প্রভাত বাণিজ্য : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিভিন্ন প্রাথমিক পণ্যের আমদানি হ্রাস পেয়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। একই সময়ে পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। সিমেন্ট শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল ক্লিঙ্কার আমদানিতে বড় ধরনের পতন দেখা গেছে। ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছিল নির্মাণ খাতের অন্যতম এ পণ্যের। প্লাস্টিক, রাবার এবং লোহা ও স্টিলজাতীয় পণ্যের আমদানিও ১০ শতাংশের বেশি হ্রাস পেয়েছিল। সব মিলিয়ে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমেছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারলে অনেক খাতের জন্য টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন ড. মুস্তফা কে মুজেরী। তিনি বলেন, ‘আমরা আমদানিনির্ভর অর্থনীতির দেশ। তাই মান ও দামে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে না পারলে বিশ্বায়নের যুগে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। তাই এসব শিল্পকে দক্ষ হওয়ার জন্য যা যা করণীয় তা করতে হবে।’
বিবিএস বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে বৃহৎ উৎপাদনশীল খাতের মধ্যে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে নেমে আসে টেক্সটাইল, ইঞ্জিনচালিত পরিবহন, পরিবহন যন্ত্রাংশ, ফার্নিচার এবং কাঠ ও কাঠজাতীয় পণ্য খাত।
কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশের শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধিতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও পরে তা আর ধরে রাখা যায়নি। সর্বশেষ গত তিন অর্থবছরে দেশের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ খাতের প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমে আসছে। এ সময়ে বিনিয়োগ, প্রাথমিক পণ্য আমদানি ও বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। সিমেন্ট শিল্পের ক্লিঙ্কার, টেক্সটাইল ও ইঞ্জিনচালিত মোটর শিল্পের উৎপাদনও নেতিবাচক ধারায় নেমে এসেছে। কাঠ ও ফার্নিচার জাতীয় বিলাসপণ্যের বাজারেও ছিল ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত জাতীয় হিসাব পরিসংখ্যান ২০২৪-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের জন্য অনেকটাই প্রতিকূল হয়ে উঠেছিল। এ সময় বিনিয়োগ না বাড়ায় শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়েনি। ব্যাংক ঋণ নিয়ে টাকা পাচারও করেছে অনেকে। সার্বিক উৎপাদন খাতকে চাপে ফেলেছিল যথাযথ বিনিয়োগ পরিবেশের অভাব, ঋণখেলাপি ও দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনা। দুর্বল হয়ে পড়েছিল সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত। ফলে এক ধরনের স্থবিরতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরাও বলছেন, পর্যাপ্ত গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল।
বিবিএসের সর্বশেষ জাতীয় হিসাব পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ২৯ শতাংশ। পরের বছর ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় এ খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সর্বশেষ গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শিল্পের প্রবৃদ্ধি গত চার বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ স্তরে নেমে আসে। সে বছর প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
দেশের শিল্প খাত পুরোপুরি ব্যক্তিনির্ভর একটি খাত। তাই ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ না বাড়ায় শিল্পের প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘খেলাপি ঋণের কারণে সুদহার বাড়ানো হয়েছিল। টাকার অবমূল্যায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ায় বেসরকারি বিনিয়োগ কমে এসেছে। রিজার্ভের পতন এবং সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা না থাকায় বিনিয়োগের পরিবেশও বাধাগ্রস্ত হয়েছিল। তবে এসব ঠিক হতে সময় লাগবে।’
বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত তিন বছরে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি, যা সার্বিক শিল্প প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় বিনিয়োগ হার ছিল ৩২ শতাংশের কিছু বেশি। পরের ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা নেমে আসে ৩০ দশমিক ৯৫ শতাংশে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও তা ৩০ দশমিক ৯৮ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল।
বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসেনি বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক এ মহাপরিচালক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেক বিনিয়োগকারী ব্যাংক ঋণ নিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করেছে। সামগ্রিক দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের কারণে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছিল। তাই নির্দিষ্ট কয়েকটি খাত ছাড়া আমরা এগিয়ে যেতে পারিনি।’
এর মধ্যে ফার্নিচার খাতের সংকোচন হয়েছে ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফার্নিচার শিল্প মালিক সমিতির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘করোনার পর শুরু হলো যুদ্ধ। আমাদের বিক্রি অর্ধেকে নেমে যায়। এখন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়েছে আমাদের ব্যবসা। আমরা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। সংকোচনের মধ্য দিয়ে গেছে টেক্সটাইল শিল্প। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে টেক্সটাইল শিল্পের সংকোচন হয়েছে দশমিক ৫২ শতাংশ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফজলুল হক বলেন, ওযখানে গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই সেখানে কীভাবে উৎপাদন বাড়বে? চালিয়ে যেতে পারছি না আমরা। এমন পরিস্থিতিতে অর্ডারও কম ছিল। বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থাও ভালো না। এদিকে মোটর ভেহিকল খাতেও প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশের বেশি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। পরিবহন যন্ত্রাংশ খাতেও ১৪ শতাংশের বেশি ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়।
এ খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ ছিল বলছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে টিভিএস অটো লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার রায় বলেন, ‘কয়েকটি কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধি অনেকটা কমে এসেছে। একটি কারণ হলো জাতীয় নির্বাচনের সময় একটি অনিশ্চয়তা কাজ করেছিল। তাছাড়া মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দা ভাবের প্রভাব পড়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায়ও বিক্রি অনেকটা কমে গেছে। আর ডলার সংকট একটি বড় কারণ ছিল। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ারও প্রভাব পড়েছিল।’
আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে শিল্প উৎপাদন কমে আসায় প্রবৃদ্ধিতেও প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে বিধিনিষেধ ছিল। ফলে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি কমে আসে। রিজার্ভ রক্ষা করতে গিয়ে এলসি জটিলতা তৈরি হয়েছিল। আবার ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগও কমে আসায় শিল্পের প্রবৃদ্ধি ১২ শতাংশ থেকে কমে আসে।’
এ অবস্থার উত্তরণ নিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারসহ নানা ধরনের বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিদেশী সহায়তারও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে। ডলারের বিনিময় হারও স্থিতিশীল আছে। ডলার সংকট না থাকলে শিল্পপণ্য আমদানি স্বাভাবিক হলে শিল্প খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে।