার দুপুরে রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ প্রাঙ্গণে কলেজের কিছুসংখ্যক ছাত্রী সংবাদ সম্মেলন করে খসড়া প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। তাঁদের দাবি ইডেন কলেজের ৯০ শতাংশ ছাত্রী প্রস্তাবিত কাঠামোয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় চান না।
ঢাকার সাতটি বড় সরকারি কলেজ ঘিরে সম্প্রতি নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে। সরকারি এই কলেজগুলো হলোÍঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা মহিলা কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বাঙলা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ।
এসব কলেজ একীভূত করে সরকার যে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় করতে যাচ্ছে, তার কাঠামো নিয়ে ওই সব কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন। শিক্ষকেরা মনে করেন, প্রস্তাবিত কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষা ও নারী শিক্ষার সংকোচন এবং কলেজের স্বতন্ত্র কাঠামো ও ঐতিহ্য বিলুপ্ত হবে। এমনকি বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের পদও বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়বে। তাঁরা বলছেন, সাত কলেজের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় হোক, সেটির বিপক্ষে তাঁরাও নন। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস অবশ্যই পৃথক স্থানে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এসব কলেজের মধ্যে বর্তমানে ইডেন ও তিতুমীরে শুধু স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। বাকি পাঁচটি কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিকও পড়ানো হয়। এসব কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রস্তাবিত কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় হলে উচ্চমাধ্যমিক স্তর অস্তিত্বসংকটে পড়বে। এ নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীরাও আন্দোলন করবেন। অন্যদিকে দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে আগে থেকে আন্দোলন করে আসছেন কলেজগুলোর স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী।
এরই মধ্যে ২৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করতে অধ্যাদেশের খসড়া প্রকাশ করেছে। প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’। সাতটি কলেজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ কেন্দ্র (একাডেমিক ক্যাম্পাস)। একেক ক্যাম্পাসে আলাদা আলাদা বিষয়ে (ডিসিপ্লিন) পড়ানো হবে। বিষয়ও কমে যাবে। এই খসড়া প্রকাশের পর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের অনেক শিক্ষার্থীও এখন প্রস্তাবিত কাঠামোর বিপক্ষে। বিশেষ করে ইডেন মহিলা কলেজ ও বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের মধ্যে বেশি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা এর ফলে তাঁদের কলেজে নারী শিক্ষা সংকোচন হবে এবং সেখানে সহশিক্ষা চালু হলে নানামুখী সমস্যার তৈরি হবে। তাঁদের ভাষ্য সাত কলেজের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হোক তাতে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু সেটি প্রস্তাবিত কাঠামোয় নয়।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রীরা বলেছেন, সময়োপযোগী, টেকসই ও গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ প্রণয়নের জন্য একটি নতুন শিক্ষা কমিশন বা পর্যালোচনা কমিটি গঠন করতে হবে। ইডেন কলেজে সহশিক্ষা (ছেলে-মেয়েসহ যেখানে পড়ানো হয়) কার্যক্রম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।
ইডেন কলেজের ছাত্রীদের পক্ষ থেকে আয়োজিত আজকের সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনার বাংলা বিভাগের ছাত্রী মরিয়ম। লিখিত বক্তব্যে সাত কলেজের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটির কার্য পরিধির তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়, সাত কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বাতিল করে স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ কাঠামো প্রস্তাব করা এবং সব অংশীজনদের সম্পৃক্ত করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং কমিটির সদস্যরা কার্যপরিধির বাইরে গিয়ে বাস্তবতা বিবর্জিত একটি হাইব্রিড মডেল দাঁড় করিয়েছেন। ফলে তাঁদের প্রশ্ন জাতে কার স্বার্থে এ পরীক্ষামূলক মডেল চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এর পেছনে কারা? বেসরকারি কলেজে নাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়?
সাত কলেজের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় করতে অধ্যাদেশের খসড়াকে উদ্দেশ্যে প্রণোদিত উল্লেখ করে সেটি প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেওয়া হয় সংবাদ সম্মেলনে। ছাত্রীরা বলেছেন, এ অধ্যাদেশের খসড়া অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। সময়োপযোগী, টেকসই ও গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ প্রণয়নের জন্য একটি নতুন শিক্ষা কমিশন বা পর্যালোচনা কমিটি গঠন করতে হবে। ইডেন কলেজে সহশিক্ষা (ছেলে-মেয়েসহ যেখানে পড়ানো হয়) কার্যক্রম কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, সাত কলেজে কোনো পরীক্ষামূলক বিশ্ববিদ্যালয় মডেল চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। তাঁরা চান সাত কলেজের জন্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি মডেল অনুসরণ করা হোক। যেখানে সব কলেজের স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকবে এবং প্রতিটি বিভাগে অন্তত ১৬ জন শিক্ষক ও গবেষণা বাজেট থাকবে। এ ছাড়া নিজ নিজ কলেজে চূড়ান্ত পরীক্ষা গ্রহণ করা হবে, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন থেকে ফলাফল প্রকাশ সবক্ষেত্রে বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এ ছাড়া পর্যাপ্ত পরিবহন, লাইব্রেরি, ল্যাব, আবাসন সুবিধা, উন্নত খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ফ্রি ওয়াইফাই ইত্যাদি ব্যবস্থা থাকবে। আর কলেজের সম্পত্তি কলেজের নামেই থাকতে হবে। প্রস্তাবিত কাঠামোয় নারী শিক্ষার সংকোচনের ইঙ্গিত স্পষ্ট উল্লেখ করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় এটি অন্যায্য।
সংবাদ সম্মেলনে মরিয়ম বলেন, ‘আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি সকল অংশীজনের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত না করে চূড়ান্ত অধ্যাদেশ জারি করা হলে সাত কলেজের সমস্যার সমাধান হবে না। বরং জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। আমরা চাই আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হোক, আমরা কোনো অরাজকতা চাই না। খসড়া অধ্যাদেশ অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করুন। নতুন শিক্ষা কমিশন বা পর্যালোচনা কমিটি গঠন করে বাস্তবসম্মত সমাধানের পদক্ষেপ নিন। আমাদের রাজপথে ঠেলে দেবেন না।’