প্রভাত রিপোর্ট : বিপিসি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ৫৯ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে ৩০ লাখ ৮০ মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল জি-টু-জি চুক্তির আওতায় এবং ২৮ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আমদানি করা হবে। এর বাইরে ১৪ লাখ মেট্রিক টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিপিসি। পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মধ্যে ডিজেল, মোগ্যাস, জেট এ-১, ফার্নেস অয়েল এবং মেরিন ফুয়েল রয়েছে।
প্রসঙ্গত, জি-টু-জির (সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি) আওতায় মোট আমদানির অর্ধেক এবং বাকি অর্ধেক আমদানি হয় আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে। বর্তমানে মালয়েশিয়ার পেটকো ট্রেডিং লাবুয়ান কোম্পানি লিমিটেড (পিটিএলসিএল), চায়নার পেট্রোচায়না ইন্টারন্যাশনাল (সিঙ্গাপুর) প্রাইভেট লিমিটেড ও ইউনিপেক সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড, আরব আমিরাতের অ্যামিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (ইএনওসি), ইন্দোনেশিয়ার পিটি ভূমি ছিয়াক পোছাকো (বিএসপি), থাইল্যান্ডের পিটিটি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং প্রাইভেট লিমিটেড, ভারতের নুমালিগার রিফাইনারি লিমিটেড (এনআরএল) ও ইন্ডিয়ান অয়েল করপোরেশন লিমিটেড (আইওসিএল), সিঙ্গাপুরের ভিটল এশিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে জি-টু-জির আওতায় পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি হয়ে থাকে।
অপরিশোধিত জ্বালানি তেল অ্যারাবিয়ান লাইট ক্রুড অয়েল (এএলসি) আমদানি করা হয় সৌদি অ্যারাবিয়ান অয়েল কোম্পানি (সৌদি আরামকো) থেকে এবং মারবান ক্রুড অয়েল আবুধাবি ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি (এডনক) থেকে আমদানি করা হয়।
বিপিসির হিসাব শাখার তথ্য অনুযায়ী, বিদায়ি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার জ্বালানি তেল বিক্রি হয়েছে। প্রতি মাসে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার তেল বিক্রি হয়। প্রতি মাসে এর চেয়ে কিছু পরিমাণ কম মূল্যের তেল আমদানি করতে হচ্ছে। অর্থাৎ তেল বিক্রির টাকা দিয়েই লাভ রেখে তেল আমদানি করা সম্ভব। এছাড়া ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে ঋণ নিয়েও তেল আমদানির কিছু অংশের বিল পরিশোধ করা হয়। এর পরও ডলার সংকটের কারণে সরবরাহকারীদের বকেয়া বিল পরিশোধ করা যাচ্ছে না।
ডলার সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল সরবরাহকারীদের বকেয়া বিল পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটির কাছে বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনার পরিমাণ ৫০ কোটি ৫০ হাজার মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে আমদানিকৃত পরিশোধিত ও অপরিশোধিত তেলের দাম পরিশোধ না করলে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে নির্ধারিত সময়ে তেল আমদানি করা যাবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিপিসি এবং তেল বিপণনকারী তিনটি কোম্পানি সূত্রে জানা যায়, দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৯২ শতাংশ আমদানি করা হয়। নিয়মিত খুচরা মূল্য সমন্বয় করায় বর্তমানে প্রতি মাসে তেল বিক্রি থেকে যে পরিমাণ টাকা আয় হয় তা দিয়েই আমদানি বিল পরিশোধ করা সম্ভব। বরং বিক্রীত অর্থ থেকে কিছু লাভও হয় বিপিসি এবং বিপণনকারী কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা অয়েলের। কিন্তু আমদানি হয় মার্কিন ডলারে। আর দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি থাকায় সময় মতো নির্ধারিত পরিমাণ বিল পরিশোধ করতে পারছে না বিপিসি। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে ধারাবাহিক যোগাযোগ করেও প্রয়োজনীয় ডলার সংস্থান হচ্ছে না। বিদ্যমান বকেয়া বিল পরিশোধ না করলে বাংলাদেশের কাছে তেল বিক্রি করবে না বলে ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে কয়েকটি বিদেশি কোম্পানি।
গত সপ্তাহে তেলের চাহিদা, উৎস, আমদানি ও সরবরাহ সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগে জমা দেয় বিপিসি। এটি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে উপস্থাপনের কথা রয়েছে বলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। গত ৮ আগস্টে তৈরিকৃত ঐ সারসংক্ষেপে জানানো হয়, চলতি আগস্ট মাসের অবশিষ্ট সময়ে ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল, ২০ হাজার মেট্রিক টন জেট ফুয়েল এবং ২৫ হাজার মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল (বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত তেল) আমদানি করা হবে। সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন ডিজেল, ৬৫ হাজার মেট্রিক টন জেট ফুয়েল, ২৫ হাজার মেট্রিক টন অকটেন এবং ৭৫ হাজার মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বর্তমান মূল্য পরিশোধ পরিস্থিতির কারণে সেপ্টেম্বর মাসের আমদানি সূচির বিষয়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।
হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ আগস্ট পর্যন্ত দেশে মজুত ছিল ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭১ মেট্রিক টন ডিজেল, ৫৬ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন জেট ফুয়েল, ৩৭ হাজার ১৭০ মেট্রিক টন অকটেন, ২ লাখ ৩৩ হাজার ৮৪ মেট্রিক টন পেট্রোল এবং ৫৮ হাজার ৭৭৭ মেট্রিক টন ফার্নেস অয়েল। বিপিসির এক কর্মকর্তা জানান, গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত যে মজুত তা দিয়ে ৩৩ দিনের ডিজেল, ১৫ দিনের অকটেন ও ১৪ দিনের পেট্রোল চাহিদা মেটানো যাবে। যদিও জ্বালানি নীতি অনুযায়ী, দেশে ৬০ দিনের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেলের মজুত থাকার কথা। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মজুত রাখা হতো।
জ্বালানি ও খনিজ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ডলার সংকট দেখা দেয়ার পরও গত দুই বছর ধরে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর বকেয়া ২০০ মিলিয়ন ডলারে সীমাবদ্ধ রাখা যেত, যা নিয়েও হিমশিম খেতে হচ্ছিল বিপিসিকে। গত কয়েক মাসে এটি বেড়ে এখন ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে দফায় দফায় বৈঠক করে ও চিঠি দিয়েও ডলার সংস্থান হচ্ছে না। এমন অবস্থায় দিশাহীন অবস্থায় বিপিসি। শিগগিরই ডলার সংস্থান করা না গেলে বা সরবরাহকারীদের বিলম্বিত অর্থ পরিশোধে সম্মত করা না গেলে জ্বালানি সংকট তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আশঙ্কা সত্যি হলে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন আরও কমে যাবে। পরিবহন খাতও পাবে না প্রয়োজনীয় জ্বালানিÍঅকটেন, পেট্রোল ও ডিজেল।