আরাফাত দাড়িয়া : এই মূহুর্তে কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ। গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একের পর এক বেরিয়ে আসছে অর্থনীতির নানান দুর্নীতির চিত্র। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার বাজারে অস্থিরতা, ঋণের পাহাড়সহ নানাবিধ অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ। এর মধ্যে জানা গেল, আইসিটি খাতের একটি প্রকল্প থেকে দুর্নীতি করা হয়েছে দেড়শো কোটি টাকা! বিষয়টি নজরে আসার পর তোলপাড় শুরু হয় আইসিটি বিভাগে। তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একটি প্রতিষ্ঠানকে বিনিময় অ্যাপ এ প্রকল্পের কাজটি দেন। গত নভেম্বরে দুই বছরের জন্য কাজটি দেয়া হলেও পুরো টাকা পরিশোধের পরও কোন কাজ এগোয়নি। উল্টো, অর্থনীতির মন্দা বাজারে এই টাকা খরচ করে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করা হয়েছে বলে মনে করেন প্রযুক্তিবিদিরা।
ওই সময় বিনিময় অ্যাপ ঘটা করে উদ্বোধন করা হয়। এই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য ছিলো আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিশাল সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া। বলা হয়েছিলো নতুন এই ‘বিনিময় অ্যাপে’র মাধ্যমে এক অ্যাপ থেকে আরেক অ্যাপে খুব সহজেই লেনদেন করা যাবে। কিন্তু আদৌ সেটি সম্ভব হয়নি। ব্যাংক থেকে ব্যাংক বা এ এভসের মাধ্যমে একটি সুযোগ তৈরি করতে ন্যাশনাল পেমেন্ট সিজ নামে বাংলাদেশ একটি অ্যাপ চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে লেনদেনে কোন বাড়তি চার্জ দিতে হতো না গ্রাহকদের। কিন্তু সেই অ্যাপটি অকার্য করে বিনিময় অ্যাপ চালু করে আইসিসিট বিভাগ। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, বিপুল অর্থ ব্যয়ে মাধ্যমে তৈরি করা হয় এই অ্যাপ। আর এর মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয় গ্রাহকের।
প্রযুক্তিবিদ ফাহিম মাশরুর এ প্রসংগে বলেন, সবচেয়ে বড় কথা এখানে যে শুধু টাকা অপচয় হয়েছে তা নয়। এখানে আমাদের সাধারণ যে গ্রাহক রয়েছে যাদেরকে আমরা তিন বছর আগে যে সার্ভিসটা দিতে পারতাম ওটা দিতে পারিনি। সেটা বর্ধিত করে নতুন অ্যাপ চালু করা হয়। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজটি দেয়া হয়। যেটি দুই বছরের মধ্যে শেষ করা কথা ছিলো। গতবছর এটির উদ্ভোধন হলেও এর কোন সুফল পাওয়া যায়নি। মূলত এই অ্যাপের কোন ব্যবহারই হয়নি।
জানা গেছে, বিনিময় প্ল্যাটফর্ম হলো একটি অ্যাপ। অ্যাপটি বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন অ্যাকাডেমি (আইডিয়া) প্রকল্প এটি তৈরি করেছে। তখন এটি তৈরি করতে খরচ ধরা হয়েছিলো ৬৫ কোটি টাকা। এরও আগে এই প্রকল্পের বাজেট ছিলো মাত্র ৫৫ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন খাতে খরচ দেখিয়ে বাজেটের পরিমান বাড়ানো হয়, আর সেটি ঠেকে দেড়শো কোটি টাকায়। অ্যাপটি তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য ওরিয়ন ইনফরমেটিকস লিমিটেড, মাইক্রোসফট বাংলাদেশ লিমিটেড, ফিনটেক সলিউশন লিমিটেড ও সেইন ভেঞ্চারার্স লিমিটেড সমূহ প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু শেষমেষ সেই প্রকল্প শুরুতেই বন্ধ হয়ে যায়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিপুল অংকের টাকার প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রসংগে বলেন, উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সর্বনি¤œ দরে সর্বোচ্চ মানের প্রোডাক্ট সার্ভিস পাওয়ার বাধ্য বাধকতা রয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের মতো আইসিসি বিভাগও সেটি খর্ব করেছে। এটির জন্য যারা দায়ি তাদের জবাবদিহি করতে হবে এবং এই জবাবদিহিটা নিশ্চিত করাটা অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি। এবং সেটার সুযোগ কিন্তু এখন রয়েছে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলের প্রতিষ্ঠানকে বিনিময় অ্যাপ প্রকল্পের কাজটি দেয়া হয়। আইসিটি বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, শুধু বিনিময় অ্যাপ নয় আইসিটি খাতের আরো অনেক প্রকল্প রয়েছে যেগুলো শুরু থেকে দুর্নীতি করা হয়েছে। লোপাট করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা। তাই এখুনি এসবের অনুসন্ধান করা জরুরি বলে মনে করেন প্রযুক্তিবিদরা। জানা গেছে, গত ১৫ বছরে এই খাতের মাধ্যমে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ নেয়া হয়। মোট ব্যয়ের বড় অংশই অবকাঠামোর খাতে খরচ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।