চীনা প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে ৪ দিনের দ্বিপক্ষীয় সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনে অবস্থান করছেন। এর আগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইট (বিজি-১৭০১) সোমবার সকাল ১১টা ৫মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফর সঙ্গীদের নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়। বিমানটি বেইজিং সময় সন্ধ্যা ৬টায় বেইজিং ক্যাপিটাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে অবতরণর করে। ৮-১১ জুলাই বেইজিংয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর দুদেশের মধ্যকার সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব’ থেকে কৌশলগত বিস্তৃত সহযোগিতা অংশীদারিত্বে’ উন্নীত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বলাই বাহুল্য যে, বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন। ফলে প্রধানমন্ত্রীর এই চীন সফরে বাণিজ্য ও অর্থনীতিই মূল অগ্রাধিকার পাবে। এসবের মধ্যে রয়েছে চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই), বাণিজ্য-সহায়তা, বিনিয়োগ সুরক্ষা, ডিজিটাল অর্থনীতি, সুনীল অর্থনীতি, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সমীক্ষার ঘোষণা ও একাধিক মৈত্রী সেতু নির্মাণ ও সংস্কার। এছাড়া বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মোট ৭ প্রকল্পের জন্য ১ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তার প্রস্তাব দেয়া হতে পারে। এসব বিষয় নিয়ে এখনও দুপক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ১৯৭৫ সালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর পারস্পরিক আস্থার দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ তৈরি হয়েছে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট সর্বশেষ বাংলাদেশ সফর করেন। ওই সময় দুদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের কৌশলগত অংশীদারত্বে উন্নীত হয়। এছাড়া এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন ও ভারতের প্রভাব রয়েছে। আঞ্চলিক রাজনীতি বিবেচনায় বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্বও অসীম। তাই চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাণিজ্য ঘাটতি ও ভূরাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অর্থাৎ এককথায়Ñ অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়গুলো ও দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
অবশ্য চীন ছাড়াও ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী। বাংলাদেশ এসব দেশের সঙ্গে সবসময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলেছে। তবে বাংলাদেশ কখনই কোনো জোটের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার ফলে সব উন্নয়ন সহযোগী দেশের কাছে সবসময়ই নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হতো। তাই চীনের সঙ্গে এমন করা উচিত যাতে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত বা জাপানের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে। কেননা বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বিদ্যমান রয়েছে সেসব দেশের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি হলে সে ধারা অব্যাহত রাখা কঠিন হবে। উল্লেখ করতে হবে যে, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থানের পাশাপাশি গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণেও দেশটি বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ দেশ হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের যেহেতু ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে, আগামী কয়েক বছরে আরও প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস রয়েছেÑ তাই অন্যান্য দেশও এ অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হতে আগ্রহী। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক বা চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে উন্নয়ন উদ্যোগে চীনকে যুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এ প্রচেষ্টায় ভারসাম্য রক্ষা হবে বলে মনে হচ্ছে। কেননা জাপানকে বাংলাদেশ যুক্ত করেছে মাতারবাড়ীতে, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের পর তিস্তায় চীনকে যুক্ত না করার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ফলে পায়রা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে চীনকে যুক্ত করা মানেই দেশটিকে খুশি করে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা। তবে চীনকে খুশি করলে হবে না। পাশাপাশি এর মাধ্যমে দেশের জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
চীন বাংলাদেশের বড় বাণিজ্য অংশীদার হলেও দুই দেশের মধ্যে বিশাল বাণিজ্যবৈষম্য রয়েছে। বিপুল অর্থের পণ্য চীন থেকে আমদানি করলেও দেশটিতে বাংলাদেশী পণ্য রফতানি হয় খুবই কম। কেননা বাংলাদেশ যেসব রফতানি করছে বা নতুন করে রফতানিযোগ্য পণ্য তৈরির বিষয়ে ভাবছে সেগুলোর যন্ত্রাংশ, কেমিক্যাল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির প্রধান উৎস চীন। ফলে বাংলাদেশের প্রধান খাতগুলোকে তাদের প্রয়োজনেই দেশটি থেকে এসব কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীন থেকে বাংলাদেশের আমদানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে পারমাণবিক চুল্লি, প্রকৌশল যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, তুলা, ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, সাউন্ড রেকর্ডার ও রিপ্রডিউসার, বুনা কাপড়, কৃত্রিম তন্তু ইত্যাদি। দেশটিতে রফতানি হওয়া পণ্যের মধ্যে রয়েছে ওভেন পোশাক, নিটওয়্যার, হোম টেক্সটাইল, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাদুকা ইত্যাদি। চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে রফতানি বাড়াতে পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার প্রয়োজন। সেসব বিষয়ে এ সফরে আলোচনা হওয়া দরকার।
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর সামনে রেখে বার্তা দিয়েছে চীন। আগেই চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক রাজনৈতিক সম্পর্ক আরো গভীর করতে চায় দেশটি। একই সঙ্গে দুই দেশের উন্নয়ন কৌশলগুলোকে আরো একত্রিত, বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতার উচ্চ অগ্রগতি, বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ বাস্তবায়নে গতি বাড়ানো, বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে একটি নতুন স্তরে উন্নীত করতে চায় চীন। বাংলাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারসাম্য বজায় রেখেই সম্পর্কোন্নয়ন করা প্রয়োজন।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অবস্থান করছে। এই সংকটের মূল কারণ হচ্ছে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল। এই সমস্যার টেকসই সমাধান করতে হলে মিয়ানমারের ভেতরে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার পাশাপাশি তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। এরপর সম্মানজনক উপায়ে তাদের নিজ দেশে ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মিয়ানমারের নীতিগত অবস্থার পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এখনো চীনের একটা শক্ত ভূমিকা রয়েছে এবং তারা ইচ্ছা করলে সেটা করতে পারে। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে একযোগে কাজ করছে। তবে রাখাইনে অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের রূপরেখা প্রণয়নে আলোচনায় জোর দেয়া উচিত। শেখ হাসিনার এবারের চীন সফরে অতীতের ধারাবাহিকতায় অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে। এক্ষেত্রে আমাদের সব পক্ষের সংবেদনশীলতা ও স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে এগোতে হবে। একইসাথে উভয় দেশের বৃহত্তর ভূরাজনীতি বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় স্বার্থের নিরিখে বিভিন্ন দেশের মতো চীনকেও এটা বোঝানো জরুরি যে সব দেশের স্পর্শকাতরতা ও সংবেদনশীলতাকে বাংলাদেশ বিবেচনায় নিয়ে থাকে। সব মিলে চীনে প্রধানমন্ত্রীর এই দ্বিপাক্ষিক সফরে সব ক্ষেত্রেই আমরা সর্বোচ্চ সফলতা কামনা করছি।