প্রভাত রিপোর্ট : সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন সৈয়দ আবেদ আলী জীবন। প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িয়ে তিনি গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ঢাকায় আছে একটি ছয়তলা বাড়ি, তিনটি ফ্ল্যাট ও একটি গাড়ি। গ্রামে ৬ কোটি টাকার বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। নিজ এলাকায় সরকারি জমি দখল করে গড়েছেন গরুর খামার। বাড়ির পাশে করেছেন একটি মসজিদ ও ঈদগাহ।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী এসব তথ্য জানিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। সিআইডির কর্মকর্তাদের ধারণা, কিছু দৃশ্যমান সম্পদ ছাড়াও আবেদের আরও সম্পদ রয়েছে। আবেদের কোথায় কোথায় সম্পদ ও ব্যাংকে কী পরিমাণ টাকা-পয়সা রয়েছে সবকিছু তদন্ত করবে সিআইডি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গ্রেফতার সৈয়দ আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে। ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এমন পরিবারে জন্ম আবেদের। অভাবের কারণে পড়াশোনা করতে পারেননি তিনি। মাত্র ৮ বছর বয়সে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় এসে শুরু করেন কুলির কাজ। পরে এক ব্যক্তির পরামর্শে গাড়ি চালানো শিখে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে গাড়িচালক হিসেবে চাকরি নেন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে।
১৯৯৭ সালের দিকে রাজধানীর ইন্দিরা রোডের পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার একটি ব্যাচেলর মেসে থাকাকালীন আবেদ আলীর সঙ্গে পরিচয় হয় এক ব্যক্তির। সেই ব্যক্তির মামা চাকরি করতেন সচিবালয়ে। তার মাধ্যমেই পিএসসিতে গাড়িচালক হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর চাকরি হয় তার। রূপকথার আলাদীনের জাদুর চেরাগের মতো ‘যা চেয়েছেন তা পেয়েছেন’ আবেদ। গাড়িচালকের চাকরি পেয়ে শূন্য থেকে শতকোটি টাকার মালিক তিনি। নেপথ্যে রয়েছে পিএসসিসহ বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস। দামি বাড়ি, গাড়ি, প্লট-ফ্ল্যাট, এমনকি তৈরি করেছেন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স কোম্পানিও। এখন নিজেকে পরিচয় দেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আবেদ আলীর রয়েছে অন্তত সাতটি ফ্ল্যাট এবং তিনটি প্লট। আবেদ আলীর বড় ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম পড়াশোনা করেছেন ভারতের শিলিগুড়ির একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সেখানেও একটি বাড়ি কিনেছেন আবেদ। দেশে ফিরে সিয়াম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। বাবার টাকায় কেনা একাধিক ব্যক্তিগত দামি গাড়ি ব্যবহার করেন তিনি।
গ্রামে আবেদ ও তার ছেলে সিয়াম চলাফেরা করতেন বডিগার্ড নিয়ে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অবৈধ টাকার গরমে গ্রামে ‘উষ্ণতা’ ছড়াতেন আবেদ আলী ও তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। সিয়াম সব সময় হ্যারিয়ার গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতেন। এলাকায় গেলে তরুণ ও যুবকদের নিয়ে বসাতেন মদের আসর। সঙ্গে সব সময় ১০-১২ জন বডিগার্ড থাকতো। সিয়াম যেখানেই যেতেন সঙ্গে থাকা ছেলেগুলো সেখানে গিয়ে ফেসবুকে সিয়ামের কার্যক্রম সম্পর্কে ফেসবুকে পোস্ট করতেন। অনেকটা বলা যায় টাকা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করতেন সিয়াম। আবেদের সঙ্গে থাকতো বডিগার্ড। যারা তার প্রচারণাও চালাতেন। এছাড়া এলাকায় ফেসবুকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হুমকি-ধামকি দিতেন। ডাসার উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটির সহ-সভাপতির পদ পাওয়ার পরেও কোনো অনুষ্ঠানেই উপস্থিত হননি।
সমাজসেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা
আবেদ আলী গ্রামে গিয়ে কিছু টাকা-পয়সা খরচ করে ফেসবুকে পোস্ট করে সমাজসেবক হিসেবে নিজেকে দাবি করতেন। মূলত তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে নিজেকে জাহির করতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জোর করে যুক্ত হতে চাইতেন টাকার বিনিময়ে। তিনি নিজেকে ডাসার উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা করে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ গরিবদের মাঝে ব্যাপক দান-খয়রাত শুরু করেন। শাড়ি, লুঙ্গিসহ নগদ টাকা বিতরণ, মাদরাসা ও এতিমখানায় দান করায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আবেদ আলী।
উপজেলা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে খরচ ৩ কোটি
দীর্ঘদিন এলাকায় না গেলেও গত পাঁচ বছর ধরে নিজ এলাকা মাদারীপুরের ডাসার উপজেলায় যাতায়াত শুরু করেন আবেদ আলী। উঠে-পড়ে লাগেন ডাসার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হতে। নিজের পক্ষে সভা-সেমিনার, মিছিলে বড় ছেলে সিয়ামকে ব্যবহার করতেন। আর সিয়ামও বাবার পক্ষে দিন-রাত চালান প্রচারণা। দেন বিভিন্ন আশ্বাসের ফুলঝুরি। গত কোরবানির ঈদে দামি গাড়িতে চড়ে ১০০ জনের মধ্যে এক কেজি করে মাংস বিতরণ করেন সিয়াম। সেই ভিডিও শেয়ার করেন নিজের ফেসবুকে। ডাসার এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, ডাসার উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে নাম ছড়িয়ে দিতে এবং প্রভাব বিস্তার করতে এখন পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকা খরচ করেছেন আবেদ আলী। দুই বছর আগে গঠিত ডাসার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল এখনো ঘোষণা করেনি নির্বাচন কমিশন।
ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি নেন আবেদ, ২০১৪ সালে হন চাকরিচ্যুত, চলছে বিভাগীয় মামলাওআবেদ আলী পিএসসিতে চাকরি নিয়েছিলেন ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে। এছাড়া ২০১৪ সালে নন-ক্যাডারের প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরি থেকে তাকে বরখাস্ত করেছিল পিএসসি। পিএসসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নন-ক্যাডারে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সহকারী মেনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদের লিখিত পরীক্ষা ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই পরীক্ষায় এক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে হলের বাইরে থেকে অবৈধভাবে সরবরাহ করা সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরসহ চারটি লিখিত উত্তরপত্র হাতেনাতে ধরা হয়। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ আইনের ধারায় মামলা করা হয়। মামলার তদন্তে সৈয়দ আবেদ আলীর সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য-প্রমাণ মেলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। সৈয়দ আবেদ আলী বিরুদ্ধে বহু বেআইনি কাজের দুর্নাম আছে। তিনি অভ্যাসগত অপকর্মে জড়িত বলেও পিএসসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
সৈয়দ আবেদ আলীর গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার হলেও পিএসসিতে চাকরি নেওয়ার সময় স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে সিরাজগঞ্জ উল্লেখ করেছিলেন। এ ব্যাপারে পিএসসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চাকরি থেকে বরখাস্তের চিঠি সৈয়দ আবেদ আলীর স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়। সৈয়দ আবেদ আলী ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পিএসসিতে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। সে সময় তিনি স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ করেছেন সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের শ্রীফলতলা গ্রামে। বাবা সৈয়দ আবদুর রহমান।
২০১৪ সালের ২২ এপ্রিলে নন-ক্যাডার তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ‘সহকারী মেনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার’ পদে লিখিত পরীক্ষায় লিখিত উত্তরপত্র সরবরাহ করার অভিযোগে সৈয়দ আবেদ আলীর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণী তার স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়। ডাক বিভাগ সৈয়দ আবেদ আলীর স্থায়ী ঠিকানায় চিঠি গ্রহণের জন্য কাউকে না পেয়ে অভিযোগনামা ও অভিযোগ বিবরণীটি পিএসসিতে ফেরত পাঠায়। একইভাবে সাময়িক বরখাস্তের আদেশটিও ফেরত আসে।
অভিযুক্ত কর্মচারীর স্থায়ী ঠিকানাটির সঠিকতা যাচাই করে ২০১৪ সালের ১৮ নভেম্বরে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক পিএসসিকে জানান, তার স্থায়ী ঠিকানাটি সঠিক নয় এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটার তালিকায় সৈয়দ আবেদ আলী বা তার পূর্বপুরুষদের কেউ তালিকাভুক্ত নন। অর্থাৎ সৈয়দ আবেদ আলী ভুয়া স্থায়ী ঠিকানা ব্যবহার করে চাকরি নিয়েছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অপর একটি বিভাগীয় মামলা চলছে।
স্থানীয়রা জানান, একজন গাড়িচালক হিসেবে সৈয়দ আবেদ আলী জীবনের হঠাৎ করে এত সম্পদের মালিক হওয়ার পেছনে যে নিশ্চয়ই কোনো দুর্নীতি আছে, সেটি আগেই বোঝা যাচ্ছিল। তবে তিনি যে এত বড় প্রতারক সেটি ভাবতে পারেননি এলাকার কেউ। এলাকায় নির্বাচনের সময় মানুষকে উপদেশ দিতেন। তিনি নাকি নিজের রক্ত পানি করে, শ্রম-ঘাম দিয়ে এত সম্পদ অর্জন করেছেন। মানুষকে বলেছেন সততার সঙ্গে যেন কাজ করে।
যা বলছে সিআইডি
সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী বলেছেন, শেওড়াপাড়ার ভবনটির পঞ্চম তলায় দুটি ও চতুর্থ তলায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। পাইকপাড়ায় তার একটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। ব্যাংকে রয়েছে নগদ টাকাও।
জিজ্ঞাসাবাদে আবেদ আলী সিআইডির কর্মকর্তাদের বলেন, ২০২৩ সালের শেষের দিকে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে ৩ হাজার ১০০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের অনেকের কাছে ফাঁস করা প্রশ্ন বিক্রি করেছেন আবেদ আলী এবং তাদের চাকরিও হয়েছে।
সিআইডির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর বিপুল পরিমাণ সম্পদের খোঁজ মিলেছে। প্রশ্নফাঁসের টাকায় তিনি গড়েছেন অঢেল সম্পদ। তার এ সম্পদের বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের (সিপিসি) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, মামলায় এখন পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সাবেক পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ সাতজন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেফতারদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যাচাই-বাছাই চলছে। এ চক্রের সঙ্গে আরও যারা জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।
প্রভাত/টুর