প্রভাত রিপোর্ট : আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা কাটিয়ে অবশেষে সারাদেশে পুলিশের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। মাত্র ১১টি থানা বাদে দেশের সকল থানায় গতকাল সোমবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজে ফিরেছেন পুলিশ সদস্যরা। অবশিষ্ট ১১টি থানার কার্যক্রমও ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে শুরু হবে। পুলিশ সদরদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সারাদেশে সর্বমোট থানা রয়েছে ৬৩৯টি। এর মধ্যে ৬২৮টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুলিশ সদরদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, দেশের মেট্রোপলিটন এলাকার ১১০টি থানার মধ্যে ১০৮টি এবং জেলার ৫২৯টির মধ্যে ৫২০টি থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বলা হয়েছে, সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস্, আসবাবপত্রসহ অন্য সব সরঞ্জামাদি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় এসব থানার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। এদিকে থানা এবং কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদ নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের সাধারণ মানুষ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। লুট হওয়া অস্ত্র এবং গোলাবারুদ দ্রুত উদ্ধার করা না গেলে দেশে নাশকতা এবং খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়ে যেতে পারে। লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদের অধিকাংশই পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের হাতে রয়েছে বলে ধারণা করছেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা এবং গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। একজন সাবেক আইজিপি বলেন, এখন সর্বপ্রথম কাজ হওয়া উচিত থানাগুলোকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরিয়ে নেওয়া। থানাগুলো স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হলে জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। তখন অস্ত্র উদ্ধারে মনোযোগ দিতে পারবে পুলিশ। লুট হওয়া এসব অস্ত্র পুলিশের দ্বারাই উদ্ধার করা সম্ভব। কারণ সারা দেশে তাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক রয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা দেশের বিভিন্ন থানায় হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও লুটপাট করে বিভিন্ন মালামাল নিয়ে যায়। অনেক থানায় অগ্নিসংযোগ করে। বিক্ষুদ্ধ জনতার রোষালল থেকে পুরিত্রান পেতে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে থানা ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। অনেক থানা থেকে আগ্নেয়াস্ত্রও নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর আহবানের প্রেক্ষিতে কিছু আগ্নেয়া¯ জমা দেয়া হয়। এখনও কত অস্ত্র গোলাবারুদ বাইরে আছে তা নির্ণয়ের কাজ চলছে। পুলিশের অসংখ্য যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। থানার কার্যক্রম শুরু হলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে কত দিন লাগতে পারে তা অনিশ্চিত।
এদিকে সৃষ্ট অচলাবস্থা কাটিয়ে অবশেষে রাজধানীর সড়কে ফিরেছে পুলিশ সদস্যরা। গতকাল সোমবার সকালে ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে তাদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। পুলিশের পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষার্থীরাও কাজ করছেন। ট্রাফিক পুলিশদের কাজে ফেরার তথ্য নিশ্চিত করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ‘একটা ছন্দপতন হয়েছিল। আবার ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা কাজে যোগ দিয়েছেন। এ সপ্তাহের মধ্যে সবাই যোগ দেবেন বলে আশা করা যায়।’মুনিবুর রহমান বলেন, ‘আজ একটা আইস ব্রেকিং হলো।
রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নেমেছেন। এর মধ্যে মিরপুরের ১৫টি স্থানে, গুলশানে ৯টি স্থানে, উত্তরায় ৫ স্থানে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা নিয়ন্ত্রণ করছেন।’ গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় অনেক থানায় হামলা হয়। এরপর রাজধানীর থানাগুলো যেমন পুলিশশূন্য হয়ে যায় আবার ঢাকার রাস্তায়ও ট্রাফিক পুলিশ দেখা যায়নি।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের দিন পর্যন্ত দেশের ৪৫০টি থানা এবং ৭০টি পুলিশের স্থাপনায় হামলা হয়। লুট হয়েছে সহস্রাধিক অস্ত্র এবং বিপুল সংখ্যক গোলাবারুদ। পুলিশের গুলিতে আন্দোলনরত ছাত্র এবং সাধারণ জনতা নিহত হওয়ার প্রতিবাদে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে দেশব্যাপী এমন ভয়ঙ্কর ঘটনার সূত্রপাত হয়।
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, খোয়া যাওয়া অস্ত্রগুলো পুলিশ এবং র্যাব দ্রুত উদ্ধার করতে পারবে। কারণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কারা অপরাধী এ বিষয়টি পুলিশ এবং র্যাব খুব ভালো ভাবেই জানে। এ জন্য পুলিশকে দ্রুত তাদের স্বাভাবিক কাজে ফেরানো উচিত। যদিও এখনো খোয়া যাওয়া অস্ত্র এবং গোলাবারুদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এখনো তথ্য সংগ্রহ চলছে।
জানা গেছে, গত ১৯ জুলাই নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ছিনিয়ে নিয়ে যায় নয়জন জঙ্গিসহ ৮২৬ জন বন্দি। সাথে লুট করে নিয়ে যায় ৬৬টি রাইফেল, ১৯টি শটগান এবং ৮ হাজার ১৫০টি গুলি। পরবর্তীতে ৫০টি রাইফেল উদ্ধার করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। শেরপুর কারাগারে হামলা চালিয়ে ৫১৮ জন বন্দি ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। লুট করা হয়েছে ৬টি রাইফেল, ৩টি শটগান ৮৬৪ রাউন্ড রাইফেলের গুলি, ৩৩৬ রাউন্ড শটগানের গুলি। তবে এর মধ্যে অভিযান চালিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো একটি রাইফেল উদ্ধার করেছে। সাতক্ষীরা জেলা কারাগারে হামলা করে ৫৯৬ জন বন্দি ছিনিয়ে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। পরে্য ৪৫২ জন বন্দি স্বেচ্ছায় ফেরত এসেছেন। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০৯ জন বন্দিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। কারা সদর দপ্তরের অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল সুজাউর রহমান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, কারাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের বিষয়ে আমরা সেনাবাহিনীর সহায়তা চেয়েছি। চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি কারাগারে সেনা সদস্যদের অবস্থানের কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হয়েছে। আনসার সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের হামলায় তিনজন আনসার সদস্য প্রাণ হারান। তবে গত ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দায়িত্বরত দুজন আনসার সদস্য প্রাণ হারান। আনসার সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ ইফতেহার আলী বলেছেন, আমরা এখনো সিজার লিস্ট করতে পারিনি। তবে আমাদের দুজন সদস্য শহীদ হয়েছেন। দুটি অস্ত্র খোয়া গেছে।
অপরদিকে র্যাব-১১ এর একটি টিম গত ৫ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে ১টি চায়না রাইফেল (বাট ভাঙা), ১টি সিজেট পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড সিজেট পিস্তলের গুলি, ১টি গ্যাস গান, ৫টি গ্যাস সেল, ২১টি রাবার বুলেট, ২১টি লেড বল, ১টি এক নলাবন্দুক, ১টি রিভলবার, ১০ রাউন্ড রিভলবারের গুলি, ৪টি সাউন্ড গ্রেনেড, ৩টি হ্যান্ডকাপ, ২টি মোটরসাইকেল, ১টি ডিভিআরসহ লুট হওয়া বিভিন্ন সরকারি জিনিসপত্র উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। গত শুক্রবার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-১১ এর একটি টিম সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকা থেকে এগুলো উদ্ধার করে। এর বাইরে গণমাধ্যমে আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো বার্তায় জানানো হয়েছে, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানা ও কারাগার হতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাটের কিছু ঘটনা ঘটেছে। এক্ষেত্রে কারও কাছে রক্ষিত এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ অথবা এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য থাকলে অতি দ্রুত নিকটস্থ সেনা ক্যাম্পে জমা অথবা যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।