প্রভাত বাণিজ্য : বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, পায়রায় প্রতিটি ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪১ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হারে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে বাংলাদেশের ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকায়। আরেকটিতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে পায়রায় দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পেছনে খরচ হচ্ছে ৫২ হাজার ৩৮ কোটি টাকা।
বাগেরহাটের রামপালে একই সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৬০ বিলিয়ন বা ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর কক্সবাজারের মহেশখালীতে নির্মিত ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মাণ ব্যয়ের প্রাক্কলন রয়েছে ৫৬ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। তবে এ ব্যয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি মাতারবাড়ীতে বন্দর নির্মাণ ও দুটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণের ব্যয়ও ধরা হয়েছে বলে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (সিপিজিসিবিএল) সূত্রে জানা গেছে।
নির্মাণ ব্যয়ের এ হিসাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রামপালে প্রতি মেগাওয়াট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি ১২ লাখ টাকা। পায়রায় দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে একটিতে প্রতি মেগাওয়াট নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২১ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কিছু বেশি। অন্যটিতে তা প্রায় ১৮ কোটি টাকা। আর মাতারবাড়ীতে প্রতি মেগাওয়াট নির্মাণ ব্যয় ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বৈশ্বিক মানের বিপরীতে বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। কেন্দ্রভেদে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা দেড়-দুই গুণ। বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রতিযোগিতামূলক শর্তে বা দামে ঋণ চুক্তি, মালপত্র ক্রয় ও নির্মাণ এবং এতে সময়ক্ষেপণ কমানো গেলে খরচ অনেকটাই কমে আসত। এখন এসব কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের সঙ্গে উৎপাদন খরচ যুক্ত হয়ে তা বিদ্যুতের দামে বড় আকারে প্রভাব ফেলছে।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের সক্ষমতা বাড়াতে বিদেশী ঋণে বৃহৎ কয়লাভিত্তিক চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মোট ব্যয়ের প্রাক্কলন রয়েছে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞ ও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলে এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় সাশ্রয় করা যেত অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
যদিও সরকারের এসব প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী, চারটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ১ লাখ ২৪ হাজার ৯৯৮ কোটি টাকা। সেই হিসেবে চার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে অন্তত ৬১ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এরই মধ্যে পায়রা ১ ফেজের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঋণের বেশ কয়েকটি কিস্তি শোধ হয়ে গেছে। এছাড়া এর মধ্যে মাতারবাড়ীতে বন্দর উন্নয়ন ও জমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হলেও চার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সব মিলিয়ে অন্তত ৩৫ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব ছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতায় বড় চার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিস্যা ২০ শতাংশেরও বেশি। আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৫ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে তিনটি এখন উৎপাদনে রয়েছে। বাকি একটির নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে গৃহীত ঋণের চুক্তি ও প্রাক্কলনের ক্ষেত্রে ব্যয় সবসময় ডলারে হিসাব করা হয়। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে একেকটি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তির কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে আদর্শ ব্যয়মান প্রতি মেগাওয়াট ১ মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি, বর্তমান বিনিময় হারে যা ১২ কোটি টাকার সমপরিমাণ (প্রতি ডলারে ১১৮ টাকা ধরে)। সেই হিসেবে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যয় হওয়ার কথা ১৫ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। আর এ সক্ষমতার চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যয় হওয়ার কথা ৬৩ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিদ্যুতের বৃহৎ যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং যেগুলো নির্মাণাধীন, সেগুলোর সবই হয়েছে রাষ্ট্রীয় চুক্তির আওতায়। এ চুক্তিতে কী আছে সে বিষয়গুলো দেশের মানুষ পরিষ্কারভাবে জানে না। তবে বৃহৎ সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের বৈশ্বিক ব্যয়মান দেখলে বোঝা যায়, দেশে নির্মিত বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব ছিল। আর জাপানি প্রযুক্তিতে শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রই নয়, সব প্রকল্পেই ব্যয় বেশি। কারণ তাদের টেকনোলজি বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডে অন্যতম। গুণগত মান বিবেচনায় জাপানি অর্থায়নের বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর্থিক বিবেচনায় নির্মাণ করা যায় কিনা সেটি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা যেতে পারে।
বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে মাতারবাড়ীর মহেশখালীতে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে তা রামপালের খরচের চেয়ে তিন গুণ। যদিও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে নির্মাণ ব্যয় হিসাব করা হয়েছে, সেখানে প্রায় অর্ধেকই ব্যয় হয়েছে কয়লা আমদানির জন্য বন্দর ও চ্যানেল নির্মাণে।
মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের ব্যয়ের যৌক্তিকতা তুলে ধরে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে ব্যয় দেখানো হচ্ছে, সেটা প্রকৃতপক্ষে ব্যয়বহুল না। কারণ এ প্রকল্পের সঙ্গে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বন্দরে ব্যয় হচ্ছে। বাকি টাকার মধ্যে এখানে দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য জমি অধিগ্রহণের ব্যয় ধরা হয়েছে। এছাড়া জেটির সক্ষমতায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ফেজকেই হিসাবে নেয়া হয়েছে। এসব হিসাব বিবেচনায় নিলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় ঠিকই রয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মাতারবাড়ী প্রকল্পটি নির্মাণে চুক্তি হয় ২০১৪ সালে। এর কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। শুরুতে মাতারবাড়ী প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২০২১ সালে এ প্রকল্প সংশোধন করে সময় বাড়ানো হয়। তখন ব্যয় বাড়ে আরো ১৬ হাজার কোটি টাকা। পরে ব্যয় আরো প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বেড়ে যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে দরপত্রে প্রতিযোগিতা, নির্ধারিত সময়ে কেন্দ্র নির্মাণ, ঋণের কঠিন শর্ত এমনকি যন্ত্রপাতি আমদানি প্রক্রিয়ায় শর্তগুলো ছিল ন্যূনতম। এসব জটিলতা ও ব্যয় বিশ্লেষণ করে ঋণ নেয়া হলে বিদ্যুতের বড় প্রকল্পগুলোর ব্যয় কমানো যেত। পাশাপাশি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডও (বিপিডিবি) আর্থিকভাবে এত দুরবস্থার মধ্যে পড়ত না।
রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। সরকারের সর্বশেষ তথ্যে বাংলাদেশী মুদ্রায় তা ১৬ হাজার কোটি টাকা দেখানো হলেও ডলারের অবমূল্যায়নে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে এ ব্যয় দাঁড়ায় আরো বেশি। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিপিডিবি ও ভারতের এনটিপিসির সমান মালিকানাভিত্তিক যৌথ অংশীদারত্বে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের ঋণ রয়েছে ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। দুই দেশের সমান যৌথ অংশীদারত্ব থাকলেও এ ঋণের কিস্তি পরিশোধের দায়ভার থাকছে পুরোটাই বাংলাদেশের ওপর। এক্সিম ব্যাংকের দেয়া এ ঋণের শর্ত অনুযায়ী, ১৬০ কোটি ডলারের ঋণ বাংলাদেশকে পরিশোধ করতে হবে ২০ বছরে। সাত বছর পর ঋণের নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে। ২৭টি অর্ধবার্ষিক কিস্তিতে এক্সিম ব্যাংককে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুতের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যে ব্যয় হচ্ছে সেটি বৈশ্বিক মানের চেয়ে অনেক বেশি। বৈশ্বিক মান অনুযায়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রতি মেগাওয়াট নির্মাণে ব্যয় ১২ কোটি টাকা। কিন্তু পায়রায় ব্যয় হচ্ছে ১৮-১৯ কোটি টাকা। রামপালে ঠিক থাকলেও মাতারবাড়ীতে ব্যয় অনেক বেশি হচ্ছে। এ হিসাব তারা কোন যুক্তিতে করে, সেটি জানা নেই। জমির খরচ বেশি দেখানো হয়, কিন্তু সেটা হিসাব করলেও ব্যয় এত বেশি হওয়ার কথা নয়। আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে যৌক্তিক ব্যয় করা গেলে বিপুল পরিমাণে ব্যয় কমানো সম্ভব ছিল।