ইতালির বেনিতো মুসোলিনি কিংবা জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারের মতো যুগে যুগে অনেক স্বৈরশাসকে দাপট দেখিয়েছেন। বিশ্ব ইতিহাসে স্বৈরশাসকেরা শক্তি এবং কঠোর শাসনের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, ক্ষমতার শিখরে ওঠার পরও তাদের জীবন প্রায়ই অস্থিরতা, ধ্বংস এবং বিতর্কে পূর্ণ হয়ে ওঠে। অনেক স্বৈরশাসক তার শাসনকালে ভয়ংকর যুদ্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং রাজনৈতিক দমন চালিয়েছেন। আবার শেষ জীবনে তাঁদের অধিকাংশকেই উত্থান ও পতনের নাটকীয় মোড়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিশ্বের প্রয়াত ও আলোচিত কয়েকজন স্বৈরশাসকের শেষ জীবন কেমন ছিল, তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
প্রভাত ডেস্ক: বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁরা অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে দেশ শাসন করেছিলেন। অনেকে বিরোধীদের ওপর দমন–পীড়ন চালিয়েছেন। এসব দাপুটে নেতাদের কারও কারও জীবনের শেষ সময়টা ছিল ভয়ংকর। তাঁরা ক্ষুব্ধ জনগণ বা প্রতিপক্ষের হাতে খুন হয়েছেন। আবার কারও কারও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কাউকে নিজ দেশেই করুণ পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। আবার কেউ কেউ জীবনের শেষ দিনগুলো বিদেশে নির্বাসনে থেকেছেন। বিশ্বের আলোচিত কয়েকজন স্বৈরশাসকের জীবনের শেষ সময়টা কেমন ছিল, তা জেনে নেওয়া যাক।
বেনিতো মুসোলিনি, ইতালি (১৮৮৩-১৯৪৫)
বেনিতো মুসোলিনি ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত ইতালির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনিকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করা হয়। কারণ, তত দিনে ইতালির জনগণ বুঝে গেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেশটির জয়ের আশা ক্ষীণ। রাজনীতি থেকে উৎখাত হওয়াটা মুসোলিনির পতনের সূচনাপর্ব ছিল। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ইতালির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হোটেল কাম্পো ইমপেরাটোরে কারাবন্দী রাখা হয়।
ওই বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুসোলিনি সেখানেই ছিলেন। জার্মান ছত্রীসেনারা তাঁকে উদ্ধার করে জার্মানিতে নিয়ে যান। পরে তাঁকে উত্তরাঞ্চলীয় ইতালির লোমবার্দি এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তবে তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাঁর শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। ১৯৪৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে মুসোলিনি বলেছিলেন, ‘সাত বছর আগে আমি একজন আকর্ষণীয় মানুষ ছিলাম। এখন আমি একটি নিথর দেহ।’
অ্যাডলফ হিটলার, জার্মানি (১৮৮৯-১৯৪৫)
জার্মানির স্বৈরশাসক অ্যাডলফ হিটলার ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি দেশটির চ্যান্সেলর হন। ১৯৪৫ সালে আত্মহত্যার আগপর্যন্ত তিনি শাসনক্ষমতায় ছিলেন। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে রুশ সেনারা যখন বার্লিনের দিকে এগোচ্ছিলেন, হিটলার তখন রাইখ চ্যান্সেলরি ভবনের নিচে থাকা একটি বাংকারে লুকিয়ে পড়েন। বাংকারে থেকেও একের পর এক খারাপ খবর পাচ্ছিলেন নিজেকে পরাক্রমশালী মনে করা এ নেতা।
এমন অবস্থায় হিটলার সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজের মতো করে মরবেন। মিত্র বেনিতো মুসোলিনির করুণ পরিণতি এবং তাঁর মৃতদেহকে অবমাননার বিষয়টি হিটলারকে ভাবিয়ে তুলেছিল। শেষরক্ষা হচ্ছে না বুঝতে পেরে আত্মহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন হিটলার।
১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল হিটলার এবং স্ত্রী ইভা ব্রাউন বাংকারের নিচের দিকে থাকা একটি কক্ষে যান। ধারণা করা হয়, ব্রাউন সায়ানাইড গ্রহণ করেন আর হিটলার নিজেকে নিজে গুলি করেন। হিটলারের লেফটেন্যান্টরা তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী মৃতদেহগুলো জ্বালিয়ে দেন। তবে মৃতদেহগুলো পুরোপুরিভাবে পোড়েনি। রুশ সেনারা দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়ার পর তা ধ্বংস করে দেন।
ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো, স্পেন (১৮৯২-১৯৭৫)
১৯৩৯ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগপর্যন্ত ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কো স্পেন শাসন করেছেন। তিনি বিরোধীদের ওপর দমন–পীড়ন চালিয়েছেন, রাজনৈতিক বন্দিশিবির গড়ে তুলেছেন এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। ফ্রাঙ্কোর বয়স যখন ৮০ ছুঁই-ছুঁই, তখন তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। অসুস্থ থাকার কারণে জীবনের শেষ সময়গুলোতে তিনি রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরে ছিলেন।
ফ্রাঙ্কোর পারকিনসনস রোগ হয়েছিল। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চলাফেরায় সমস্যা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩০ অক্টোবর তিনি কোমায় চলে যান। ওই বছরের ২০ নভেম্বর পর্যন্ত ফ্রাঙ্কো লাইফ সাপোর্টে বেঁচে ছিলেন। এরপর ৮২ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
পাপা ডক, হাইতি (১৯০৭-১৯৭১)
১৯৫৭ সালে ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়ে হাইতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ‘পাপা ডক’ নামেও পরিচিত ছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুতই পাপা ডক তাঁর ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে শুরু করেন। তিনি বিরোধী দলের সমর্থকদের নির্বাসনে পাঠান, রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর দমন–পীড়ন চালান। যে বা যাঁরাই তাঁকে ডিঙিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের হত্যার নির্দেশ দিতেন তিনি।
পাপা ডক ভুদু বা কালো জাদুবিদ্যার ধর্ম চর্চা করতেন। মাঝেমধ্যে তিনি তাঁর নিশানায় পড়ে ব্যক্তিদের শিরশ্ছেদও করতেন।
দুভালিয়ে নানা ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছিলেন। ১৯৫৯ সালে হার্ট অ্যাটাক করেন। দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিস এবং হৃদ্রোগসংক্রান্ত জটিলতায় ভুগে ১৯৭১ সালে দুভালিয়ে মারা যান।
কিম ইল–সাং, উত্তর কোরিয়া (১৯১২-১৯৯৪)
কিম ইল–সাং হলেন উত্তর কোরিয়ার প্রথম নেতা। তিনি ১৯৪৮ সালে দেশটির ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং পরিবারতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন। তাঁর নাতি কিম জং-উন এখন উত্তর কোরিয়ার শাসনক্ষমতায় আছেন। তবে কার্যত কিম ইল-সাং এখনো উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট। কারণ, কিম ইল–সাংয়ের মৃত্যুর পর ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে উত্তর কোরিয়ার চিরকালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
কিম ইল–সাংয়ের শাসনামলে উত্তর কোরিয়া অকল্পনীয়ভাবে বাইরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আশির দশকের শেষ দিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ফুটেজে দেখা যায়, তাঁর গলায় টিউমার হয়েছে। তিনি অবশ্য এমন ভঙ্গিমায় দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, যেন টিউমারটি দেখা না যায়।
শেষ পর্যন্ত হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে কিম ইল–সাং মারা যান। ১৯৯৪ সালের ৮ জুলাই এ নেতা হঠাৎ পড়ে যান এবং এর কয়েক ঘণ্টা পর মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
অগুস্তো পিনোশে, চিলি (১৯১৫-২০০৬)
অগুস্তো পিনোশে ১৯৭৩ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে চিলির ক্ষমতায় আসেন। তাঁর শাসনামলে বিরোধীদের হত্যা ও কারাবন্দী করা হয় এবং হাজারো নাগরিককে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ১৯৯০ সালে তিনি শান্তিপূর্ণভাবে পদত্যাগ করেন এবং নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পাত্রিসিও আইলউইন আজোকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
তবে পিনোশে ক্ষমতায় থাকাকালে করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো থেকে বাঁচতে পারেননি। ১৯৯৮ সালে গ্রেট ব্রিটেনে তাঁকে গৃহবন্দী রাখা হয়। হালকা ডিমেনশিয়াসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতার কারণে দুই বছর পর তাঁকে চিলিতে ফিরতে দেওয়া হয়।
এরপরও আইনি লড়াই চলতেই থাকে। পিনোশের স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটছিল তখন। ২০০৬ সালের ৩ ডিসেম্বর, ৩৬টি অপহরণ, ২৩টি নির্যাতন এবং ১টি হত্যার অভিযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত হওয়ার দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। ১০ ডিসেম্বর তিনি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে মারা যান। জীবদ্দশায় তাঁকে কোনো অভিযোগেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
নিকোলাই চসেস্কু, রোমানিয়া (১৯১৮-১৯৮৯)
রোমানিয়ার স্বৈরশাসক নিকোলাই চসেস্কু ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দেশটির শাসনক্ষমতায় ছিলেন। ওই বছরের বড় দিনে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৮৯ সালের সেই ডিসেম্বরে রোমানিয়ার জনগণের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব প্রবল ছিল। চসেস্কু ২১ ডিসেম্বর একটি (অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত) বক্তব্য দিয়ে জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।
পরের দিন উত্তেজিত জনতার দল পৌঁছানোর আগেই চসেস্কু এবং তাঁর স্ত্রী এলেনা হেলিকপ্টারে বুখারেস্ট থেকে পালিয়ে যান, তবে এই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ওই দম্পতিকে সেনাবাহিনী নিরাপত্তা হেফাজতে নেয়। জাতিগত নিধন ও দুর্নীতির অভিযোগে তাঁদের বিচারের মুখোমুখি করা হয় এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন জানানোর জন্য ১০ দিনের সময় রাখা হয়েছিল। ওই সময় শেষ হওয়ার পরপরই রায় কার্যকর করা হয়।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে ওই দম্পতির হাত বাঁধা হয় এবং তাঁদের একটি দেয়ালের সামনে দাঁড় করানো হয়। সেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে তাঁদের ওপর গুলি চালানো হয়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের দায়িত্বে থাকা দলটির সদস্য ডরিন-মারিয়ান সিরলান এই অভিজ্ঞতাকে ভয়ংকর বলে বর্ণনা করেন।
চসেস্কু সম্পর্কে সিরলান বলেন, ‘তিনি আমার চোখে চোখ রাখলেন এবং বুঝতে পারলেন যে তিনি তখনই মারা যাচ্ছেন, ভবিষ্যতে নয়। তারপর তিনি কাঁদতে শুরু করলেন।’
ইদি আমিন
ইদি আমিনের শাসনামলে উগান্ডায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। ১৯৭১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ইদি আমিন ১৯৭৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত ও নির্বাসিত হন। পরে তিনি সৌদি আরবের জেদ্দায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে বহু বছর আরামসে জীবন কাটিয়েছেন।
২০০৩ সালের জুলাইয়ে কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়ার কারণে ইদি আমিন কোমায় চলে যান এবং আগস্টের শুরুর দিকে মারা যান। মৃত্যুর সময় পঞ্চম স্ত্রী তাঁর পাশে ছিলেন। সে সময়কার সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনগুলোতে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির জন্য অতিরিক্ত ওজনকে অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। মৃত্যুর সময় তাঁর ওজন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল। তাঁর ওজন ছিল ৪৮৫ পাউন্ড (২২০ কিলোগ্রাম)।
সাদ্দাম হোসেন, ইরাক (১৯৩৭–২০০৬)
সাদ্দাম হোসেন ১৯৭৯ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইরাকের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯০ সালের আগস্টে ইরাকি সেনারা প্রতিবেশী কুয়েত দখল করেন। ধারণা করা হয়, সাদ্দামের উদ্দেশ্য ছিল কুয়েতের বিশাল তেল সম্পদ ব্যবহার করে ইরাকের অর্থনীতি শক্তিশালী করা। কিন্তু কুয়েত দখলের ফলে দ্রুতই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইরাকের ওপর বাণিজ্য অবরোধ কার্যকর করে। আন্তর্জাতিক চাপের পরও তিনি কুয়েত থেকে সেনা প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান।
১৯৯১ সালের ১৬ জানুয়ারি উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয়। ছয় সপ্তাহের মধ্যে শেষ হয়, সমন্বিত সামরিক জোট ইরাকের সেনাদের কুয়েত থেকে বের করে দেয়। ইরাকের এমন শোচনীয় পরাজয় দেশের অভ্যন্তরে শিয়া ও কুর্দিদের বিদ্রোহ উসকে দেয়, কিন্তু সাদ্দাম তাদের দমন করেন। ফলে হাজার হাজার মানুষ দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী শরণার্থীশিবিরে পালাতে বাধ্য হন। এর পাশাপাশি অনেক মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর তৎকালীন বুশ প্রশাসন অভিযোগ করে, সাদ্দাম সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করে থাকতে পারেন।
২০০৩ সালের ১৭ মার্চ সাদ্দামকে পদত্যাগ করতে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ইরাক ছাড়তে বলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। না হলে যুদ্ধের হুমকি দেন তিনি। সাদ্দাম এতে রাজি না হলে ২০০৩ সালের ২০ মার্চ ইরাকে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম ক্ষমতাচ্যুত হয়ে আত্মগোপনে চলে যান। ২০০৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর জন্মশহর তিকরিতের পাশে একটি সুড়ঙ্গ থেকে মার্কিন সেনারা তাঁকে আটক করেন। ২০০৫ সালের অক্টোবরে সাদ্দামের বিচার শুরু হয়। চলে টানা ৯ মাস। তাঁকে ইরাকের দুজাইল গ্রামে ১৯৮২ সালে শিয়া সম্প্রদায়ের ১৪৮ জনকে হত্যার অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়। ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর পবিত্র ঈদুল আজহার দিন রাজধানী বাগদাদে সাদ্দামের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি, লিবিয়া (১৯৪২–২০১১)
মুয়াম্মার গাদ্দাফি চার দশকের বেশি সময় ধরে লিবিয়া শাসন করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাজা ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং লিবিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেন। এরপর ২০১১ সাল পর্যন্ত লিবিয়ার শাসনক্ষমতায় ছিলেন।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রতিবেশী দেশ তিউনিসিয়া ও মিসরে প্রেসিডেন্টদের পদত্যাগের পর লিবিয়ার বেনগাজি শহরে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাদ্দাফি সরকার তা সহিংসভাবে দমন করার চেষ্টা করে।
পুলিশ ও ভাড়াটে বাহিনীগুলোকে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করতে বলা হয়।
গোলাবারুদ, যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে বিক্ষোভের স্থানগুলোতে হামলা চালানো হয়। বিভিন্ন দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ হামলার নিন্দা জানায়।
গাদ্দাফির সহিংস কৌশল লিবিয়া সরকারের কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে বিরক্ত করে তোলে। তাঁদের কেউ পদত্যাগ করেন, আবার কেউ বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন জানান।
২২ ফেব্রুয়ারি গাদ্দাফি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বক্তব্য দেন এবং তিনি পদত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বিক্ষোভকারীদের দেশদ্রোহী ও নাশকতাকারী বলে উল্লেখ করেন এবং অভিযোগ করেন, আল–কায়েদার নির্দেশনাতেই এমন বিক্ষোভ হচ্ছে।
২০১১ সালের আগস্টে বিদ্রোহী বাহিনী ত্রিপোলিতে প্রবেশ করে এবং শহরের বেশির ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয়। ২৩ আগস্ট বিদ্রোহীরা ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির সদর দপ্তর হিসেবে পরিচিত বাব আল-আজিজিয়া দখল করে। তবে তখনো গাদ্দাফির অবস্তান নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। তিনি একের পর এক অডিও বার্তা দিচ্ছিলেন এবং বিদ্রোহীদের মোকাবিলার করার জন্য লিবিয়ার জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
গাদ্দাফিকে খুঁজে বের করতে বিদ্রোহীরা ১৭ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর বিদ্রোহী বাহিনী সিরতে শহরের দখল নেয় এবং গাদ্দাফিকে সেখানেই পাওয়া যায়। পরে তিনি সেখানে নিহত হন।
আলবার্তো ফুজিমোরি, পেরু (১৯৩৮–২০২৪)
জাপানি বংশোদ্ভূত আলবার্তো ফুজিমোরি ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পেরুর শাসনক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ১৯৯০ সালের জুন মাসে পেরুর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ওই বছরের ৮ আগস্ট, অর্থাৎ দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে সরকারি খরচ কাঁটছাট করার মতো কঠোর অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেন। অথচ আগে তিনি এ ধরনের পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করতেন।
ফুজিমোরি পেট্রলের দাম তিন হাজার শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছিলেন। তাঁর এ কঠোর নীতিকে মানুষ ‘ফুজিশক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এ নীতির কারণে মূল্যস্ফীতি দূর হয়েছিল ঠিকই, তবে এতে অনেক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটে এবং দরিদ্র মানুষেরা অনেক দুর্ভোগের মুখে পড়েন।
২০০০ সালে দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে ফুজিমোরি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তিনি পেরু থেকে পালিয়ে জাপানে আশ্রয় নেন এবং পরে চিলিতে চলে যান। সেখানে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়। ২০০৭ সালে চিলি সরকার তাঁকে পেরুতে প্রত্যর্পণ করে। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক বিচারকাজ চলতে থাকে। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধসহ একাধিক অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন।
বিচারে ২৫ বছরের কারাদণ্ড হয় সাবেক এই প্রেসিডেন্টের। ২০১৭ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট অসুস্থতার কারণে ফুজিমোরিকে ক্ষমা করে দেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে তাঁকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। ২০২৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
সূত্র: লাইভ সায়েন্স, ব্রিটানিকা