প্রভাত অর্থনীতি: মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতের রুপির দরপতনের ধারা চলছে। চলতি বছর ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতন হয়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দুই দিনেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। এর প্রভাব বাংলাদেশিদের ওপরও পড়বে।
রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (আরবিআই) তথ্যানুসারে, মঙ্গলবার সকালে প্রতি ডলারের বিপরীতে ৮৯ দশমিক ৭৪ রুপি পাওয়া যাচ্ছে। দরপতন হয়েছে শূন্য দশমিক ৩২ শতাংশ।
নভেম্বর মাসে ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতন হয়েছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে ৩০ নভেম্বর রুপির মান সর্বকালীন তলানিতে নেমে আসে। সেদিন প্রতি ডলারের বিপরীতে ৮৯ দশমিক ৭৯ রুপি পাওয়া গেছে। এখনো রুপির মান তার আশপাশেই। এতে দেশটির বাণিজ্যঘাটতিতে আরও চাপ পড়ছে। খবর ইকোনমিক টাইমস ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের।
জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হারকে আশাতীত বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। প্রবৃদ্ধির এই পরিসংখ্যান প্রকাশিত হওয়ার পর ধারণা করা হয়েছিল, চলতি সপ্তাহে রুপি ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু সপ্তাহের প্রথম দুই দিনে রুপির পতন অব্যাহত আছে। গতকাল সোমবার ডলারের বিপরীতে রুপি ৮৯ দশমিক ৭৩ ডলারে নেমে যায়। এরপর দিনশেষে তা ৮৯ দশমিক ৫৪ রুপিতে ওঠে। কিন্তু তা আবার ৮৯ দশমিক ৭৪ ডলারে নেমে যায়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি ডলারের বিপরীতে রুপির মান ছিল ৮৫ দশমিক ৭০।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যাচ্ছেন, তাঁরা ডলার ভাঙিয়ে আগের চেয়ে বেশি রুপি পাচ্ছেন। বাংলাদেশে ডলারের দাম অনেক দিন ধরেই স্থিতিশীল। কয়েক মাস ধরে তা ১২২ টাকার মধ্যে আছে।
একদিকে দেশের বাজারে ডলারের দাম স্থিতিশীল, আরেকদিকে ভারতে রুপির দরপতন। এই পরিস্থিতিতে ভারতে বাংলাদেশি ভ্রমণকারীরা অনেকটা দুভাবে লাভবান হবেন। সাধারণত ভারতে যেসব দেশের মানুষেরা বেশি ভ্রমণ করেন, তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষস্থানীয়। যদিও ভিসা নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন বাংলাদেশে থেকে খুব বেশি মানুষ ভারতে যেতে পারছেন না।
নভেম্বর মাসের বড় সময় ডলারের বিনিময়মূল্য ৮৮ দশমিক ৫৭ থেকে ৮৮ দশমিক ৭৮ রুপির মধ্যে ওঠানামা করেছে। কিন্তু ২১ নভেম্বর এক দিনে রুপির দরপতন হয় শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। সেদিন ডলারের মান ৮৯ রুপির মনস্তাত্ত্বিক সীমা টপকে যায়। এরপর যেন রুপি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না।
পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরে নভেম্বর পর্যন্ত রুপির অবমূল্যায়ন হয়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে চলতি বছর এশিয়ার সবচেয়ে ‘দুর্বল’ মুদ্রার খেতাব জুটেছে তার। শুধু ডলার নয়, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন, চীনের ইউয়ান, অর্থাৎ বিশ্বের প্রধান এই চার মুদ্রার বিপরীতেও রুপির সর্বাধিক দরপতন হয়েছে।
কোনো দেশের মূল্যস্ফীতি কী অবস্থায় আছে, তা বোঝার মানদণ্ড হলো ভোক্তামূল্যসূচক। একইভাবে মুদ্রার ‘দর’ কী অবস্থায় আছে, তা বোঝার জন্য দুটি সূচক আছে। সে দুটি সূচক হলো—নমিনাল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (এনইইআর) ও রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (আরইইআর)। ৪০টি দেশের মুদ্রার নিরিখে নির্দিষ্ট কোনো দেশের মুদ্রার অবস্থান কতটা ভালো বা খারাপ, তা বোঝা যায় এ দুটি সূচকের নিরিখে। ভারতে ২০১৫-১৬ সালে এই সূচক চালু হয়েছে। এই সূচকে থাকা ৪০টি দেশের সঙ্গেই ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৮৮ শতাংশ হয়ে থাকে। ডলার ইনডেক্সের মতোই এনইইআর ও আরইইআর বাড়লে বোঝা যায়, মুদ্রা শক্তিশালী। কমলে বোঝা যায় ঠিক তার উল্টোটা।
আরবিআইয়ের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের অক্টোবরে এনআইআর নেমেছে ৮৪ দশমিক ৫৮ রুপিতে, গত বছর অক্টোবরে যা ছিল ৯০ দশমিক ৮৫ রুপি। প্রায় একই দশা আরইইআরের—অক্টোবরে তা নেমেছিল ৯৭ দশমিক ৪৭ রুপি। এ দুটি সূচকই চার বছরের মধ্যে তলানিতে। নভেম্বর মাসে ভারতের রুপির আরও দরপতন হওয়ায় পরিস্থিতির যে আরও অবনতি হয়েছে, তা বোঝা কঠিন নয়। ফলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের আগে মোটেও স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, বিশ্লেষকেরা এমনটাই মনে করছেন।
দরপতনের কারণ সম্পর্কে বিশ্লেষজ্ঞরা বলছেন, বছরটা ছিল অনিশ্চয়তাপূর্ণ। চলতি বছর রুপির দরপতনের পেছনে ট্রাম্পের শুল্ক এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে বছরভর আলোচনার পরও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যচুক্তি না হওয়াই মূল কারণ। সিংহভাগের মত, চলতি বছরে চুক্তি নিয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা না পেলে রিজার্ভ ব্যাংক হাজার চেষ্টা করলেও রুপির বিনিময় হার ৯০ পেরিয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারবে না।
এদিকে মার্কিন-ইইউ নিষেধাজ্ঞার ফাঁসে রাশিয়া থেকে অপরিশেধিত তেল আমদানি কমিয়েছে ভারত। পরিসংখ্যান বলছে, যখন প্রতিদিন প্রায় ১৭ লাখ ব্যারেল রুশ তেল আসছিল ভারতে, এমন অবস্থায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। এর বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে হিমশিম খাচ্ছে নয়াদিল্লি। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৭ হাজার ৭০০ কিলোমিটার পথ ঘুরে সুদূর গায়ানা থেকে তেলবোঝাই ট্যাংকার আসছে ভারতে। পাশাপাশি পশ্চিম এশিয়া থেকেও উল্লেখযোগ্যহারে তেল আমদানি বাড়াতে হয়েছে। এতে ভারতের বাজারে তেলের চাহিদা মিটলেও পরিবহন খরচ বেড়ে গেছে অনেক। ফলে ডলারের ভান্ডারে চাপ পড়ছে।
ভারতের মুদ্রা রুপির এই দরপতন এভাবে চলবে, নাকি থামবে, তা বলা কঠিন বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মনোভাব আন্দাজ করা একপ্রকার অসাধ্য। বিশেষজ্ঞদের বড় অংশের দাবি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতা দ্রুত সেরে না ফেললে রিজার্ভ ব্যাংকের পক্ষেও রুপির পতন ঠেকানো কঠিন। রুপির দর আরও পড়লে আমদানির খরচ যে পর্যায়ে উঠবে, তাতে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি যে কমে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।