প্রভাত ডেস্ক: কয়েক মাস আগে গাজার আহমেদ শেহাদাকে এক ব্যক্তি ফোন করেন। ফোনে ওই ব্যক্তি বলেন, তিনি একটি মানবাধিকার সংগঠনে কাজ করেন। তিনি আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের উড়োজাহাজে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন। তবে এর জন্য জনপ্রতি ১ হাজার ৬০০ ডলার করে দিতে হবে। অর্থ দিতে হবে আগাম, পাঠাতে হবে একটি ক্রিপ্টো অ্যাকাউন্টে। নিউইয়র্ক টাইমস
শেহাদা প্রথমে বিশ্বাস করেননি, ধরেই নেন এটা একটি প্রতারণা। তিনি নিষেধ করে দেন। কিন্তু পরে খোঁজখবর নিয়ে এক ফিলিস্তিনি বন্ধুর কাছে জানতে পারেন, ওই বন্ধুও এই দলের মাধ্যমে গাজার বাইরে পালিয়ে গেছেন। ৩৭ বছর বয়সী শেহাদা সিদ্ধান্ত নেন তিনিও সুযোগ নেবেন।
শেহাদা অর্থ পাঠান। তারপর শুরু হয় চরম উদ্বেগ ও ভীতিকর এক যাত্রা। প্রথমে শেহাদা, তাঁর স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে দুটি আলাদা আলাদা বাসে ২৪ ঘণ্টা ভ্রমণ করতে হয়। সে ভ্রমণ পথে যেকোনো সময় ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল।
ভীতসন্ত্রস্ত বাস ভ্রমণ শেষ শেহাদারা চরম উদ্বেগ নিয়ে ইসরায়েলি চেকপোস্ট পার হন এবং সেখান থেকে গন্তব্য অজানা এক ফ্লাইটে চেপে বসেন।
নানা ঘাট ঘুরে শেষ পর্যন্ত শেহাদারা গিয়ে পৌঁছান দক্ষিণ আফ্রিকায়। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে শেহাদারা কখনো যাননি।
শেহাদা বলেন, ‘গাজার পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ যে আপনি এমন ঝুঁকি নিতে বাধ্য হবেন।’
দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এই ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে বা তাদের কারা নিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো কিছুই জানে না। তারা বিষয়টি সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচনা করছে।
শেহাদা নিজে একজন চিকিৎসক। তিনি ২৮ অক্টোবর নিজের পরিবার নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছান। আরও কয়েক শ ফিলিস্তিনিকে নিয়ে সম্প্রতি দুটি উড়োজাহাজ দক্ষিণ আফ্রিকায় অবতরণ করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এই ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে বা তাদের কারা নিয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনো কিছুই জানে না। তারা বিষয়টি সন্দেহজনক হিসেবে বিবেচনা করছে।
ফিলিস্তিনিদের পরিবহন করতে ওই চার্টার্ড ফ্লাইটগুলোর ব্যবস্থা করেছিল আল-মাজদ ইউরোপ নামের একটি সংগঠন। এই দল খুব একটা পরিচিত নয়। তাদের বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তাদের হাতে তেমন কোনো তথ্য নেই।
দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলা গত সোমবার এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, তাঁদের ধারণা, এই কর্মকাণ্ডের পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে।
লামোলা একে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হিসেবে বর্ণনা করেন। ইসরায়েল দক্ষিণ আফ্রিকার মন্ত্রীর এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, তাদের বের করে দেওয়া হয়েছে।’
প্রেসিডেন্ট রামাফোসা আরও বলেন, ‘আমার সরকারের ওপর ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করার দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, তারা (ফিলিস্তিনি) একটি ভিন্ন এবং বিশেষ ধরনের জনগণ, যাদের আমরা একটি দেশ হিসেবে সমর্থন করেছি।’
এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা তৃতীয় একটি দেশ থেকে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে পাঠানোর অনুমোদন হাতে পেয়েছে, তবে তারা ওই তৃতীয় দেশ কারা, সেটা উল্লেখ করেনি।
এমন একসময়ে ফিলিস্তিনিদের ফ্লাইট দক্ষিণ আফ্রিকায় নেমেছে, যখন দেশটি আন্তর্জাতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। ২২ ও ২৩ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় বসতে চলেছে জি-২০ সম্মেলন।
এবারের সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবে দক্ষিণ আফ্রিকা। এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় জি-২০ সদস্যদেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলন এবারই প্রথম।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনিদের সরব সমর্থকদের অন্যতম দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্তু দেশটিতে অবতরণের পর ফিলিস্তিনিদের যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা নিয়ে স্থানীয় অনেকে সমালোচনা করছেন।
অভিযোগ উঠেছে, দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার গত সপ্তাহে দ্বিতীয় ফ্লাইটটি গ্রহণের সময় সঠিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ওই ফ্লাইটে থাকা ১৫৩ ফিলিস্তিনি অন্তত ১০ ঘণ্টা উড়োজাহাজের ভেতরে অপেক্ষা করতে বাধ্য হন।
দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোনাল্ড লামোলার ধারণা, এই কর্মকাণ্ডের পেছনে ইসরায়েলের হাত রয়েছে। তিনি একে গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করার সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হিসেবে বর্ণনা করেন।
প্রয়োজনীয় নথিপত্র না থাকায় এস ফিলিস্তিনির বিষয়ে অভিবাসনসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত তাঁদের উড়োজাহাজ থেকে নামতে দেওয়া হয়নি।
উড়োজাহাজে আসা ফিলিস্তিনিদের সহায়তা করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজকর্মী নাঈম জিনাহ।
নাঈম জিনাহ বলেন, এসব মানুষ গাজা থেকে এসেছেন এবং সেখানে একটি মানবিক সংকট চলছে—ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে ইচ্ছুকই ছিলেন না।
নাঈম জিনাহ আরও বলেন, ‘তাঁরা খুব সংকীর্ণ মন নিয়ে বিষয়গুলো দেখছিলেন।’ তবে শেহাদাদের এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে জাতিসংঘের একটি সংস্থায় কাজ করেছেন তিনি।
নাঈম জিনাহ বলেন, ‘তাঁদের ফ্লাইট ২৮ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছায়। অন্য আন্তর্জাতিক যাত্রীরা যেভাবে ইমিগ্রেশন পার হয়েছেন, আমাদের উড়োজাহাজে থাকা সবাই একইভাবে পার হয়েছি।’
শেহাদা আরও বলেন, গাজা যুদ্ধের সময় তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে ১২ বার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে।
এক সহকর্মী শেহাদাকে আল-মাজদের ওয়েবসাইটের লিংক পাঠালে গত মার্চে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
শেহাদা ওয়েবসাইটে একটি ফরম পূরণ করেন এবং এক মাস পর এপ্রিলে আল-মাজদ থেকে এক ব্যক্তি তাঁকে ফোন করেন।
কয়েক মাস পর শেহাদা যখন গাজা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি ৬ হাজার ৪০০ ডলার জমা দেন। ২৬ অক্টোবর মধ্যরাতের ঠিক আগে একটি ফোন পান আহমেদ শেহাদা। আল-মাজদ প্রতিনিধি তাঁদের চার ঘণ্টার মধ্যে খান ইউনিসে পৌঁছাতে বলেন। পরিবার নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়েন শেহাদা।
‘এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা তৃতীয় একটি দেশ থেকে ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে পাঠানোর অনুমোদন হাতে পেয়েছে।’
শেহাদা বলেন, খান ইউনিসে তাঁদের একটি বাসে ওঠানো হয়। তাঁদের বলা হয়েছিল, রাফায় প্রবেশের আগে বাসের জানালায় পর্দা না সরাতে এবং ফোন বন্ধ রাখতে।
আল-মাজদ থেকে তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছিল, যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, তাঁরা কী করছেন, তাহলে বলতে হবে, ফরাসি দূতাবাস গাজা থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার যে কার্যক্রম চালাচ্ছে, তাঁরা তারই অংশ।
যে সময়ের উদ্বেগ আর আতঙ্কের কথা মনে করে এখনো কেঁপে ওঠেন আহমেদ শেহাদা। তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলাম, যদি তাদের ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকে এবং আমরা রাফায় ঢোকার পর যদি ইসরায়েলি বাহিনী বাস লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে, তখন কী হবে?’
শেহাদাদের নিয়ে বাসগুলো কেরেম শালোম সীমান্তে পৌঁছায়। সেখানে ইসরায়েলি সেনারা তাঁদের সবসামগ্রী ছেড়ে যেতে বলেছিলেন। তারপর তাঁরা কয়েকটি নিরাপত্তা চেকপোস্ট অতিক্রম করে নতুন বাসে ওঠেন, যা তাঁদের দক্ষিণ ইসরায়েলের রামন বিমানবন্দর পৌঁছে দেয়। সেখানে তাঁরা একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে চড়েন। ফ্লাইটের আকাশে মাঝপথ পর্যন্তও তাঁরা জানতেন না, তাঁদের গন্তব্য কেনিয়ার নাইরোবি।
নাইরোবি থেকে তাঁরা দক্ষিণ আফ্রিকার পথে উড়াল দেন। শেহাদা বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে তিনি আল-মাজদ ইউরোপ থেকে শেষ বার্তাটি পান। সেই বার্তায় তাঁকে তাঁর জন্য ‘বুক’ করে রাখা একটি গেস্টহাউসের ঠিকানা জানানো হয়। বলা হয়, এক সপ্তাহের জন্য সেটি তাঁরা বুক করে দিয়েছে। যদিও কথা ছিল এক মাস থাকার ব্যবস্থা করা হবে।
সোমবারও আল-মাজদের ওয়েবসাইটে ঢুকে একটি বার্তা দেখা গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলছে এবং সেবাদান অব্যাহত আছে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির নাম ব্যবহার করে অনলাইনে প্রতারণার বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে। ওয়েবসাইটে থাকা নম্বরে ফোন দিয়ে এবং বার্তা পাঠিয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
সাইফ নামের আরেক ফিলিস্তিনি বলেন, আল-মাজদ তাদের কীভাবে এবং কোথায় পৌঁছে দেবে, সে বিষয়ে তাঁদের কিছুই জানানো হয়নি।
সাইফ বলেন, ‘আমরা এমনকি এটাও জানতাম না যে আমরা কোথায় যাচ্ছি।’
শেহাদাদের দলটি দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছানোর পর স্থানীয় একটি ত্রাণ সংস্থা পুরো দলের জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। এ ছাড়া ভিসা ছাড়াই ৯০ দিনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের অনুমতির ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা বিশেষ এই সুবিধা রেখেছে।
শেহাদা বলেন, ‘তাঁর চার বছরের মেয়ে জীবনে কেবল যুদ্ধ দেখে বড় হয়েছে। তাই দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে সে যখন দেখছে, দোকানে গিয়ে খাবার কেনা যায় বা ফোনে চার্জ দেওয়া যায়, সে খুবই অবাক হয়ে যাচ্ছে। এ সবকিছুই তার জন্য নতুন, জীবনে এসব বিলাসিতা ছোট্ট শিশুটি শুধু অনলাইনে দেখেছে।’
মেয়ের এই অবাক হওয়া বাবা শেহাদার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে প্রতিদিনই আমাকে বলে, বাবা আমরা ইউটিউবের ভেতরের জীবনের মতো জীবন পেয়ে গেছি।’