শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
Proval Logo

কোটা-প্রত্যয় স্কিমবিরোধী আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়  অচল : সমঝোতার ভিত্তিতে দ্রুত সমাধান হোক

প্রকাশিত - ০৮ জুলাই, ২০২৪   ০৮:৫০ পিএম
webnews24
অনলাইন ডেস্ক

সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছেন। একই সময়ে সরকারের চালু করা সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয়’ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরাও। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের দুটি পৃথক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম থমকে গেছে। খবরে প্রকাশ, গত কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। শনিবার শাহবাগ থেকে ‘বাংলা ব্লকেড’ তথা সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবরোধ কর্মসূচিও পালিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই, এর ফলে বিভিন্ন স্থানের সড়ক-মহাসড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। চরম ভোগান্তির শিকার হন যাত্রীরা। অবশ্য সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি চালুর ইতিহাসটি বেশ দীর্ঘ। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হলেও এর সঠিক সময় জানা যায় না। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয়রা মেধাবী হওয়া সত্বেও ইংরেজরা বেশি চাকরি পেত। ভারতীয়রা শিক্ষায় নবীন, চাকরিতে পিছিয়ে, মান-মর্যাদাতেও খাটো হওয়ায় বৈষম্য তৈরি হয়। এই বৈষম্যের জন্যই দেশভাগ হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। কিন্তু ৫২ সালে এসেই তারা বুঝতে পারল, পাকিস্তানের বনেদি পরিবারেরা নতুন জমিদার হয়ে বসে। এই বঞ্চনার বিরুদ্ধেই মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে হলো। 
স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন শ্রেণির চাকরিতে কোটাব্যবস্থা চলে আসছিল। একপর্যায়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২০১৮ সালের অক্টোবরে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডের (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি) সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর আগে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কার দাবিতে ওই সময় দেশজুড়ে ছাত্র আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পায়। সে কারণেই তখন কোটা পদ্ধতি বাতিল করতে বাধ্য হয় সরকার। তবে ২০২১ সালে কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করলে গত ৫ জুন এক রায়ের মাধ্যমে আবারও ফিরে আসে কোটা। এরপর কোটা বাতিলের দাবিতে ফের একাট্টা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গত ১ জুলাই আন্দোলনে নামেন তারা। এই আন্দোলন এখন দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। 
সরকারি তথ্য বলছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত ২০ শতাংশ পদে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ করা হতো। বাকি ৮০ শতাংশ পদে কোটায় নিয়োগ হতো। ১৯৭৬ সালে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হয়। ১৯৮৫ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির পদে ৪৫ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের নিয়ম চালু করা হয়। বাকি ৫৫ শতাংশ অগ্রাধিকার কোটায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই অগ্রাধিকার কোটার মধ্যে রয়েছে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, ১০ শতাংশ জেলা কোটা ও ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। পরে ১ শতাংশ পদ প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের দিয়ে পূরণের নিয়ম চালু করে মোট কোটা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশ। শুরু থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কোটা ছিল। পরে এ কোটায় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং তারপর নাতি-নাতনি যুক্ত করা হয়। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোটার বিপুল পদ শূন্য থাকত। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়, কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা ছিল। এর মধ্যে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১০ শতাংশ নারী, অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের জন্য ৫ শতাংশ আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ১ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল। ওই বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় বিক্ষোভ হয়। কোটা ব্যবস্থার সংস্কার করে ৫৬ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছিলেন তখনকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে সরকারি চাকরিতে (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে) সব ধরনের কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২০২১ সালে সেই পরিপত্রের ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলে’র অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন। সেই রিটের রায়ে চলতি বছরের ৫ জুন পরিপত্রের ওই অংশ অবৈধ ঘোষণা করেন আদালত। এরপর ৯ জুন হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ওইদিন এই আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগে পাঠিয়ে দেন চেম্বার আদালত।
আন্দোলনকারীরা কোটা পদ্ধতি বাতিল, কমিশন গঠন করে সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়া এবং দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করছেন। এই বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই যে, একটা সময় পর্যন্ত জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানসন্ততি ও নারীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরিতে কোটা পদ্ধতির প্রয়োজন ছিল। মাঝে এর ব্যত্যয় ঘটায় জাতির শ্রেষ্ঠসন্তানদের বংশধরদের জন্য দায়বদ্ধতা থেকেই এই সুবিধা যৌক্তিকভাবে হলেও বহাল থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আবার এটাও সত্য, সময়ের পরিক্রমায় পরিস্থিতির পরিবর্তনও ঘটেছে। বিশ্বের সর্বত্র এখন মেধাকে দেয়া হয় সর্বাধিক গুরুত্ব। আমাদের দেশেও প্রশাসনসহ সরকারি কর্মকা-ে দক্ষতা বাড়াতে মেধার প্রতি গুরুত্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসানেও এর প্রয়োজন। সংবিধানের ১৯ (১), ২৯ (১) ও ২৯ (২) অনুচ্ছেদে চাকরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা হয়েছে। আবার, সংবিধানে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য কোটার বিষয়ে বলা রয়েছে।
আমরা মনে করি, সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা একেবারে বাতিল না করে তা সংস্কার করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমেই এ বিষয়ে সুরাহা করা দরকার। এটাও ঠিক, চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন সরকার বা কোনো দলের বিরুদ্ধে নয়। তাদের আন্দোলন অধিকারের প্রশ্নে। তাই এসব দাবি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত ছিল। আবার এটাও ভুলে গেলে চলবে না, আন্দোলনের নামে নৈরাজ্যের অপসংস্কৃতি নিন্দনীয় ও অপরাধযোগ্য। সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতেই পরিস্থিতির সুরাহা হবে বলেই প্রত্যাশা সকলের।
 

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন