সম্পাদকীয় : এখনও নানা কর্মসূচি পালন করছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এর আগে ৪ দফা দাবিতে সারাদেশে সপ্তাহব্যাপী ‘রেজিস্ট্যান্স উইক’ কর্মসূচি পালন করা হয়। এর আগে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৬ আগস্ট পালিত হয়েছে ‘স্ট্যান্ড উইথ দ্য ইনজুরড’ কর্মসূচি। আহতদের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে ডাক দেয়া এ কর্মসূচির বিজ্ঞপ্তিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম এক সমন্বয়ক সরকারকে আহ্বান জানান অতিদ্রুত সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা নিশ্চিত করার। কর্মসূচিটি পালনকালীন আন্দোলন ঘিরে আহতদের এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিত ও তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে না পারাকে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেন অন্য এক সমন্বয়ক। পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান পদক্ষেপ আশা করেন ওই সমন্বয়ক। এরই মধ্যে গণ-আন্দোলন চলাকালে সংঘর্ষ ও সংঘাতে আহত ব্যক্তিদের সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয় বহন করবে সরকার বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। যদিও প্রত্যাশা ছিল সরকার গঠনের পর পরই নতুন সরকার এই বিষয়কে অগ্রাধিকার দেবে। কিন্তু কথায় আছে, কখনও না হওয়ার চেয়ে দেরিতে হওয়া ভালো।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতার চিকিৎসায় আপাতত বিল গ্রহণ না করতে অনুরোধও জানিয়েছে; প্রয়োজনে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্র-জনতার সব বিল সরকার বহন করবে। আহত শিক্ষার্থীদের সুচিকিৎসার লক্ষ্যে বিশেষায়িত ডেডিকেটেড কেয়ার ইউনিট গঠন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এতে আহতদের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আমরা প্রত্যাশা রাখি কেবল ঘোষণা নয়, আন্দোলনে আহত সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে সরকার। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নেয়ার পরও অনেকের চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রত্যেক রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কাজ করে যেতে হবে। প্রয়োজনে বিদেশে চিকিৎসার জন্য তাদের পাঠাতে হবে। সরকারকে এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার। আবার কেবল চিকিৎসার ব্যয় বহন করলেই হবে না। দীর্ঘমেয়াদে আহতদের দায়দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত-সহিংসতায় আহত ও তাদের স্বজনদের চোখ-মুখে এখন কেবলই দুশ্চিন্তার ছাপ। আদতে আহতরা আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেনÑ এমন অন্তত ১০ শিক্ষার্থীর পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে গণমাধ্যমের। সেসব পরিবারের সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছেন অভিভাবকরা। কেউ জানেন না তাদের সন্তান স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা। এখনো অনেকের শরীরে গুলি রয়ে গেছে। আহতদের কারো হাতের ওপরের অংশে গুলি লেগেছে, যেটি বের করা যায়নি। গুলিবিদ্ধ কারো হাতে চেতনা ফেরেনি। কারো পরিবার পুরো চিকিৎসার ব্যয় করছে ঋণ করে। কেউ মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে আছে নিথর দেহেÑ কথা বলতে পারে না, খেতেও পারে না। ডাক্তারও জানেন না যে তারা সবাই কবে স্বাভাবিক হবে কিংবা আদৌ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারো হয়তো স্মৃতিশক্তিও আর ফিরে আসবে না। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের প্রাথমিক এক বিশ্লেষণে বলা হয়, বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ঘটনা কেন্দ্র করে সংঘাত, সহিংসতায় ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৬৫০ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ৪০০ জন এবং ৫ ও ৬ আগস্ট ২৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আহত হয়েছে অজস্র মানুষ।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যমতে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভ এবং পরবর্তী সহিংসতার সামগ্রিক প্রতিক্রিয়ায় অপ্রয়োজনীয় ও অসংগতিপূর্ণ বল প্রয়োগ করেছে। রাবার বুলেট, সাউন্ড গ্রেনেড ও প্রাণঘাতী গোলাবারুদসহ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বার্ডশট পেলেটস ও বুলেট। এমন বর্বর আক্রমণের শিকার যারা তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে শিগগিরই সেরে উঠবেনÑ এটি প্রত্যাশা করা কঠিন। বাকি জীবন হয়তো এক ধরনের পঙ্গুত্ব শিকার করেই কাটাতে হবে। অনেকে হয়তো তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেয়া। অন্তত চিকিৎসার অভাবে যেন আর কেউ মারা না যান এবং অসহায় জীবন অতিক্রম করতে না হয়। প্রয়োজনে তাদের জীবিকা নির্বাহের ব্যবস্থাও করে দিতে হবে। রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। যাদের আত্মত্যাগের ওপর রাষ্ট্র সংস্কারের সুযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাদের জীবন কিছুটা হলেও যেন সহজ হয় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টায়।
বলাই বাহুল্য যে, এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতন-পরবর্তী সহিংসতায় সারা দেশে আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে। চিকিৎসা শেষে বেশির ভাগই ছাড়পত্র নিয়ে চলেও গেছে এরই মধ্যে। তবে গুরুতর আহতদের অনেকেই এখনও চিকিৎসাধীন। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর ৬টি বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালে আন্দোলন ঘিরে আহত ২ শতাধিক রোগী বর্তমানে চিকিৎসাধীন। তাদের প্রায় সবাই গুলিবিদ্ধ। এর মধ্যে কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক, আবার কারও প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। জানা যায়, জীবন বাঁচাতে বেশ কয়েকজনের হাত ও পা কেটে ফেলা হয়েছে। চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় ও আঘাত পেয়ে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে অনেকে। এসব রোগীদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র, পোশাক শ্রমিক, দিনমজুর, শিশুসহ নানা বয়স ও শ্রেণী-পেশার মানুষ। এদের কারোরই আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। ফলে হাসপাতাল থেকেই তাদের যাবতীয় চিকিৎসা ব্যয় বহন করা হচ্ছে। এমনইভাবে সরকার সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে বলেই সবার প্রত্যাশা।