আরাফাত দাড়িয়া : অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভূমিকা অনেক বেশি। উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিকে সচল রাখতে বড় ব্যবসায়ীদের তুলনায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে প্রাধান্য দেয় হয়ে থাকে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও সর্বদা ক্ষুদ্রব্যবসায়ীদের উৎসাহী করতে বিভিন্ন সংস্থা বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে ঠিক তার উল্টো চিত্র ফুটে ওঠে। অথচ, ক্ষুদ্র শিল্প অর্থনীতিকে অনেক বেশি চাঙ্গা করতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। উদ্যেক্তা তৈরি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবলম্বন তৈরি এবং শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি সবকিছুতে অনস্বীকার্য অবদান রেখে আসছে এই শিল্প।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এখন উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দারিদ্র দূরীকরণ এবং মানুষের ভাগ্য বদলে দেবার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা। বলতে গেলে নব্বই ভাগ ব্যবসায়ী হচ্ছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারির তালিকায়। বাকি দশ ভাগ ব্যবসায়ী কর্পোরেট কিংবা বড় ব্যবসায়ী যাকে বলে। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কর্পোরেট ব্যবসায়ীরাই ছুঁরি ঘোরাতে থাকেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অন্যতম সমস্যা হচ্ছে তারা পুঁজির সংকটে পড়ে। সিংহভাগ ব্যবসায়ী টাকার অভাবে নিজেদের আলো ফোটাতে পারেন না। একদিকে যেমন ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভর করতে হয় অন্যদিকে চড়া সুদের উপর টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে হয়। অনেক সময় চড়া সুদ দিতে গিয়ে ব্যবসাটাই হারাতে বসেন। এসব সংকট কাটিয়ে উঠতে এবার বাজেটের উপর তাকিয়ে ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি এ প্রসংগে জানিয়েছেন যে, বাজেট এবার তাদের চলার পথ রুদ্ধ করেছে। যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিংবা সরকারের কাছ থেকে কোন ধরনের প্রণোদনা না পাওয়া যায়, তবে কুটির শিল্প হোক আর যে কোন ক্ষুদ্র শিল্প হোক সবকিছুই পথে বসবে।
সরকারের বিভিন্ন কাজের দরপত্র পাওয়া, কিংবা মার্কেটে নিজস্ব দোকান দেয়া এমনকি ফুটপাতে দোকান বসিয়ে ব্যবসা করাটাও কঠিন হয়ে পড়ে এসব ছোট ব্যবসায়ীদের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার ব্যবসায়ী বলেন, ‘যে কোন সরকারি কাজ পেতে হলে আমাকে আগে এর পেছনের গড ফাডারকে খুঁজতে হয়। কারণ, তাকে চাঁদা না দিলে এই কাজ পাওয়া সম্ভব না। আবার কাজ পাওয়ার পর সরকারি আমলাদের দিতে হয় কমিশন। নয়তো বিলটাও আটকে দেয়। নতুন বাজেট নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলবে বলে আমরা আশাবাদি ছিলাম। কিন্তু এখন তো উল্টো আমাদের বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে বলে মনে হচ্ছে।’ এই ঠিকাদারের সাথে একমত পোষণ করলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, রাজনীতি এবং ব্যবসা এখন এক হয়ে গেছে। এটি অবশ্যই উদ্বেগজনক। জাতীয় পর্যায়ে এই চিত্র, মাঠ ও স্থানীয় পর্যায়ে কি ধরনের চিত্র সেটা আর বোঝার অবকাশ থাকেনা। চাঁদা না দিলে ব্যবসা করতে পারেনা এটি এখন চূড়ান্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে।
ছোট এসব ব্যবসায়ীদের সুরক্ষা দিকে বিদেশে অবশ্য ছোট উদ্যেক্তা সুরক্ষা আইন রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা আইন রয়েছে সেটা শুধু কাগজে কলমে বলে জানা গেছে। নিয়ম নীতির কথা কেউ মানেনা বলেও জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কাজ পাওয়ার জন্য অনেক সময় বড় বড় প্রতিষ্ঠান নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে থাকে। এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে চাঁদা দিয়ে কাজ হাসিল করার পন্থা অবলম্বন করে। এসব কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের শুরুতে হোঁচট খেতে হয়। সরকারি কাজ তো পায়না আবার নিজ উদ্যেগে কাজ করতে গেলে বাধার সম্মুখীন হোন। যদিও এসব অস্বীকার করেছে বেশ কয়েকটি গ্রুপ ওয়াইজ প্রতিষ্ঠান। তাদের দাবি, সঠিক নিয়ম মেনে তারা ব্যবসা করছেন। তাদের দাবি, প্রতিটি বাজারে প্রতিযোগিতা রয়েছে। যদি বাজারে প্রতিদ্বন্দিতা করার সক্ষমতা না থাকে তবে কেন ব্যবসা করতে আসে বলে দাবি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারদের। এমনিতে উর্ধ্বগতি মূল্যস্ফীতির কারণে গেলো বছরটা মোটেও ভালো যায়নি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যেক্তাদের। কাঁচামাল ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমে গেছে। অনেকে বাধ্য হয়ে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন। আলিফা ইসলাম নামের এক ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা বলেন, ‘আমার দোকানের পণ্য এখন শতকরা ৫০ ভাগ কমে গেছে। নজিরবিহীন মূল্যস্ফীতির কারণে কম প্রয়োজনীয় পণ্য কেনা বাদ দিয়েছে সাধারণ মানুষ। তাই সংকটে পড়ে গেছি।’ অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে ফার্নিচার ব্যবসায়ীদের। পান্থপথে ফার্নিচারের ব্যবসায়ী হাবিবুর রহমান জানালেন তার দুর্দশার কথা। তিনি বলেন, পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে আগের চেয়ে এখন বিক্রি ৬০ ভাগ কমে গেছে। দোকান ভাড়া এবং কমচারিদের বেতন-ভাতা দিয়ে কিছুই থাকেনা। অনেক সময় নিজের ঘাটের টাকা খরচ করতে হয়। সামনে আমাদের চরম খারাপ অবস্থা তৈরি হবে। আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে যদি সুফল না পাই তবে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে যাবে। ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের গুনতে হবে বাড়তি টাকা। ভবিষ্যতে কি হবে বুঝতে পারছিনা।
দেশে সব খাতের শিল্প প্রতিষ্ঠান কত রয়েছে তা অজানা। সর্বশেষ যে তথ্য সেটিও দশ বছর আগের। সেই হিসাবে কুটির শিল্পখাত সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেই শিল্প এখন মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। কারণ তাঁত, হস্তশিল্প, কাঁসা, কাঠ, এসব পণ্যের খুব একটা কদর নেই। সরকার অবশ্য এসব শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে নতুন উদ্যেগ নেয়ার কথা ভাবছে। গতকাল স্থানীয় এক হোটেলে শিল্প মন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন,'বাংলাদেশ আগামী ৩ বছরের মধ্যে এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ করতে যাচ্ছে। সেজন্য এখন থেকেই আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি নিতে হবে। বিশেষ করে পাট, চামড়া, ফার্মাসিউটিক্যালস সহ সম্ভাবনাময় শিল্প খাতসমূহের উন্নয়ন ও মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।’ মন্ত্রী আরো বলেন, 'বিশ্ববাজারের পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারেও গুণগত মানসম্পন্ন পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের মানোন্নয়নপূর্বক কোয়ালিটি প্রোডাক্ট উৎপাদন করে তাদের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করতে পারে।'
প্রভাত/আসো