বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
Proval Logo

শিল্পকারখানার ফেলনা উপকরণ ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে মোটরসাইকেলে মহড়া

প্রকাশিত - ৩১ আগস্ট, ২০২৪   ০৯:০১ পিএম
webnews24

প্রভাত অর্থনীতি : ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন ধরনের সরবরাহ ব্যবসার হাতবদল শুরু হয়। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতারা তৈরি পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকলের ঝুট ব্যবসা, শ্রমিকদের নাশতা সরবরাহের পাশাপাশি অন্যান্য শিল্পকারখানার ফেলনা উপকরণ নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। ক্ষমতার পরিবর্তনের পর তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। এই সুযোগে একটি রাজনৈতিক দল ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সেসব ব্যবসার দখল নিতে মাঠে নামেন।
কয়েকজন শিল্প উদ্যোক্তা বলেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন একটি রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা। কোথাও কোথাও নিজেদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় তাঁরা নিয়ন্ত্রণ নিতে পারেননি। এ দলটির নেতাদের নামে কিছু ব্যবসায়ীর কাছে মোটা অঙ্কের নগদ টাকা চাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। আবার গা ঢাকা দেয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ নামে-বেনামে ফোন করে ঝুটের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হুমকি দিচ্ছেন। তাই রাজনীতির পটপরিবর্তন হলেও চাঁদাবাজি থেকে আদৌ মুক্তি মিলবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কায় আছেন ব্যবসায়ীরা।
মিলে সুতা উৎপাদনের পর ঝুট হিসেবে তুলা বের হয়। বিদায়ী সরকারের আমলে কারখানা থেকে তুলা বের করলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাদের গাড়িপ্রতি ১০ হাজার টাকা দিতে হতো বলে জানালেন রূপগঞ্জের এক বস্ত্রকল মালিক। তিনি জানান, সুতা উৎপাদনে ব্যবহৃত তুলার ৭ থেকে ৮ শতাংশই ওয়েস্টেজ হয়। তার মধ্যে ৪ শতাংশ ঝুট হিসেবে বিক্রি করতে হয়।
দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি বস্ত্রকলে ৩৫ থেকে ৪০ জন তরুণ হানা দেন। তারা নিজেদের একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় দিয়ে কারখানার কর্মচারীদের বলেন, এখন থেকে অন্য কারও কাছে কারখানার ঝুট বা ফেলনা উপকরণ বিক্রি করা যাবে না। বিক্রি করতে হলে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। যোগাযোগের জন্য ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ছয়জন নেতার নাম ও মুঠোফোন নম্বর লেখা একটি কাগজ দিয়ে আসেন তাঁরা।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে একাধিক দফায় বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি শিল্পকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত ও চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানান।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা দেখছি, কিছু লোক মোটরসাইকেল নিয়ে শিল্পকারখানার সামনে মহড়া দিচ্ছেন। 
জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর কারখানার ফটকে ফটকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা ভিড় করছেন। ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে তৈরি পোশাক কারখানায় এমন ঘটনা বেশি ঘটছে। আবার ব্যবসায়ীদের কাছে ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা চাঁদা চাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। তিনি আরও বলেন, আমরা চাঁদাবাজি বন্ধ চাই। তার জন্য মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। চাঁদাবাজি বন্ধ করতে আমরা সদস্য কারখানাকে সেনাবাহিনীর স্থানীয় টিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি। তারাও সহযোগিতা করছে।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গাজীপুর সদর উপজেলা, টঙ্গী, কোনাবাড়ী, কাশিমপুরসহ বিভিন্ন এলাকার পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছেন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা নেতা-কর্মীরা। কিছু এলাকায় কারখানার ঝুট ব্যবসা কারা নিয়ন্ত্রণ করবে, সে বিষয়ে সমঝোতা হয়নি। এ জন্য কোথাও কোথাও ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে।
কোনাবাড়ী এলাকার একটি কারখানার মহাব্যবস্থাপক জানান, এক মাস ধরে কারখানার পরিত্যক্ত মালামাল বিক্রি করতে পারছি না। এতে অনেক মালপত্র নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন আগে নিজেরা এসব মালামাল বিক্রির উদ্যোগ নিলে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা কয়েকজন নেতা-কর্মী বাধা দেন।
কালিয়াকৈর উপজেলার পূর্ব চন্দ্রা এলাকার একটি রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) বলেন, কোটা আন্দোলনের সময় থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ঝুট কারখানা থেকে বের করা যায়নি। গুদামে এসব ঝুট পড়ে আছে। প্রতি মাসে কারখানায় যে পরিমাণ ঝুট তৈরি হয়, তা সরাসরি বিক্রি করলে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু প্রভাবশালী নেতাদের কাছে তা মাত্র ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করতে হয়।
গাজীপুর মহানগরীর দক্ষিণ সালনায় ইউটা ফ্যাশন লিমিটেড কারখানার ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে গত সপ্তাহে মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম মঞ্জুরুল করিমের সমর্থক শতাধিক কর্মী মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে ওই কারখানার সামনে যান। অন্যদিকে কারখানাটির বর্তমান ঝুট ব্যবসায়ী শহীদ সমর্থিত আরেকটি পক্ষ সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল। একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পরে শহীদের লোকজন মোটরসাইকেল ফেলে পালিয়ে যান। এ সময় প্রায় ১৫টি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেন এম মঞ্জুরুল করিমের সমর্থকেরা।
গাজীপুরের একটি কারখানার খালি ব্যাগ, ড্রামসহ বিভিন্ন ধরনের পরিত্যক্ত উপকরণের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে গত দুই সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা কয়েকটি পক্ষ ধরনা দিয়েছে। একই সঙ্গে এত দিন আওয়ামী লীগের যারা এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেছেন তারাও যোগাযোগ করছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষকেই ব্যবসা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি প্রশাসনের লোকজনও চাপ দিতেন। এখনকার প্রশাসন সেটি করছে না। সে জন্য আমরা ঝুঁকি নিয়ে সরাসরি প্রকৃত ব্যবসায়ীদের কাছে উপকরণগুলো বিক্রির চেষ্টা করছি।
গাজীপুরের মীর গ্রুপের সিরামিক কারখানায় ফেলনা বা স্ক্র্যাপ মালামাল উপকরণ কম দামে কিনে নিতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন নেতা। ক্ষমতার পরিবর্তনের পর সেই জায়গা নিতে হুমকি ধমকি দিচ্ছেন একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা একজন নেতা। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্ক্র্যাপ উপকরণ বিক্রি আপাতত বন্ধ করে রেখেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিশ্চিত করে মীর সিরামিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর নাসির হোসেন বলেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনে চাঁদাবাজির হাতবদল হতে শুরু করেছে। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন করে কেউ কেউ চাঁদা দাবি করছেন। প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে আমরা বিষয়গুলো তুলে ধরেছি।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা বিসিকে প্রায় ৫০০ তৈরি পোশাক ও নিটিং কারখানা রয়েছে। এসব কারখানার ঝুট কাপড়, সুতার কোন, কার্টুনসহ বিভিন্ন ওয়েস্টেজ পণ্যের ব্যবসা এত দিন নিয়ন্ত্রণ করতেন ওসমান পরিবারের সদস্যরা অয়ন ওসমান ও আজমীর ওসমান। প্রথমজন সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ছেলে ও পরের জন তাঁর ভাতিজা।
বিসিকের ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁদের নামে কিছু লোক ঝুটসহ অন্যান্য পণ্য কারখানা থেকে বিনা মূল্যে বা নামমাত্র দামে নিয়ে যেতেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা তাদের নেতাদের নামে কিছু লোক ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। তাঁরা মোটরসাইকেল নিয়ে নিয়মিত মহড়াও দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফতুল্লা বিসিকের একজন ব্যবসায়ী জানান, মাসে ১০ থেকে ১৫ লাখ ডলারের রপ্তানি আছে এমন একটি মাঝারি পোশাক কারখানায় ২০ থেকে ২২ লাখ টাকার ঝুট ব্যবসা হয়। এসব ঝুটের দাম বাজারে কেজিপ্রতি ৪০ টাকা হলেও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিনা মূল্যে দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেজিপ্রতি ২ থেকে ৪ টাকা কেউ কেউ দিলেও এটা কেবল আনুষ্ঠানিকতা।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা চাঁদাবাজির বিষয়টি ইতিমধ্যে সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের অবহিত করেছি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা দেখছি, কিছু লোক মোটরসাইকেল নিয়ে শিল্পকারখানার সামনে মহড়া দিচ্ছেন। লোক বদলালেও আগের মতো চাঁদাবাজির খপ্পরে পড়তে যাচ্ছেন বলে উদ্যোক্তারা শঙ্কিত।
 

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন