• রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ০১:১৬ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের নির্বাচন: সংকট, প্রত্যাশা ও বাস্তবতার সেতুবন্ধন

প্রভাত রিপোর্ট / ১৬ বার
আপডেট : বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৫

মীর আব্দুর আলীম

নির্বাচন নিয়ে দোলাচলে বাংলাদেশ। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বাড়ছে অনিশ্চয়তা। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির নেতাদের একেক রকম সুর। মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে গিয়েও সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ পেল না বিএনপি। ফিরলেন হতাশ হয়ে। মির্জা ফখরুল স্পষ্ট—ডিসেম্বরে ভোট না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। জামায়াত বলছে, রমজানের আগেই চাই নির্বাচন। সময় গড়ালে বর্ষা, ঝড়-তুফান নয়, ভয়টা রাজনৈতিক। এদিকে এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলামের অভিযোগ, প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্কার, বিচার আর গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি তুলে কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চলছে। রাজনীতির আবহে স্পষ্ট-স্রেফ ভোট নয়, লড়াইটা এখন নিয়ন্ত্রণের।
এই বহুমুখী বক্তব্যের ভেতর লুকিয়ে আছে একটিই সত্য-ভোটকে ঘিরে অনিশ্চয়তা। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অনিশ্চয়তার দায় কার? সরকার বলবে, তারা তো নির্বাচন আয়োজনেই ব্যস্ত। বিরোধী দল বলবে, তারা রোডম্যাপ চায়, কিন্তু কেউ সে পথে হাঁটছে না। নির্বাচন কমিশন বলছে, ডিসেম্বরেই সম্ভাব্য তারিখ ধরে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই নির্বাচন নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছে, তার জবাব শুধু ক্যালেন্ডার দেখে দেওয়া যাবে না।
তবে-ভোট হোক, গোলমাল ছাড়াই হোক। আর জনগণ যেন অন্তত জানে তাদের ভোট কোথায় গেল, কিভাবে গেল। না হলে একদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে-“বাংলাদেশে ভোট হয়েছিল, তবে সেটা কে দেখেছিল, কেউ জানে না।”
বিএনপির হতাশা: রোডম্যাপ না পেলে কীসের পথচলা:
বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। তারা দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার অবস্থানে রয়েছে। এবার তারা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছিল। প্রত্যাশা ছিল অন্তত একটি প্রস্তাবনা—যাতে থাকবে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা, ভোটের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার বাস্তব পদক্ষেপ, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য সমান সুযোগ। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যেভাবে হতাশা প্রকাশ করলেন, তাতে স্পষ্ট যে, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান অনেক।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রকাশ্যেই বলেছেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে তারা কোনো নির্দিষ্ট ‘রোডম্যাপ’ পাননি। এতে করে তাদের মধ্যে যে আশাবাদ জেগেছিল, তা কিছুটা হলেও ম্লান হয়ে যায়। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, দলটি একদিকে নির্বাচন চায়, কিন্তু সেটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে না হলে নির্বাচনী পরিবেশকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করছে না। এই বক্তব্যে শুধু রাজনৈতিক অস্বস্তিই নয়, বরং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সংঘাতেরও ইঙ্গিত রয়েছে।
জামায়াতের হিসাব: সময়ের বাস্তবতা বনাম রাজনৈতিক আশঙ্কা-
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমির তারা দলের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরে জানিয়েছেন, তারা চান আগামী রমজানের আগেই নির্বাচন সম্পন্ন হোক। দলের আমিরের মতে, যদি নির্বাচন জুন পর্যন্ত পিছিয়ে যায়, তাহলে তা বর্ষা মৌসুম, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে পারে। ফলে নির্বাচন পরিচালনা কঠিন হয়ে উঠবে এবং দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও অবকাঠামোগত সক্ষমতার উপরও অতিরিক্ত চাপ পড়বে। এই বক্তব্য শুধু একটি সময় নির্ধারণের প্রস্তাব নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক বার্তা। এটি যেমন নির্বাচনের সময়সূচি নিয়ে একটি বাস্তববাদী যুক্তি তুলে ধরে, তেমনি নির্বাচনী ব্যবস্থার উপর দলটির গভীর অনাস্থা এবং সংশয়ের প্রতিফলন ঘটায়। তাদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে আশঙ্কা—নির্বাচন যদি বিলম্বিত হয়, তাহলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে এবং এতে করে স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে।
জামায়াতের মতো একটি রাজনৈতিক দল যখন সময় নির্ধারণকে কেন্দ্র করে সরাসরি অবস্থান নেয়, তখন বোঝা যায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি গভীর মতানৈক্য বিরাজ করছে-বিশেষ করে নির্বাচনের তারিখ ও প্রক্রিয়া নিয়ে। একপক্ষ বলছে তাড়াতাড়ি নির্বাচন দরকার, যাতে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে, অন্যপক্ষ হয়তো বলছে সময় নিয়ে একটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা জরুরি। এর মাঝখানে সৃষ্টি হচ্ছে সন্দেহ, সংকট ও অনিশ্চয়তার আবহ। এটি আমাদের দেখায়, বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, সময় ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক বাস্তবতা নিয়েও বড় ধরনের মতবিরোধ রয়েছে। এই মতপার্থক্য শুধুমাত্র কাগজে-কলমে নয়-এটি মাঠে-ময়দানে, আন্তর্জাতিক মহলে এবং সাধারণ জনগণের মনেও বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
এখানে প্রশ্ন হলো-এত মতপার্থক্যের মধ্যেও কিভাবে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব? এবং রাজনৈতিক দলগুলোর এই অনাস্থা কাটিয়ে কিভাবে একটি সমঝোতার দিকে এগোনো যাবে? যদি সে পথ খুঁজে না পাওয়া যায়, তবে নির্বাচনের তারিখ নয়—গণতন্ত্রই অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে।
নির্বাচনের কাঠামো পরিবর্তনের এনসিপির ভিন্নতর অবস্থান:
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করে বলেন, বর্তমান প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়, কারণ তিনি মনে করেন-প্রশাসনের একাংশ বিএনপির পক্ষেও কাজ করছে। এটি একটি ভিন্নধর্মী অভিমত, যেখানে শাসক দল নয়, বরং বিরোধী পক্ষকে প্রশাসনিক প্রভাবশালী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এনসিপি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দাবির কথা বলেছে-সংস্কার, বিচার এবং গণপরিষদ নির্বাচন। তারা চায় নির্বাচন ব্যবস্থায় কাঠামোগত পরিবর্তন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়-কে এই সংস্কার করবে? বিদ্যমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কি এই পরিবর্তন সম্ভব, নাকি সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক সমঝোতা প্রয়োজন?
এনসিপি তিনটি মৌলিক দাবি সামনে এনেছে: সংস্কার, বিচার এবং গণপরিষদ নির্বাচন। তারা চায়, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট সময়ের ‘নির্বাচন’ নয়, বরং একটি স্থায়ী ও কার্যকর কাঠামোগত সংস্কার—যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোও হবে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সর্বজনগ্রাহ্য। এনসিপি’র এই দাবি শুধু নির্বাচন নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থার গভীরে থাকা সমস্যার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়-এই কাঠামোগত পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব? বিদ্যমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কি এই সংস্কার বাস্তবায়নযোগ্য, নাকি এর জন্য প্রয়োজন একটি সম্পূর্ণ নতুন জাতীয় রাজনৈতিক সমঝোতা? বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় কোনো পক্ষই অন্য পক্ষের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এমতাবস্থায়, এনসিপির প্রস্তাবিত সংস্কার, বিচার এবং গণপরিষদ নির্বাচন কি কেবল কাগজে-কলমেই থাকবে? নাকি এগুলোর বাস্তবায়নের জন্য দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একটা সর্বদলীয় ঐকমত্যের পথে হাঁটতে হবে? এনসিপির অভিমত আমাদের মনে করিয়ে দেয়-নির্বাচন কেবল একটি তারিখ নির্ধারণের বিষয় নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণে একটি যুগান্তকারী সুযোগও হতে পারে। আর এই সুযোগ যদি পুনরাবৃত্তি ঘটানো প্রথাগত প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যায়, তবে পরিবর্তনের স্বপ্নও হয়তো কেবল স্লোগান হয়েই থেকে যাবে।
নির্বাচন নিয়ে জনগণের নিঃশব্দ প্রত্যাশা:
“ইউনুস সরকারই ভালো”-এ কথাটি আজকাল অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে। এটি শুধু একটি মন্তব্য নয়, বরং একধরনের হতাশার বহিঃপ্রকাশ। মানুষ আর বুঝতে পারছে না কে ভালো, কে খারাপ। প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, নেতাদের কথার মারপ্যাঁচ আর দোষারোপের রাজনীতি তাদের আস্থার জায়গা ভেঙে দিয়েছে। জনগণ আজ আর বড় আদর্শ নয়, বাস্তবতা চায়। চায় শান্তি, স্থিতিশীলতা, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ। তারা চায় না রাজনৈতিক হানাহানি কিংবা ভুয়া নির্বাচনের প্রহসন। তারা চায় এমন একটি সরকার, যার নেতৃত্বে ন্যায়বিচার, উন্নয়ন ও ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়-যেই আসুক, নাম তার যা-ই হোক।
এই মনোভাব আমাদের জন্য এক সতর্কবার্তা। রাজনীতিকে এখন লোক দেখানো প্রতিযোগিতা নয়, জনগণের আস্থার জায়গায় রূপ দিতে না পারলে “ইনুস সরকারই ভালো” হবে আগামী দিনের ভয়ংকরতম রাজনৈতিক ভাষ্য।
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি ও অদৃশ্য অনিশ্চয়তা:
এই পুরো দ্বন্দ্ব ও দাবি-দাওয়ার মাঝে নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, তারা চলতি বছরের ডিসেম্বর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকারের এই বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে আশ্বস্তকারী মনে হলেও, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও আস্থাহীনতার কারণে এই প্রস্তুতি কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। বাংলাদেশে এর আগেও আমরা দেখেছি, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি অনেক সময় রাজনৈতিক সমঝোতার অভাবে কাজে লাগেনি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের স্বার্থে প্রস্তুতির চেয়েও রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি।
নির্বাচন-বাংলাদেশে এ শব্দটি কেবল ভোটাধিকার প্রয়োগের নয়, বরং এটি এখন একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের, প্রতিরোধের, এমনকি রাষ্ট্র কাঠামোর গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের প্রতীক। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন এখন আর কেবল একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে গভীর শঙ্কা, দোলাচল এবং দ্বিধার প্রতীক। ১৯৯১ সালে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরায় সূচনার পর প্রতিটি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা গেলেও বর্তমান বাস্তবতা এক ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই শব্দটি হয়ে উঠেছে এমন এক মারণাস্ত্র, যা প্রয়োগের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে একাধিক পক্ষের মধ্যে। বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্বাচন কখনোই নিছক ভোট দেওয়ার প্রক্রিয়া ছিল না। এটি ছিল ক্ষমতা পুনর্নিধারণের একমাত্র শান্তিপূর্ণ উপায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন তা এক ধরনের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে-সেটা কখনো সড়কে, কখনো আদালতে, আবার কখনো-বা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাতেই।
এখন প্রশ্ন উঠেছে—কে ঠিক? কে ভুল? উত্তর সহজ নয়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, যদি সমঝোতার পথে না হাঁটা হয়, যদি জনগণের ভোটাধিকারকে সম্মান না করা হয়, তবে এই নির্বাচন শুধু একটি তারিখ হবে-নতুন সংঘাতের, নতুন অস্থিরতার, এবং নতুন করে দেশের গণতন্ত্রের প্রশ্নবিদ্ধ হবার। আজ আমরা এমন এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে সময়সীমা নিয়ে টানাটানি নয়, বরং সময়কে সামনে রেখে ঐক্যমত্য গঠন জরুরি। নির্বাচন একটি প্রক্রিয়া, তা যেন ‘যুদ্ধ’ না হয়ে ওঠে। রাজনীতিবিদদের প্রতি অনুরোধ-আপনারা একবার অন্তত দেশের মানুষের দিকে তাকান। তারা আর সংঘাত চায় না, তারা শান্তি চায়, প্রগতি চায়, একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চায়। আর তার জন্য চাই স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য এবং সর্বসম্মত একটি নির্বাচন।
অতীত থেকে শিক্ষা: ২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রেক্ষাপট-
এ কথা সত্র যে, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি আস্থা না থাকলে সাধারণ মানুষও ভোটে আগ্রহ হারায়, যার ফলাফল হয় কম ভোটার উপস্থিতি, প্রশ্নবিদ্ধ ম্যান্ডেট এবং দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিরতা। ২০১৪ সালের নির্বাচন দেশের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত অধ্যায়। বিএনপিসহ অধিকাংশ বিরোধী দল বর্জন করায় প্রায় ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভের নজির সৃষ্টি হয়। ফলাফল? গণতন্ত্রের আড়ালে একরকম ‘ইনস্টলড পার্লামেন্ট’ তৈরি হয়। ২০১৮ সালে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেও অভিযোগের শেষ ছিল না। প্রার্থী প্রত্যাহার, কেন্দ্র দখল, ফল ঘোষণায় বিলম্ব এবং ভোটের দিন ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধসহ নানা অভিযোগ উঠেছিল। এই অভিজ্ঞতা জনগণের মনে একটি গভীর অনাস্থা জন্ম দিয়েছে। তাই ২০২৪ বা ২০২৫-এর নির্বাচন যদি সেই পুরনো ছায়ার পুনরাবৃত্তি হয়, তবে তা কেবল একটি রাজনীতি নয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
কূটনৈতিকদের ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক চাপ:
বাংলাদেশের নির্বাটন নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সংস্থা স্বচ্ছ নির্বাচন চায়, কিন্তু তারা জানে-বাংলাদেশের রাজনীতি গভীরভাবে অভ্যন্তরীণভাবে বিভক্ত। তবে বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতা, ভূরাজনৈতিক হিসাব এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেতে হলে বাংলাদেশকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতেই হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।
তাহলে উপায় কী? প্রথমত, অবিলম্বে রাজনৈতিক সংলাপ প্রয়োজন—এমন এক প্ল্যাটফর্ম যেখানে সব দল নিজের কথা বলতে পারে এবং সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা জরুরি, যা সম্ভব নিরপেক্ষ ও দৃঢ় আচরণের মাধ্যমে। চতুর্থত, প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের গণতন্ত্র একটি সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাচন যেন আবারও সহিংসতা, ভীতি এবং অনিশ্চয়তার নাম না হয়। জনগণ চায় তাদের ভোটের অধিকার চর্চা করতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে, ভয়ের বাইরে থেকে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান—আসুন, কাঁধে কাঁধ রেখে জাতিকে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিই। না হলে এই অস্থিরতা আমাদের গণতন্ত্রের শিকড় উপড়ে ফেলবে—নেতৃত্ব নয়, দায়ভার তখন ইতিহাসের কাঁধে নয়, আমাদের কাঁধেই এসে পড়বে।
আমরা শুধু কামনা করতে পারি-ভোট হোক, গোলমাল ছাড়াই হোক, আর জনগণ যেন অন্তত জানে তাদের ভোট কোথায় গেল, কিভাবে গেল। না হলে একদিন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে-“বাংলাদেশে ভোট হয়েছিল, তবে সেটা কে দেখেছিল, কেউ জানে না।”
✍ লেখক: মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, জীবনমুখী লেখক, কলামিস্ট, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ। www.mirabdulalim.com

(এই বিভাগের প্রতিটি লেখা লেখকের বাক স্বাধীনতার প্রতিফলন। এ লেখার দায়িত্ব লেখকের নিজস্ব। এর জন্য পত্রিকা কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। )


আপনার মতামত লিখুন :
এই বিভাগের আরও