• রবিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৪ অপরাহ্ন

দেশে দেশে সিআইএ’র গোপন সব অভিযানের গল্প

প্রভাত রিপোর্ট / ৭ বার
আপডেট : রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

প্রভাত ডেস্ক: “এই নথিগুলোর অস্তিত্ব আমরা নিশ্চিত করতে পারি না, আবার অস্বীকারও করতে পারি না”— লাতিন আমেরিকায় সিআইএ’র প্রথম গোপন অভিযানের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বছরের পর বছর এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)-এর উত্তর।
ঘটনাটি ছিল ১৯৫৪ সালে গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট হাকোবো আরবেন্‌জকে ক্ষমতা থেকে সরানোয় তাদের হস্তক্ষেপ বিষয়ে। তবে বহু বছর পর ১৯৯৭ সালে, সিআইএ আংশিকভাবে কিছু নথি প্রকাশ করে, যেগুলোতে গুয়াতেমালায় পরিচালিত তাদের দুটি অভিযানের বিবরণ ছিল। একটি পিবি ফর্চুন, অন্যটি পিএসবিএ সাকসেস।
এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে সিআইএ’র এ ধরনের তৎপরতা আর অতটা গোপন থাকছে না বলেই মনে হচ্ছে। এই সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনের তথ্য নিশ্চিত করেন, যেখানে বলা হয়েছিল যে তিনি সিআইএ-কে ভেনেজুয়েলায় গোপন অভিযান চালানোর অনুমতি দিয়েছেন।
এই খবর আবারও মনে করিয়ে দেয় সেই সময়ের কথা, যখন ওয়াশিংটন লাতিন আমেরিকাকে তাদের “পেছনের উঠান” মনে করে গোপন তৎপরতার মাধ্যমে সেখানকার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করত।
১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে, সিআইএ শুধু বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণই করেনি, বরং বিভিন্ন দেশে গোপন অভিযানও চালিয়েছে, যা সংস্থাটির ইতিহাসে গভীর ছাপ ফেলেছে। শীতল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, সিআইএ সমাজতন্ত্রের বিস্তার ঠেকাতে এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো শাসনব্যবস্থা যাতে অন্য দেশে গড়ে না ওঠে, তা নিশ্চিত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে।
লাতিন আমেরিকা ছিল এমন একটি অঞ্চল, যেখানে সিআইএ সবচেয়ে বেশি এবং বিতর্কিতভাবে সক্রিয় ছিল। “শীতল যুদ্ধের সময় অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ছিল মূলত কমিউনিজম ঠেকানো,” বিবিসি নিউজ ব্রাজিলকে এমনটাই বলেন ব্রাজিলিয়ান সেন্টার ফর অ্যানালাইসিস অ্যান্ড প্ল্যানিং (সেব্রাপ)-এর গবেষক এনরিকে নাতালিনো।
লাতিন আমেরিকায় সিআইএ’র হস্তক্ষেপের সব চেষ্টার তালিকা তৈরি করা সম্ভব নয়, তবে কিছু ঘটনা এখন ভালোভাবেই নথিভুক্ত। সাধারণত নির্দিষ্ট সময় পর পর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গোপন নথি প্রকাশ করা হয়, যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রে সময়সীমা ভিন্ন হতে পারে।
এখন জানা যায়, সিআইএ বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও বিদেশি সরকারকে সহায়তা করেছে— কখনো প্যারামিলিটারি অভিযানের মাধ্যমে; আবার কখনো প্রশিক্ষণ, পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিগত সহায়তার মাধ্যমে, যা পরিচালিত হয়েছে তাদের ‘সেন্টার ফর স্পেশাল অ্যাক্টিভিটিজ’-এর মাধ্যমে।
নিচে লাতিন আমেরিকায় সিআইএ পরিচালিত কিছু উল্লেখযোগ্য গোপন অভিযানের কথা তুলে ধরা হলো।

গুয়াতেমালা, ১৯৫৪

১৯৯৭ সালের মে মাসে, সিআইএ তাদের তথাকথিত “গুয়াতেমালা অস্থিতিশীলতা কর্মসূচি” নিয়ে প্রায় ১৪০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যদিও ধারণা করা হয়, পুরো নথির পরিমাণ ছিল এক লাখ পৃষ্ঠার মতো। গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট হাকোবো আরবেন্‌জ বামপন্থি বিভিন্ন দল ও সেনাবাহিনীর সমর্থনে ১৯৫০ সালে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সিআইএ’র গোপন অভিযানের লক্ষ্যবস্তু।
আরবেন্‌জ একটি প্রগতিশীল কর্মসূচি নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ভূমি সংস্কার। এই কর্মসূচির আওতায় তিনি ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির অব্যবহৃত জমি অধিগ্রহণ এবং কর আদায়ের উদ্যোগ নেন। এই বহুজাতিক সংস্থাটি মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল উৎপাদন ও বিপণনে নিয়োজিত ছিল।
ওয়াশিংটন দাবি করেছিল, গুয়াতেমালায় সোভিয়েত প্রভাব রয়েছে— যদিও দেশ দুটির মধ্যে তখন কূটনৈতিক সম্পর্কই ছিল না।
‘দ্য সিআইএ: আ ফরগটেন হিস্ট্রি’সহ একাধিক গ্রন্থের রচয়িতা ও সাংবাদিক উইলিয়াম ব্লামের (১৯৩৩–২০১৮) মতে, গুয়াতেমালায় হস্তক্ষেপের পেছনে মূলত ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির চাপ কাজ করেছিল। এই বহুজাতিক কোম্পানিটি মনে করেছিল, ভূমি সংস্কার নীতির কারণে তাদের জমি বাজেয়াপ্ত হওয়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ব্লাম বলেন, এই অভিযান পরবর্তীতে লাতিন আমেরিকায় অন্যান্য হস্তক্ষেপের জন্য একটি মডেল হয়ে ওঠে। এতে স্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া, গুয়াতেমালার সরকারের বিরুদ্ধে রেডিও ও সংবাদপত্রে প্রচার অভিযান চালানো এবং কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মতো নানা কৌশল ব্যবহার করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, তথাকথিত ‘অপারেশন শেরউড’-এর আওতায় চালু করা হয় ‘রেডিও লিবেরাসিওন’ (যার বাংলা মানে দাঁড়ায় – স্বাধীন বেতার) নামের একটি সম্প্রচার কেন্দ্র, যা নিজেকে ‘গোপন ও দেশপ্রেমিক’ হিসেবে পরিচয় দিত।
তবে এটি গুয়াতেমালার বাইরে থেকে পরিচালিত হতো এবং দক্ষিণ ফ্লোরিডায় রেকর্ড করা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করত, যেখানে সঙ্গীত ও কৌতুকের সঙ্গে মিশে থাকত তীব্র কমিউনিস্ট-বিরোধী প্রচারণা। সিআইএ’র নথি অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট আরবেন্‌জ পদত্যাগ করে নির্বাসনে যাওয়ার দিন পর্যন্ত তাকে হত্যার পরিকল্পনা চলছিল।
গোয়েন্দা সংস্থার রেকর্ড অনুযায়ী, গুয়াতেমালায় সিআইএ’র অভিযান শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস. ট্রুম্যানের সময় এবং তা ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ারের সময়েও অব্যাহত ছিল। এই অভিযানের জন্য মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, রাজনৈতিক তৎপরতা ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৭ লাখ মার্কিন ডলার।

কিউবা

কিউবার ওপর বিশেষ নজর ছিল সিআইএর। মূলত ১৯৫৯ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্যারিবীয় এই দ্বীপটিতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তৎপর হতে শুরু করে সিআইএ। উইলিয়াম ব্লাম মন্তব্য করেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই গোয়েন্দা সংস্থা “তাদের সাধ্য অনুযায়ী সবকিছুই করেছে” যাতে ফিদেল কাস্ত্রোর সরকার সফল না হয়।
সিআইএর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা কিউবামুখি পণ্যের চালানে নাশকতা চালানো, দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং ফিদেল কাস্ত্রো ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কিউবান কর্মকর্তাদের হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল।
সবচেয়ে প্রতীকী ও দৃশ্যমান ঘটনা ছিল ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে কিউবার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত বে অফ পিগসের তীরে অবস্থিত প্লাইয়া গিরন দ্বীপে হামলার ব্যর্থ চেষ্টা। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সিআইএ প্রশিক্ষিত কিউবান নির্বাসিতদের একটি প্যারামিলিটারি দল দ্বীপটিতে হামলা চালিয়ে কাস্ত্রোকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভের তথ্য অনুযায়ী, যা সিআইএর গোপন নথি থেকে প্রকাশিত, ১৯৫৯ সালের অক্টোবর মাসে- বিপ্লবের দশ মাস পর- যুক্তরাষ্ট্র সরকার কাস্ত্রো-বিরোধী একটি সহায়তা কর্মসূচি অনুমোদন করে।
ডিসেম্বরে, গোয়েন্দা সংস্থার একটি স্মারকে আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা হয় যে, কাস্ত্রো দ্বীপটিতে একটি চরম বামপন্থি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন।
পরবর্তী মাসে সিআইএ একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করে, যার লক্ষ্য ছিল কিউবার সরকারকে উৎখাত করা। নথি অনুযায়ী, ১৯৬০ সালের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে প্যারামিলিটারি প্রশিক্ষণ শুরু হয়, যেখানে ৩০০ গেরিলাকে বাছাই করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং হন্ডুরাস উপকূলের একটি দ্বীপে একটি শক্তিশালী রেডিও স্টেশন স্থাপন করা হয়।
নথি অনুযায়ী, ১৭ই মার্চ হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে “কাস্ত্রোর শাসনের বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতার কর্মসূচি” শীর্ষক সিআইএর নীতিমালা অনুমোদন করা হয়।
স্মারকে বলা হয়, “সিআইএর পরিকল্পনায় ছিল চারটি মূল দিক– নির্বাসনে থাকা মধ্যপন্থি বিরোধী গোষ্ঠী গঠন, যারা দাবি করবে কাস্ত্রো যে বিপ্লবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তা পুনরুদ্ধার করা; কিউবার উদ্দেশে সম্প্রচারের জন্য একটি মিডিয়াম-ওয়েভ রেডিও স্টেশন স্থাপন; কিউবার অভ্যন্তরে গোপন গোয়েন্দা তৎপরতা ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড চালাতে পারবে এমন একটি সংগঠন গঠন, যা নির্বাসিত বিরোধীদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবে; এবং কিউবার বাইরে একটি প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণ শুরু করা, যার দ্বিতীয় ধাপে কিউবায় পাঠিয়ে স্থানীয় প্রতিরোধ গোষ্ঠীকে সংগঠিত, প্রশিক্ষণ ও পরিচালনা করা হবে।”
মোট এক হাজার ২৯৭ জন গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দেয় সিআইএ, যাদের অধিকাংশই ছিলেন মিয়ামিতে বসবাসকারী কিউবান। এই অভিযান ১৫ থেকে ২০শে এপ্রিলের মধ্যে পরিচালিত হয়, তবে কিউবার সশস্ত্র বাহিনীর কাছে তারা পরাজিত হয়।
“এই হস্তক্ষেপকে কখনো বলা হয়েছে একেবারে ব্যর্থতা, কখনো ট্র্যাজেডি, আবার কখনো বা অপমানজনক পরাজয়,” লিখেছেন ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ মাইকেল গ্রো, তার “ইউএস প্রেসিডেন্টস অ্যান্ড লাতিন আমেরিকান ইন্টারভেনশনস” বইয়ে। তার মতে, সিআইএর আশ্বাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিশ্বাস করেছিল যে এই আক্রমণ সফল হবে এবং “কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই” সিআইএ প্রশিক্ষিত ‘কিউবান নির্বাসিতরা’ ফিদেল কাস্ত্রোকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারবে।
“কিউবার ঘটনা ছিল এই হস্তক্ষেপের সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণগুলোর একটি, যার পেছনে মূলত সিআইএর পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। আর সম্ভবত বিংশ শতকের যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক কৌশলগত ভুলগুলোর একটি,” বলেন ম্যাকেঞ্জি ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো ভিক্টর মিসিয়াতো।

বলিভিয়া ও চে গেভারার মৃত্যু

আর্জেন্টাইন বংশোদ্ভূত কিংবদন্তি গেরিলা নেতা এর্নেস্তো চে গেভারাকে ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে বলিভিয়ায় গ্রেপ্তার ও পরবর্তীতে তাকে হত্যা ছিল লাতিন আমেরিকায় সিআইএ পরিচালিত সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত অভিযানের একটি।
গোপন নথি থেকে জানা যায়, বলিভিয়ায় চে গেভারাকে গ্রেপ্তার ও হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যাটালিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিল সিআইএ। আন্দিজ অঞ্চলে বামপন্থি বিপ্লবী আন্দোলন যাতে সফল না হয়, সে লক্ষ্যে এই সহযোগিতা করা হয়।
১৯৬৪ সালে, বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ভিক্তর পাজ এসতেনসোরোর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানেও অর্থ ও সমর্থন জুগিয়েছিল সিআইএ। গোপন নথি অনুযায়ী, সংস্থাটি ডানপন্থি সাবেক সামরিক কর্মকর্তা রেনে বারিয়েন্তোস ওর্তুনোকে অর্থায়ন করে, যিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ এবং ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সিআইএ এজেন্ট ফেলিক্স রদ্রিগেজ নিজেই স্বীকার করেছেন এবং গোপন নথিতেও উল্লেখ রয়েছে যে, চে গেভারাকে গ্রেপ্তারের পর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনিই তাকে পাহারা দিয়েছিলেন। কিউবা ত্যাগ করার পর চে গেভারা দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন এবং সিআইএ বিশ্লেষকরা তার গতিবিধি নজরে রেখেছিলেন।
নথিপত্রে দেখা যায়, সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন নিয়মিতভাবে চে গেভারার অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হতেন এবং ওয়াশিংটন উদ্বিগ্ন ছিল যে, তার কার্যকলাপ অঞ্চলটিতে বামপন্থি বিপ্লবী আন্দোলনকে উৎসাহিত করতে পারে।
চে গেভারা বলিভিয়ায় জেনারেল রেনে বারিয়েন্তোসের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন মাত্র কয়েকজন গেরিলাকে নিয়ে— সমসাময়িক কিছু প্রতিবেদনে যাদের সংখ্যা অর্ধডজন বলা হয়েছে। এই ছোট্ট গেরিলা দলটি ওয়াশিংটনের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বারিয়েন্তোস যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিদ্রোহীদের দমন করতে সেনা ও অস্ত্র পাঠানোর অনুরোধ জানান।
নথিতে এমনকি চে গেভারার শেষ দিনগুলো ও মৃত্যুর বিস্তারিত বিবরণও রয়েছে, যা প্রেসিডেন্ট জনসনকে জানানো হয়েছিল। এতে দেখা যায়, যদিও সিআইএ তার গ্রেপ্তারে সহযোগিতা করেছিল, তবে তাকে গুলি করে হত্যার সিদ্ধান্ত এসেছিল বলিভিয়ার সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে। আর এটিই পরে ফেলিক্স রদ্রিগেজসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তিরাও নিশ্চিত করেছেন।

চিলি ও উরুগুয়ে

নিজেকে মার্ক্সবাদী ঘোষণা করা প্রেসিডেন্ট সালভাদর আইয়েন্দের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে সিআইএর জড়িত থাকার ঘটনা লাতিন আমেরিকায় সংস্থাটির সবচেয়ে পরিচিত ও নথিভুক্ত হস্তক্ষেপগুলোর একটি।
১৯৭৪ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস যুক্তরাষ্ট্রের এই হস্তক্ষেপের তথ্য প্রকাশ করে। পত্রিকাটি একটি অডিও রেকর্ডিংয়ের প্রতিলিপি প্রকাশ করে, যেখানে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলছেন, “আমি বুঝতে পারি না কেন আমরা চুপচাপ বসে থাকব আর দেখব একটি দেশ তার জনগণের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে কমিউনিস্ট হয়ে যাচ্ছে”।
ভিক্তর মিসিয়াতো বলেন, “সবচেয়ে সফল হস্তক্ষেপ ছিল আইয়েন্দের চিলিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, যেখানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা সামরিক ও লজিস্টিক সহায়তা দিয়েছিল। সাধারণত তারা হঠাৎ করে কিছু করে না। বরং যে দেশে এমন কোনো আন্দোলন আগে থেকেই আছে, তারা সেটিকেই সমর্থন দেয়,” বলেন জার্মানির ডুইসবুর্গ-এসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পিস স্টাডিজের গবেষক লিওনার্দো বান্দার্রা। তিনি আরও বলেন, “চিলিতে, যেমনটা ব্রাজিলেও দেখা গেছে, সামরিক অভ্যুত্থানের একটি প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। সিআইএ সেই প্রবণতাকে সমর্থন ও শক্তিশালী করেছে।”
এনরিকে নাতালিনো নিশ্চিত করেন, ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ সফল হয়েছে তখনই, যখন “গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা সংশ্লিষ্ট দেশের অভ্যন্তরীণ উপাদানগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে পরিচালিত হয়েছে”।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে সিআইএ আইয়েন্দের সরকারকে অকার্যকর প্রমাণ করতে কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। এর ফলে অভ্যুত্থানের পথ সুগম হয় এবং ক্ষমতায় আসেন স্বৈরশাসক আউগুস্তো পিনোশে উগার্তে, যিনি প্রায় ১৭ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, যদিও তার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ রয়েছে।
উরুগুয়েতে, যেখানে ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন চলেছে, এমন ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সিআইএ মূলত মন্তেভিদেওতে একটি নিরাপত্তা দফতর গঠনে সহায়তা করেছিল। অভ্যুত্থানের আগের দশ বছরে এই দফতর বামপন্থি বিদ্রোহী ও গেরিলাদের দমন করতে পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল।
জানা যায়, সিআইএ উরুগুয়ের সেনাবাহিনীকেও সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল সরবরাহ করেছিল।

ইকুয়েডর ও পেরু

“সিআইএর অভিযান লাতিন আমেরিকার সরকারগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে, প্রায় প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনে এবং এমনকি লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া গোষ্ঠীগুলোর আর্থিক নিয়ন্ত্রণের পদেও অনুপ্রবেশ করেছিল। এর ফলে সিআইএ সংবেদনশীল তথ্য, যেমন কমিউনিস্ট পার্টির কর্মসূচি বা অভ্যন্তরীণ বৈঠকের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়,” বলেন নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গ্রে ডায়নামিকসের দোলোরেস গার্সিয়া।
উইলিয়াম ব্লামের মতে, ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে সিআইএ ইকুয়েডরের সরকারে অনুপ্রবেশ করে, সংবাদ সংস্থা ও রেডিও স্টেশন গঠন করে এবং রক্ষণশীল সংগঠনগুলোর ওপর হামলা সংগঠিত করে, যার দায় পরে চাপানো হয় বামপন্থি গেরিলা গোষ্ঠীগুলোর ওপর।
সাংবাদিক ব্লামের ভাষ্য অনুযায়ী, এই তৎপরতার লক্ষ্য ছিল সমাজতান্ত্রিক নেতা হোসে মারিয়া ভেলাসকোর সরকারকে অস্থিতিশীল করা, যিনি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হারান। তার উত্তরসূরি কার্লোস হুলিও আরোসেমেনা মনরয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে কিউবার কাস্ত্রো সরকারের প্রতি সমর্থন জানানোর পর সামরিক অভ্যুত্থানের শিকার হন।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইকুয়েডরে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় সিআইএ’র কারিগরি সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। একই সময়ে, সিআইএ পেরুর সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সরবরাহ করে এবং দেশটির বামপন্থি গেরিলা আন্দোলনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সেনা সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়।

ব্রাজিলে সামরিক সরকার

ব্রাজিলে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সমর্থন নিয়ে বহু ইতিহাসবিদ গবেষণা করেছেন।
ব্রাজিলের কূটনৈতিক গবেষণা কেন্দ্র এসপাসো জেইদগেইস্ত-এর আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক রোমুলো দিয়াস বিবিসি নিউজ ব্রাজিলকে বলেন, সিআইএর কমিউনিজম প্রতিরোধের লড়াই প্রকাশ্যে নয়, বরং “গোপন অভিযান, নাশকতা, মনস্তাত্ত্বিক প্রচার এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে”।
নথিপত্রে দেখা যায়, ১৯৬১ সালে জোয়াও গুলার্ত প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে ব্রাজিলের রাজনীতির ওপর নিবিড় নজরদারি শুরু করে সিআইএ। বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা সীমিত করা এবং রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মতো সংস্কারমূলক কর্মসূচি নিয়ে গুলার্তের অবস্থান ও কিউবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে অস্বীকৃতি জানানো যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
সিআইএ গুলার্ত-বিরোধী সংসদ সদস্যদের প্রচারণায় অর্থায়ন করে এবং তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে প্রোপাগান্ডা চালায়।
এমন ইঙ্গিতও রয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীদের অর্থায়নে পরিচালিত একটি অ্যান্টি-কমিউনিস্ট সংগঠন— ব্রাজিলিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন (আইবিএডি)-এর সঙ্গে সেতুবন্ধনের কাজেও মধ্যস্থতা করেছিল সিআইএ। এই সংগঠনটি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল।
সিআইএ ১৯৬৪ সালের সামরিক অভ্যুত্থানে সহায়তার জন্য পরিচালিত ‘অপারেশন ব্রাদার স্যাম’-এও জড়িত ছিল। এই অভিযানের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিমানবাহী রণতরী ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর অনুমোদন দেয়, যদিও শেষ পর্যন্ত এই প্রচেষ্টা মাঝপথেই বাতিল করা হয়।

ডোমিনিকান রিপাবলিক

সিআইএর একটি অভ্যন্তরীণ চিঠিতে দাবি করা হয়েছে, ১৯৭৩ সালের এক তদন্তে উঠে আসে -ডোমিনিকান রিপাবলিকে ৩১ বছর শাসন করা স্বৈরশাসক রাফায়েল লিয়োনিদাস ত্রুহিইয়ো মোলিনার হত্যাকাণ্ডে জড়িত ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে সংস্থাটির “মোটামুটি বিস্তৃত” মাত্রায় সম্পৃক্ততা ছিল।
নথি অনুযায়ী, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রে সরকার পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে কাজ করেছিল সিআইএ।
১৯৬৩ সালে ক্ষমতায় এসে প্রেসিডেন্ট হুয়ান এমিলিও বোস গাভিনিয়ো কৃষি সংস্কার, সাশ্রয়ী আবাসন, বিদেশি বিনিয়োগে সীমাবদ্ধতা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রায়ত্ত করার পক্ষে অবস্থান নেন। তবে মাত্র এক বছর পর, সিআইএ’র সহায়তায় তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে দাবি করেন উইলিয়াম ব্লাম।
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা বোস সরকারের বৈধতা খর্ব করতে প্রোপাগান্ডায় অর্থ বিনিয়োগ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
“সিআইএ ব্যাপকভাবে কমিউনিস্টবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছিল, যার জন্য তারা ব্যবহার করেছিল বিভিন্ন মাধ্যম— যেমন সংবাদপত্র, রেডিও, চলচ্চিত্র, প্রচারপত্র, পোস্টার, লিফলেট ও দেয়ালচিত্র। এর মধ্যে ছিল ভীতিকর প্রচারণাও, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াতে সোভিয়েত ট্যাংক ও ফায়ারিং স্কোয়াডের ছবি ব্যবহার করা হতো,” ব্যাখ্যা করেন দোলোরেস গার্সিয়া।
বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা তাদের মালিকানাধীন সংবাদ সংস্থা বা রেডিও স্টেশন ব্যবহার করে এই প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিত। অনেক সময় এই প্রচারণায় মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হতো, যাতে করে পছন্দের প্রার্থীদের বিরোধীদের বদনাম করা যায় বা যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আড়াল করা যায়। বিবিসি বাংলা


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরও