প্রভাত রিপোর্ট : শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই আত্মগোপনে চলে গেছে ১২ সিটি করপোরেশনের মেয়রসহ প্রায় ৫শ কাউন্সিলর। অফিসে আসছেন না সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। ফলে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নগরীগুলোর রাস্তাঘাটে ইটপাটকেল ও ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনার অংশবিশেষ পড়ে আছে। এগুলো অপসারণ এবং মেরামতের কোনো ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্বশীল কর্মকর্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। চলমান ডেঙ্গুর মৌসুমে মশকনিধন কার্যক্রমেও গতি না থাকায় মশাবাহিত এ রোগে চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনেই আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২ হাজার মানুষ।
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের প্রায় সব কটিতেই মেয়র-ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে রয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা। ১২টি সিটি করপোরেশনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর মিলেয়ে ৬১৯ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। যার মধ্যে ৪৮৭ জনই আত্মগোপনে রয়েছেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগে-পরে এসব মেয়র-কাউন্সিলরও আত্মগোপনে চলে যান। অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব পর্যায়ে কাজ শুরু হলেও ফিরছেন না নগর এলাকার গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রতিনিধিরা। এতে নাগরিক সেবা কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের দলীয় পদে থাকায় কাউন্সিলরদের অনেককেই মাঠে থাকতে হয়েছে। অনেকেই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের প্রতিহত করার ঘোষণাও দেন। তা ছাড়া ক্ষমতায় থাকাকালে ১৫ বছরে অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে নানা অন্যায় ও অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। নাগরিক ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানির অভিযোগও আছে কয়েকজনের বিরুদ্ধে। যার ফলে নিজ থেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের মধ্যে রংপুর এবং গাজীপুর ছাড়া বাকি ১০টিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা মেয়র পদে রয়েছেন। এর মধ্যে শুধু রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান অফিস করছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জায়েদা খাতুনও অফিসে যাচ্ছেন না। তিনি নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা।
শেখ হাসিনা দেশ ছাড়ার আগেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সিঙ্গাপুর চলে যান। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম দেশে থাকলেও নগর ভবনে আসছেন না। এই দুই মেয়রের দপ্তরও বন্ধ। ফলে রাজধানীর নাগরিক সেবাদানকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মেয়রঘেঁষা বা দলীয় পরিচয়ে যেসব কর্মকর্তা এত দিন নগরভবন দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, তারাও গা ঢাকা দিয়েছেন। এতে প্রতিষ্ঠান দুটিতে এক প্রকার অচলাবস্থা দেখা দেয়।
এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে সম্প্রতি সব কাউন্সিলরকে নিয়ে সভা আহ্বান করেন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান। কিন্তু তাতে প্যানেল মেয়রসহ ৬৫ কাউন্সিলরই অনুপস্থিত ছিলেন। পরে বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত ১০ কাউন্সিলরকে নিয়ে বর্জ্য অপসরাণ, মশানিধন ও সড়কবাতি সচল রাখার কাজ শুরু হয়। এর বাইরে সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের দুজন কাউন্সিলর এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন বলে জানা গেছে।
ডিএসসিসির ৭৫ ওয়ার্ডে ৮ জন কাউন্সিলর ছাড়া সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ২৫টি সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের মধ্যে চারজন রয়েছেন বিএনপির। এই ১২ জন ছাড়া এলাকার কোনো কর্মকা-ে কাউন্সিলরদের দেখা মিলছে না। অন্যদিকে ডিএনসিসির ৫৪ ওয়ার্ডের মধ্যে দুজন বিএনপির এবং একজন জাতীয় পার্টির (রওশন) কাউন্সিলর রয়েছেন। আর সংরক্ষিত ১৮ ওয়ার্ডের মধ্যে বিএনপির নারী কাউন্সিলর আছেন দুজন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মেয়র-কাউন্সিলর মিলিয়ে ১৭৪ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। যার মধ্যে মাঠে আছেন মাত্র ১৭ জন। একইভাবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র-কাউন্সিলর মিলিয়ে ৪৬ জনের কেউ এলাকায় প্রকাশ্যে আসছেন না। খুলনা সিটি করপোরেশনের ৩১ ওয়ার্ডের মধ্যে মেয়র-কাউন্সিলরসহ ২২ জন জনসম্মুখে আসছেন না। বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৩০ ওয়ার্ডের মধ্যে মেয়রসহ ২৬ জনকে দেখা যাচ্ছেনা। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরসহ জনপ্রতিনিধি রয়েছেন ৪১ জন। এর মধ্যে বিএনপির ৪ ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ২ সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এবং জামায়াতে ইসলামীর ২ সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর এলাকায় আছেন। বাকি ৩২ জন আত্মগোপনে চলে গেছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে মেয়র-কাউন্সিলর মিলিয়ে ৭৭ জন জনপ্রনিধি রয়েছেন। যাদের মধ্যে ১৩ জন বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর এলাকায় রয়েছেন। মেয়রসহ বাকি ৬৪ জন জনপ্রতিনিধির দেখা পাচ্ছেন না নাগরিকরা। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ৩৩টি ওয়ার্ডে ৪৫ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। এর মধ্যে ৩৯ জন জনপ্রতিনিধি এলাকায় প্রকাশ্যে আসছেন না। সিলেট সিটি করপোরেশনের ৪২ ওয়ার্ডে ৫৪ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। এর মধ্যে মেয়রসহ ৩১ জন জনপ্রতিনিধি এলাকায় প্রকাশ্যে আসছেন না। তবে বিএনপি-জামায়তপন্থি ২৬ কাউন্সিলর এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র-কাউন্সিলরসহ ৩৭ জন জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির ১৪ এবং বাসদের একজন কাউন্সিলর এলাকায় রয়েছেন। মেয়রসহ ১৭ জনকে দেখা যাচ্ছেনা। এই ১৭ জনের মধ্যে জাতীয় পার্টির এক নেতাও রয়েছেন।
রংপুর সিটি করপোরেশনের ৪৫ জনপ্রতিনিধির মধ্যে বেশিরভাগই এলাকায় উপস্থিত আছেন। তাদের মধ্যে মেয়র মোস্তাফিজার রহমান, বিএনপির ৪ কাউন্সিলর, জামায়াতের ২ কাউন্সিলর, জাতীয় পার্টি ও বাসদের ১ জন করে কাউন্সিলর এবং সতন্ত্র ১৪ কাউন্সিলর এলাকায় আছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ১৯ কাউন্সিলরকে এলাকায় দেখছেন না কেউ।