প্রভাত রিপোর্ট : কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল রাজধানী ঢাকা। দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীর সর্বত্র অগ্নিসংযোগের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিটিভি ভবন, সেতু ভবন, বিআরটিএ ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর। ভেতর থেকে এখনো বের হয়ে আসছে আগুনের পোড়া গন্ধ। রাষ্ট্রীয় সম্পদে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাতে ঢাকাসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারির পাশাপাশি সেনা মোতায়েন করে সরকার। এর আগে অবশ্য পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবি মোতায়েন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে সরকার। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হয় ১ জুলাই। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার পরদিন থেকে সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৮ থেকে ২০ জুলাইÍএই তিন দিনে সবচেয়ে বেশি হতাহত হয় এবং ৮৯টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
বুধবার সকালে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন পুলিশ বক্সটি যেন ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। ভেতরে থাকা চেয়ার-টেবিল, খাতাপত্রসহ সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এমনকি আন্দোলনের সময় দেওয়া আগুনে অন্তত ১০-১৫টি পুলিশের মোটরসাইকেল, একাধিক পুলিশ ভ্যান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ বক্সটির পাশেই কিছু পুলিশ সদস্য বসে থাকলেও তারা আতঙ্কে আছেন, কখন যেন ভেঙে পড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ বক্সটি।
জানা গেছে, কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের শাটডাউন কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি ও একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী মৃত্যুর খবরে গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা৷ আগুন নেভাতে খিলগাঁও ফায়ার স্টেশন থেকে পানিবাহী গাড়ি বের হলে রাস্তায় গাড়িটি আটকে দেয় উত্তেজিত জনতা। গাড়িতে থাকা ব্যক্তিদের মারধর করে গাড়িটিকে স্টেশনে ফিরে যেতে বাধ্য করে।
এতে রাষ্ট্রায়ত্ত এই টেলিভিশনটির একাধিক গাড়ি, ক্যান্টিনসহ বিভিন্ন অংশ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বেলা পৌনে ৩টায় আগুনের সূত্রপাত হলেও রাত ৯টার দিকেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস বা কোনো উদ্ধারকারী বাহন। ফলে প্রায় ৬ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা এই অগ্নিকা-ে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয় টেলিভিশন ভবনটি। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যেদিকেই চোখ যায়, সেদিকেই যেন শুধু তান্ডবের ক্ষতচিহ্ন।
রামপুরা-মালিবাগ এলাকায় গিয়েও পুলিশ বক্সসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞের দেখা পাওয়া যায়। গতকাল পর্যন্ত মালিবাগ রেলগেট থেকে আবুল হোটেল হয়ে রামপুরা পর্যন্ত মূল সড়কে গত কয়েক দিনের আন্দোলন ও সংঘর্ষের বিভিন্ন ক্ষতচিহ্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। সড়কের পাশে কোথাও উপড়ে ফেলা রোড ডিভাইডার, ইটের টুকরা ইত্যাদিও পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
রামপুরা এলাকার টিভি রোডের বাসিন্দা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, বেলা পৌনে ৩টার দিকে সর্বপ্রথম বিটিভিতে আক্রমণ শুরু হয়। এসময় ক্যান্টিনের সামনের একটি গাড়িতে আগুন ও ক্যান্টিন ভাঙচুর করা হয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনের পক্ষে এবং বিভিন্নস্থানে পুলিশের গুলিতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহতের প্রতিবাদে নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। এরপর দলে দলে আরও শিক্ষার্থী আসতে থাকেন, এ সময় স্থানীয় কিছু মানুষও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয়। এক পর্যায়ে ভয়ে-আতঙ্কে দৌড়ে তিনি বাসায় চলে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, সেদিন রামপুরায় পুলিশ ছাত্রদের ওপর প্রথম গুলি ছুড়ে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলা ও গুলির খবর শোনার পর ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। এ সময় রামপুরায় অবস্থান করা পুলিশ সদস্যরা তাদের ওপর গুলি চালায় এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। এরপরই আশেপাশের স্থানীয় মানুষ আর ছাত্ররা রামপুরার দিকে দৌড়ে আসে, এসময় পুলিশের গুলিতে আরও কয়েকজন আহত হন। এক পর্যায়ে পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
মালিবাগ এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, আন্দোলনে এই এলাকায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দা ও বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ছিল। যে কারণে তাদের সংখ্যা বেশি থাকায় সেদিন পুলিশ অনেকটাই কোণঠাসা ছিল। শুরুতে পুলিশ গুলি করলেও এক পর্যায়ে তারা পিছু হটে এবং শিক্ষার্থীরা পুরো রামপুরা-মালিবাগ এলাকা দখল নেয়। গত ১৭ থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৫দিন রামপুরা এলাকায় কোন পুলিশ বা অন্যকোনো বাহিনী ঢুকতে পারেনি।
মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে অধিদপ্তরের পুরো ১০ তলা ভবন পুড়ে গেছে। ভবনের নিচে জেনারেটর, সার্ভার স্টেশনসহ সম্পূর্ণ ফ্লোরই আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত ১৮ জুলাই মহাখালী দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। তেজগাঁও ফায়ার স্টেশন থেকে একটি পানিবাহী গাড়ি, একটি ইঞ্জিনবাহী গাড়ি এবং একটি অ্যাম্বুলেন্সবাহী গাড়ি রওনা হয়। উত্তেজিত জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে গাড়িটি আটকে ভাঙচুর করে। অ্যাম্বুলেন্সটি ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হন। এর পরদিনই (১৯ জুলাই) মোহাম্মদপুরের সলিমুল্লাহ রোডের একটি আগুনের ঘটনায় পানিবাহী ও পাম্পটানা গাড়ি দুটি ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
মহাখালী এলাকার ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, ১৮ জুলাই মহাখালীর আমতলী মোড় থেকে বীর উত্তম একে খন্দকার সড়কে আন্দোলনকারী একদল যুবক লাঠিসোঁটা নিয়ে এগিয়ে আসে। তারা তিতুমীর কলেজের আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সামনে এসে ইটপাটকেল ছোড়ার পাশাপাশি সড়কে এবং ভবনটির প্রবেশপথের সামনে থাকা কয়েকটি গাড়ি ও মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। এক পর্যায়ে গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে পাশে থাকা গাড়িগুলোতে আগুন ধরে যায়। আধা ঘণ্টা জ্বলার পর আগুন ওই ভবনেও ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাঝে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ৫০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল ওয়াদুদ গণমাধ্যমকে বলেন, আগুনে ভবনের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার পুড়ে গেছে, যেখান থেকে সারা দেশে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। দেশে যেকোনো দুর্যোগ হলে এখান থেকে ত্রাণ বা সহায়তা দেওয়া হয়। এছাড়াও ভবনের সামনে ও পার্কিংয়ে অধিদপ্তরের ৫৩টি গাড়ি এবং ১৩টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতি অন্তত ৫০০ কোটির বেশি হবে।
এদিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনের হামলা ও অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নির্ধারণ করা যায়নি। তবে আমরা আশঙ্কা করছি কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি তো হবেই। তারা বিটিভির কেন্দ্রে আগুন দিয়েছে, ক্যামেরাসহ অনেককিছুই পুড়িয়ে দিয়েছে। অনেক যন্ত্রপাতি লুটপাটও করেছে। নির্দিষ্টভাবে ক্ষতির পরিমাণ বের করতে হলে তো তালিকা করতে হবে।
তিনি বলেন, নাশকতাকারীরা আমাদের ১৭টি গাড়ি পুড়িয়েছে, ৯টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে, দুইটি সম্প্রচার ভ্যান পুড়ানো হয়েছে। এছাড়াও আগুনে বিল্ডিংয়ের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সবমিলিয়ে ভয়াবহ একটা হামলা ও অগ্নিকা- বিটিভিতে হয়েছে, যেই পরিস্থিতি আমাদের পক্ষে তুলে ধরাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে পুলিশের স্থাপনা ঘিরেই বেশি হামলাসংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ৭ দিনে সারা দেশে ১১৩টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ঢাকা অঞ্চলেই (রাজধানী ও ঢাকা জেলা) ৯০টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে পুলিশের অবস্থান ও তাদের স্থাপনা ঘিরে। আগুনের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত এমন তথ্য পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।
প্রভাত/টুর