প্রভাত সংবাদদাতা, শরীয়তপুর: শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলা সদর হতে ২ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ঈশ্বরকাঠি গ্রাম । পদ্মা ও কীর্তিনাশা নদীর তীরঘেঁষা নির্মল ও শান্ত গ্রামটিতে চলছে শোক। ঢাকায় মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিহত আবুল কালামের দ্বিতীয় জানাজা সোমবার (২৭ অক্টোবর) সকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্রামটির পোরাগাছা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা মাঠে। পরে সকাল ১০টার দিকে নড়িয়া পৌর কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। আত্মীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী অশ্রুসিক্ত নয়নে তাঁকে শেষবিদায় জানিয়েছেন।
আবুল কালামের বাড়ি উপজেলার মোক্তারের চর ইউনিয়নের ঈশ্বরকাঠি গ্রামে। তাঁর এমন অকালমৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজন ও গ্রামের মানুষেরা। তিনি ওই গ্রামের জলিল চোকদার ও হনুফা বেগম দম্পতির ছেলে। চার ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে আবুল কালাম ভাইদের দিক থেকে সবার ছোট। ২০ বছর আগে তাঁর বাবা ও মা মারা যান। এরপর তিনি বেড়ে ওঠেন বড় ভাই ও বোনদের কাছে।
স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান নিয়ে আবুল কালাম নারায়ণগঞ্জের পাঠানটুলি এলাকায় বসবাস করতেন। আর কাজ করতেন রাজধানীর মতিঝিলের একটি ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে। ওই কাজের জন্যই প্রতিদিন তিনি নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা যাতায়াত করতেন।
জানাজায় অংশ নিয়ে ঈশ্বরকাঠি গ্রামের বাসিন্দা নাঈম চোকদার বলেন, ‘আবুল কালাম ভাই ভদ্র ও শান্ত স্বভাবের হওয়ায় এলাকায় বেশ পরিচিত ছিলেন। সবার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। মানুষটির এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটি আমরা মানতে পারছি না।’
এর আগে আবুল কালামের কফিনবাহী গাড়িটি রবিবার রাত ২টার দিকে ঈশ্বরকাঠি গ্রামে পৌঁছায়। এ সময় পরিবারের সদস্যরা ও স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সোমবার সকালে জানাজার আগে আবুল কালামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামবাসীরা তাঁর কফিনে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন। শেষবিদায় ও একনজর দেখার জন্য ভিড় করছেন তাঁরা। প্রায় সবাই অশ্রুসিক্ত। পরিবারের সদস্যরা বাড়ির উঠানে বসে কান্না করছেন। স্ত্রী আইরিন আক্তার শিশুসন্তান কোলে নিয়ে এদিক-সেদিক ছুটছেন আর কান্না করছেন। স্বজনরা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়েও শান্ত করতে পারছেন না। জানাজার পর শিশুসন্তানকে কোলে কফিনের পেছনে ছুটছিলেন স্ত্রী আইরিন আক্তার। পরে স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে ফেরানোর চেষ্টা করেন।
আইরিন আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গতকাল সে (আবুল কালাম) যখন বাসা থেকে বের হয়, তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে চলে যাওয়ার পরও আমি দরজা বন্ধ করতে পারছিলাম না। জানি না তখন কেন যেন আমার বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল। আগে তো কখনো এমন হয়নি। এখন আবুল কালাম আমাকে সারা জীবনের জন্য কান্না উপহার দিয়ে চলে গেল। আমি দুই শিশুসন্তান নিয়ে কোথায় দাঁড়াব? কে আমাদের পাশে থাকবে?’
আবুল কালামের বড় ভাইয়ের স্ত্রী আসমা বেগম বাড়ির উঠোনে বসে ডুকরে কাঁদছিলেন এবং দেবরের (আবুল কালাম) স্মৃতিচারণা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর ওকে (আবুল কালাম) সন্তানের মতো মানুষ করেছি। সেও আমাকে মায়ের স্থান দিয়েছিল। রবিবার বেলা ১১টার দিকে ফোন করে বলেছিল, নদীতে ইলিশ মাছের অভিযান শেষ হয়েছে, আমার জন্য কিছু ইলিশ কিনে রেখো। আমি বৃহস্পতিবার এসে এগুলো নিয়ে যাব। ওর বৃহস্পতিবার আসার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই চলে এসেছে ওর লাশ। কে জানত এটাই ওর সঙ্গে আমার শেষ। আমরা এই কষ্ট কোথায় রাখব?’
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ুম খান গণমাধ্যমকে জানান, আবুল কালামের দাফনের সব কাজ তাঁরা সমন্বয় করেছেন। এ ছাড়া ওই পরিবারের পাশে সব সময় থাকবে উপজেলা প্রশাসন। পরিবারটিকে সহায়তার বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।
প্রতিদিনের মতো রবিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মতিঝিলে যান আবুল কালাম। এরপর কাজের জন্য সেখান থেকে বের হন। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের পিলারের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে যায়। সেটির নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান আবুল কালাম। এরপর গণমাধ্যমের সংবাদে পরিবারের সদস্যরা তাঁর মৃত্যুর খবর জানতে পারেন।