আরাফাত দাড়িয়া : ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপ, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, গুলি ও টায়ার জ্বালানোর মধ্য দিয়ে শেষ হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের অসহযোগ আন্দোলনের প্রথমদিন। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, সারাদেশে ঘটা এই সংঘর্ষে অনেক লোক মারা যান। আহত হয়েছেন শত শত ব্যক্তি। দফায় দফায় আইন শৃংলাবাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে গোটা দেশ স্থবির হয়ে পড়ে। রাজধানী ঢাকা এদিন ছিলো অচল। প্রতিটি প্রবেশমুখে ছাত্রদের আন্দোলন এবং বিভিন্ন অলি-গলির মুখে টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করেন বিক্ষোভকারীরা। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে সরকার গতকাল সন্ধ্যা ৬ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ ঘোষণা করে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীরা গতকাল কারফিউ প্রত্যাখান করে ‘মার্চ টু ঢাকা’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
ঢাকা মেডিকেলের একটি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় একশ’র উপরে ব্যক্তি আহত অবস্থায় এসে চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ রয়েছেন অনেকে। দুপুর বারোটার দিকে উত্তরায় ২২ জনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্বার করা হয়। সেখানে দুইজন মারা গেছেন বলে জানা গেছে। দুপুর একটার পর হাউজ বিল্ডিং জসিমউদ্দিন রোড পর্যন্ত দখলে নেন বিক্ষোভকারীরা। সে সময় আওয়ামী লীগের ক্যাম্পে ভাঙ্চুর করা হয়। মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে আইন শৃংখলাবাহিনী তখন কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছোঁড়ে। মোহাম্মদপুর বেরিবাধঁ এলাকায় জহুরের নামাজের পর রাস্তা দখলে নেন বিক্ষোভকারীরা। বেরিবাধঁ থেকে গাবতলী পর্যন্ত পুরোটা রাস্তাজুরে বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নেন।
রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মিদের সাথে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সোনারগাঁও মোড় থেকে কাওরানবাজার হয়ে শাহাবাগ পর্যন্ত দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। কাওরানবাজার এলাকায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মিরা অবস্থান নেন, আর শাহাবাগ ও বাংলামোটর এলাকায় বিক্ষোভকারীরা টায়ার জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধ করে। দুপুর ২টার পর সেই এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। শুরু হয় ইট পাটকেল নিক্ষেপ, এক পর্যায়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ে। সাউন্ড গ্রেনেডও মারতে দেখা গেছে আইন শৃংখলাবাহিনীকে। কাল সকাল থেকে যাত্রাবাড়ী ও রায়েরবাগ এলাকায় দুই পক্ষের অবস্থান শুরু হলে শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা। এ সময় কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এবং বিভিন্ন জায়গায় ভাঙচুরও করা হয়।
গ্রীন রোড এলাকায় কাল দুপুর বারোটা থেকে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়। বিভিন্ন অলি গলিতে রং তুলি দিয়ে সরকার বিরোধী স্লোগান আকের্ঁ তারা। স্লোগানে উল্লেখ্যযোগ্য অংশ ছিলো ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, এক দফা দাবি, গর্জে উঠো সবাই ইত্যাদি। বেলা ১১টার দিকে সায়েন্সল্যাব এলাকায় শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। রাস্তা অবরোধ করে তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীকে রাস্তার ডিভাইডার ভাঙতে দেখা গেছে। আইন শৃংখলাবাহিনী সে সময় দুরে অবস্থান নিলেও দুপুরের পর বিক্ষোভকারীদের মধ্য থেকে ইট পাটকেল ছুঁড়তে দেখা যায়।
ধীরে ধীরে আন্দোলনকারীরা শাহাবাগে জড়ো হতে থাকেন। মিছিলের স্লোগান ছিলো সরকারের পদত্যাগ। সেই সাথে শাহবাগ ছেড়ে কাউকে না যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয় মিছিল থেকে। তবে শাহাবাগ থানার সামনে পুলিশের অবস্থান থাকলেও মিছিলটি সেদিকে এগুয়নি। যদিও শাহাবাগে সকালে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মির সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। পরে কয়েকজন লোক লাঠিসোটা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে হামলা চালায়। হামলায় ২০টি অ্যাম্বুলেন্স এবং ১৫টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। হামলার এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা কর্মি ও বিক্ষোভকারীরা একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়েছেন। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতা কর্মিদের একটি মিছিলে বিক্ষোভকারীদের ধাওয়া দিলে তারা হাসপাতালের ভেতরে অবস্থান নেন। পরে তাদের খুঁজতে বিক্ষোভকারীরা হাসপাতালে অবস্থান নেয় এবং বিভিন্ন গাড়ি ভাঙচুর করেন।
আন্দোলনে উত্তাল ছিলো শাহাবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। রাজু ভাস্কর্য, শহীদ মিনারসহ চানখারপুল এলাকায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাদের দখলে ছিলো। তবে শাহাবাগের ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীরা অবস্থান নিলে এক পর্যায়ে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এক দফা দাবি আদায়ে আফতাবনগরের ইষ্ট ওয়েষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকের সামনে জড়ো হতে থাকেন। এ সময় মিছিল নিয়ে বাড্ডা হয়ে রামপুরা, মালিবাগ ঘুরে শাহাবাগের দিকে অগ্রসর হয় তারা। তাদের সাথে যোগ দেন শিক্ষার্থীদের অভিভাক এবং বিভিন্ন পেশার মানুষ। এছাড়া নবাবপুর, ইংলিশ রোড, চানখারপুল, সদরঘাটের বিভিন্ন পয়েন্টে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মি, পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে গতকাল দুপুর থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ব্রডব্যান্ডের লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়। কাল সন্ধ্যায় কারফিউ শুরু হলেও সন্ধ্যার পর নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা কিছু এলাকায় পুলিশের বাধার মুখে পড়ে বিক্ষোভকারীরা। এ সময় ফাঁকা গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ে আইন শৃংখলাবাহিনী।