• বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০১:১২ অপরাহ্ন

আরিয়ান খানের প্রথম সিরিজ ‘দ্য ব্যা***ডস অব বলিউড’ নিয়ে এখনো উন্মাদনা

প্রভাত রিপোর্ট / ৩৮ বার
আপডেট : শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫

প্রভাত বিনোদন : বলিউড সিনেমা মানেই প্রেম, ধুন্ধুমার অ্যাকশন আর একজন আবশ্যিক পথের কাঁটা ভিলেন—মোটাদাগে বলিউডের জনপ্রিয়তা পাওয়া বাণিজ্যিক সিনেমার ফর্মুলা এটাই। এই ফর্মুলা মেনেই পরিচালক হিসেবে শুরু করেছেন আরিয়ান খান। তবে প্রচলিত ফর্মুলা মেনে সিরিজটি বানালেও নিজের প্রথম কাজেই মাত করেছেন আরিয়ান। আলোচনা যেমন হচ্ছে, তেমনি সমালোচনার তিরও বিদ্ধ করছে তাঁকে। তবে আলোচনা হোক, কিংবা সমালোচনা, আরিয়ান খানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সবাই। কী আছে এই ‘দ্য ব্যা***ডস অব বলিউড’ সিরিজটিতে?
প্রথমে নাম দিলেই সবার নজর কেড়েছিল ‘ব্যা***ডস অব বলিউড’। ‘ব্যা***ডস’–এর আড়ালের ‘বাসটার্ড’ শব্দটিই জানান দিচ্ছিল প্রথাভাঙা, সাহসী কিছু নিয়ে আসতে চলেছেন আরিয়ান। ‘দ্য ব্যা***ডস অব বলিউড’ সিরিজটি মূলত ঝাঁ–চকচকে বলিউডের আড়ালের গল্প বলতে চেয়েছেন তিনি। তারকারা, তাঁদের সন্তান, ক্ষমতার রাজনীতি, নেপোটিজম, মাফিয়া চক্র, মিডিয়ার ভূমিকা; সবকিছুর একটা অংশ উঠে এসেছে এ সিরিজে। তবে প্রথমদিকে গল্প যতটা মজার ছলে এগোচ্ছিল, শেষ দিকে ‘অন্য বাস্তবতা’ দেখাতে গিয়ে গল্প একটু ক্লিশে হয়ে যায়।
মুক্তি পাওয়ার পর পেরিয়ে গেছে এক মাসের বেশি সময়। এখনো নেটফ্লিক্স বাংলাদেশের টপচার্টে রাজত্ব করছে সিরিজটি। আরিয়ান খানের প্রথম সিরিজ নিয়ে এখনো চলছে উন্মাদনা, অভিনয়শিল্পীরা একের পর এক পডকাস্টে আসছেন, দিচ্ছেন সাক্ষাৎকার। সিরিজটি নিয়ে এখনো হচ্ছে নানা ধরনের খবর। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া কোনো ভারতীয় সিরিজ নিয়ে সাম্প্রতিককালে এত আলোচনা, সমালোচনা হয়নি নেপোকিডের তকমা ঝেড়ে পুরোদস্তুর পরিচালক হিসেবে নিজের জাত চিনিয়েছেন আরিয়ান খান। কথা হচ্ছিল, শাহরুখ খানের পুত্র আরিয়ান খান পরিচালিত সিরিজ ‘দ্য ব্যা**ডস অব বলিউড’ নিয়ে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় সিরিজটি।


‘দ্য ব্যা**ডস অব বলিউড’–এর পোস্টার থেকে। আইএমডিবি

‘দ্য ব্যা***ডস অব বলিউড’-এর গল্পে আসা যাক। আসমান সিং (লক্ষ‍্য লালওয়ানি) এক উঠতি নায়ক, বলিউডে নবাগত। ‘রিভলবার’ নামের প্রথম সিনেমাতেই মাত করেন তিনি। অন্যদিকে, বলিউড রাজত্ব করে বেড়ানো বর্ষীয়ান অভিনেতা অজয় তলওয়ার (ববি দেওল) প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁর একমাত্র মেয়ে কারিশমার (সাহের বাম্বা) বলিউডে অভিষেক হতে যাচ্ছে করণ জোহরের হাত ধরে। কারিশমার বিপরীতে অভিনয়ের জন্য করণ জোহরের পছন্দ আসমানকে। কিন্তু নিজের মেয়ের প্রথম সিনেমায় এই চাল-চুলোহীন নবাগতকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না অজয়। অন্যদিকে প্রযোজক ফ্রেডি সোডাওয়ালা (মনিশ চৌধুরী) নিজের স্টুডিও টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে নামেন। আর পর্দার আড়ালে চলতে থাকে নানান ষড়যন্ত্র।
সোশ্যাল মিডিয়ার আগের যুগে, বলিউডকে নিয়ে বলিউডের সিনেমা মানে ছিল সিনেমা তৈরির গল্প। যেমন ফারাহ খানের ‘ওম শান্তি ওম’ বা জোয়া আখতারের ‘লাক বাই চান্স’। এই সিনেমাগুলো ইন্ডাস্ট্রির রঙিন মানুষ, সেটের মজার সব গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল যুগে চিত্রটা পাল্টেছে। এখন বলিউডের এই ঘরানার গল্পগুলো তৈরি হয় দর্শকের ধারণা, গসিপ, কৌতূহল ও তারকাদের নিয়ে গুঞ্জন থেকে। সমস্যা হলো, স্রেফ নিজেদের বিদ্রূপ করে সাত পর্বজুড়ে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন। সে কারণেই আগে ‘দ্য ফেম গেম’ বা ‘শোটাইম’-এর মতো সিরিজগুলো জমেনি। আরিয়ান খানের প্রথম সিরিজটি আত্ম-বিদ্রূপের মধ্য দিয়েই যেন নিজের উত্তর খোঁজে। মাঝেমধ্যে এই মজার ভেতর ফুটে ওঠে ব্যথা, তীব্রতা। এক পর্ব শেষে যখন পর্দায় মাদকবিরোধী স্লোগান দেখা যায়, তখনই আসে টাইটেল কার্ড—ডিরেক্টটেড বাই আরিয়ান খান। এক এনসিবি অফিসারকে দেখে মনে হয় বাস্তবের সামির ওয়াংখেড়ে; যিনি বাস্তবে আরিয়ানকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। নিজের প্রথম কাজেই সেই ঘটনার বলা যায় মধুর প্রতিশোধ নিলেন আরিয়ান।


‘দ্য ব্যা**ডস অব বলিউড’–এর পোস্টার থেকে। আইএমডিবি

‘দ্য ব্যা***ডস অব বলিউড’-এ মজার আড়ালে আছে হিন্দি সিনেমার ভেতরের অন্ধকারও। যেখানে এক বাবা মেয়েকে ঘরে বন্দী করে রাখে, প্রযোজক মারধর করে, ‘মি টু’ নিয়ে নোংরা মজা করে। বলিউডের গ্ল্যামারের ভেতর যে পচন, সেই ক্ষতটা এখানে খোলামেলাভাবে দেখানো হয়েছে। সিরিজজুড়ে নব্বইয়ের অনেক সিনেমা, নির্মাতাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়েছে। যখনই মনে হচ্ছিল সিরিজটি আদতে মজা আর নস্টালজিয়ার মিশেল, তখনই সুর উল্টো যায়, মনে হয় হিন্দি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে চপেটাঘাত করতেই এটা বানিয়েছেন আরিয়ান। বোঝা যায়, এখানে কেউ সিনেমা বানাচ্ছে না, সবাই কেবল সিনেমা বানানোর অভিনয় করছে। সিনেমার গল্প, প্রেম, ক্লিশে—সবই যেন ফাঁপা, যদি এর ভেতরে থাকে কেবল ক্ষমতার রাজনীতি আর গোপন স্বার্থ।
এবার আসা যাক অভিনয়ে। ববি দেওল এই সিরিজটিকে পুরোটা সময় টেনে নিয়ে গেছেন। নিজের চরিত্রের ভারিক্কি চাল তিনি সামলাছেন খুব ভালোভাবে। সাহের বাম্বা ও লক্ষ্যের রসায়ন পুরো সিরিজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁরা দুজনই চেষ্টা করেছেন ভালো করার। তবে সাহেরের চেয়ে লক্ষ্য এগিয়ে থাকবেন অভিনয়ের দিক দিয়ে। আসমানের মা-বাবার চরিত্রে মোনা সিং ও বিজয়ন্ত কোহলি ভালো অভিনয় করেছেন। বিশেষত আসমানের সঙ্গে যখন তাঁর বাবা কথা বলেন, আসমানকে সাহস জোগান; দৃশ্যটি দর্শকদেরও আবেগতাড়িত করে। আসমানের চাচার চরিত্রে মনোজ পাহওয়া ভালো অভিনয় করেছেন। তবে বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ নজর কেড়েছেন রাঘব জুয়াল। সিরিজে ছিল একঝাঁক অতিথি চরিত্র; তবে ইন্টিমেসি কো-অর্ডিনেটরের চরিত্রে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন ইমরান হাশমি। লক্ষ্যের বন্ধুর চরিত্রে রাঘব জুয়ালও দুর্দান্ত। তাঁর কমিক টাইমিংয়ের আলাদাভাবে প্রশংসা করতেই হয়। গত বছরের আলোচিত অ্যাকশন সিনেমা ‘কিল’-এ নায়ক ও ভিলেন ছিলেন লক্ষ্য ও রাঘব। এই সিরিজে তাঁরাই বন্ধুর চরিত্রে; সাত পর্বজুড়ে তাদের রসায়ন মুগ্ধ করে রাখে। ফ্রেডি সোডাওয়ালার চরিত্রে মনীশ চৌধুরীও দারুণ। এ চরিত্রের কঠোর দিক ও তাঁর খারাপ মুহূর্তগুলো তিনি তুলে ধরেছেন খুব ভালোভাবে। তবে আলাদাভাবে বলতে হবে দিভিক শর্মার নাম, কারিশমার ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই তরুণ অভিনেতা। ছোট চরিত্র হলেও তাঁর ডার্ক কৌতূক আর শেষদিকের চমকের জন্য দর্শকেরা যে তাঁকে মনে রাখবেন, তা বলাই বাহুল্য।

‘দ্য ব্যা**ডস অব বলিউড’–এর পোস্টার থেকে। আইএমডিবি

‘দ্য ব্যা***ডস অব বলিউড’ সিরিজের পুরোটা জুড়েই দেখা যায় ক্যামিও চরিত্রেরা হেসেছেন, নিজেদের নিয়ে মজা করেছেন, দর্শকদেরও হাসিয়েছেন। আমির খান, রাজামৌলি, সালমান খানের ক্যামিও খুব একটা প্রভাব রাখতে না পারলেও করণ জোহর, আরশাদ ওয়ার্সি, ইমরান হাশমির কথা সিরিজ শেষেও মনে রাখে। তবে সিরিজে বহু তারকার এই উপস্থিতি এসেছে অনেকটা ফারাহ খানের কমেডির ঢঙে। এটা বড় কোনো চমক না হলেও তারকারা এই সিরিজের আলাদা আকর্ষণ তো বটেই। ক্যামিও চরিত্ররা কম সময়ের জন্য উপস্থিত হলেও প্রত্যেককে একটা মুহূর্ত দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আরিয়ান। ক্যামিও চরিত্রদের হাত ধরেই গল্প অনেকটা এগিয়ে যায়। বোঝা যায়, প্রতিটি চরিত্রের জন্য আলাদাভাবে ভেবেছেন নির্মাতা। এ ছাড়া এ সিরিজে নেতিবাচক চরিত্রের মানুষ দেখানো হলেও দর্শকেরা একপর্যায়ে তাদের কষ্টের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করে, যেমন, সোডাওয়ালার চরিত্রটি।
তবে সব দেখাতে চাওয়াই এই সিরিজের বড় সমস্যা। বলিউডের সঙ্গে আন্ডারওয়ার্ল্ডের যোগসূত্র, রিভিউ বাণিজ্য, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে কেন্দ্র করে বলিউডে যা যা হয় তা দেখানো হয়েছে। কিন্তু কোনো ঘটনাই দেখানো হয়নি ভালোভাবে। যেমন আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাং-কে দেখানো অপ্রয়োজনীয় লাগে। গল্পের সঙ্গে এটি ঠিকমতো খাপও খায় না।
আসমানের মা–বাবার সঙ্গে সম্পর্ক, অজয় তালওয়ারের নিজের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কগুলো খুব ভালোভাবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু গল্প যতই এগিয়েছে, প্রথমদিকের মজা করে সবকিছু দেখানোর ভাবটা উধাও হয়ে গেছে। প্রথম দিকে যাকে সাধারণ, মজার চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে; শেষদিকে গিয়ে সে হয়ে উঠেছে ভিন্ন ব্যক্তিত্বের একজন। চরিত্রের এ পরিবর্তন ধরতে সময় লাগে। আবার পরিবর্তিত স্বভাবের চরিত্ররা যখন মজা করে, তখন সেটাও বেশ ক্লিশে লাগে।
তবে সিরিজের ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যে লুকিয়ে ছিল বড় চমক। শেষ দৃশ্য আসার আগপর্যন্ত অনুমান করতে না পারা, কী হতে যাচ্ছে। এই চমকের মাধ্যমেই যেন আরিয়ান খান এই সিরিজের নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করেন। যাঁরা বলিউডের গ্ল্যামার, তারকাদের ঝলমলে জগৎ আর আড়ালের বাস্তবতা দেখতে চান, তাদের জন্য ‘দ্য ব্যা**ডস অব বলিউড’ সিরিজটি হবে এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। তবে যাঁরা চান বাস্তবধর্মী গল্প ও গভীরতাসম্পন্ন চরিত্র ও নির্মাণ দেখতে চান, তাদের জন্য সিরিজটি কিছুটা কম মনে হতে পারে। আরিয়ানের নির্মাণ কাঁচা হলেও তাঁদের সাহস তারিফ করার মতো।

একনজরে
সিরিজ: ‘দ্য ব্যা***ডস অব বলিউড’
জনরা: কমেডি, ড্রামা
পরিচালক: আরিয়ান খান
চিত্রনাট্য: আরিয়ান খান, বিলাল সিদ্দিকী ও মানব চৌহান
অভিনয়: ববি দেওল, লক্ষ‍্য লালওয়ানি, সাহের বাম্বা, মোনা সিং, রাঘব জুয়াল
পর্ব: ৭
রানটাইম: ৩৫-৫০ মিনিট
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স।


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরও