সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১
Proval Logo

আন্দোলনে ফায়দা নিচ্ছে তৃতীয় পক্ষ

প্রকাশিত - ১৬ জুলাই, ২০২৪   ১১:৫১ পিএম
webnews24

প্রভাত রিপোর্ট : সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন জমে উঠেছিলো ভালোই। শিক্ষার্থীদের লাগাতার কর্মসূচিতে সড়ক মহাসড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থেকে চরম ভোগান্তির পরও সাধারণ মানুষের অনেকেই বলছিলেন, কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সমর্থনের কথা। আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিবেচনায় সরকারও ছিল ইতিবাচক মনোভাবে, কিছুটা ঢিলেমি ভাবও ছিল। তবে বিষয়টি যেহেতু ছিল আদালতে বিচারাধীন- সরকারের বক্তব্য ছিল সুরাহা হোক সেখানেই। আদালতের মীমাংসা শেষে করণীয় কিছু থাকলে করা হবে তাও। কিন্তু আন্দোলনরতরা একাট্টা ছিলেন নির্বাহী বিভাগ থেকে দ্রুত সমাধানের তাগিদ নিয়ে। আর এই কারণে চলমান আইনি প্রক্রিয়া অনেকটা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষে গেলেও কর্মসূচি ছাড়েননি তারা।
কয়েকদিনের ব্লকেড কর্মসূচি থেকে সরে এসে জনদুভোর্গ না হয় এমন আন্দোলনের দিকে যাওয়ার ইঙ্গিত ছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের। যদিও গেল বৃহস্পতিবার শাহবাগে রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ করেছেন তারা। পুলিশের এপিসি’র ওপর দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে দেখা গেছে তাদের। কিন্তু এরপরও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিলো ধৈর্যশীল ভূমিকায়। আন্দোলন থেকে হামলা হয়েছিলো গণমাধ্যমকর্মীর ওপরও। যদিও পরে বিবৃতি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের আন্দোলনে অছাত্র- কুছাত্ররা সাংবাদিকের ওপর হামলা করেছিলো বলে দাবি করেছিল তারা।
এরপর রবিবার ছিল রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদানের গণপদযাত্রা। দেশজুড়ে সেই পদযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে। আন্দোলন এবারও পুলিশকে দেখা যায় ধৈর্যশীল অবস্থায়। রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি দেয়ার পর দাবি মানার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় পর্যবেক্ষণের কথা বলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা না যেতেই তৈরি হলো মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত বাংলাদেশের জন্য এক চরম আপত্তিকর অধ্যায়।
রবিবার চীন সফর নিয়ে করা সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মুক্তিযোদ্ধার নাতিদের জন্য কোটা না রেখে কি রাজাকারের নাতিদের জন্য কোটা রাখা হবে! এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রবিবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে নিজেকে রাজাকার ঘোষণার স্লোগান দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশের স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা, স্বৈরাচার থেকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার থেকে মুক্তচিন্তায় অগ্রদূতের ভূমিকা রাখা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে স্লোগানে স্লোগানে নিজেকে রাজাকার ঘোষণা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শত বছর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরে এমনটা কখনো দেখেনি বাঙালি জাতি। শিক্ষার্থীদের এমন স্লোগান দেখে হতবাক অনেকেই সামাজিকমাধ্যমে প্রশ্ন তোলেন এ কোন বাংলাদেশ? এ কোন প্রজন্ম? শুধুমাত্র সরকারি চাকরির কোটা সংস্কারের জন্য নিজেকে এ কেমন বিলিয়ে দেয়া! এ কেমন ছড়িয়ে দেয়া! এ কেমন ধ্বংসের দুয়ারে নিয়ে যাওয়া, নিজেকে এবং নিজের পরিপার্শ্বকে।
রাতেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, বেলা ১২টায় রাজু ভাস্কর্যে জড়ো হবেন তারা। আর ছাত্রলীগ জানিয়েছিল, দুপুর তিনটায় রাজু ভাস্কর্যে সমাবেশ করার কথা। কিন্তু দুপুর তিনটা পেরিয়ে গেলেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্য ছাড়েননি। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও রাজুর দিকে না এসে ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন। হঠাৎ রাজু ভাস্কর্যের অবস্থান থেকে আন্দোলনকারীরা মাইকে ঘোষণা করেন, তাদের কর্মীদের বিজয় একাত্তর হলে আটকে রাখা হয়েছে। ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত অবস্থায় বিজয় একাত্তর হলের দিকে যেতে থাকেন তারা। হলের চত্বরে বেধড়ক পেটাতে থাকেন ছাত্রলীগ কর্মীদের। মার খেয়ে প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়েন ছাত্রলীগ কর্মীরা। তবে কিছু সময়ের মধ্যেই তারাও লাঠিসোটা নিয়ে নেমে পড়েন মাঠে। শুরু হয় সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ বিজয় একাত্তর হল ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর, উপাচার্যের বাসভবনের সামনের সড়ক, টিএসসি এলাকাসহ আশপাশে। এ সময় কলা ভবনের পাশের গুরু দুয়ারার সামনের ফুটপাত দিয়ে এবং ভিসির বাসভবনের সামনে দিয়ে সারি বেধে পালিয়ে যেতে থাকা নারী শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করার ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটায় ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ। বিকেলের দিকে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায়। আহত শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেলে। আর হাসপাতাল চত্বর ও সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। খবর পেয়ে সেদিকে যান ছাত্রলীগ কর্মীরা।
এদিকে ঢাকা মেডিকেলের কাছেই শহীদুল্লাহ হলের দখল নেয় ছাত্রদল কর্মীরা। ছাত্রলীগের হল শাখা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কক্ষে চালায় ব্যাপক ভাঙচুর। এ সময় হলের বাইরে অবস্থান নেয়া ছাত্রলীগ কর্মীরাও ছিল মারমুখী অবস্থায়। শহীদুল্লাহ হল এলাকায় সন্ধ্যার আগে আগে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ও একটি ককটেল বিস্ফোরণ হয়। ছাত্রলীগ আগে আক্রান্ত হয়েছে ঠিক আছে, কিন্তু তারা ক্যাম্পাসে অনেক বহিরাগত অছাত্রকে আশ্রয় দিয়েছে এমন তথ্যও রয়েছে। সোমবারের ঘটনায় শুধু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাই আহত হয়েছেন এমনটা নয়, দুই পক্ষেই ব্যাপক আহত আছে।
কিছুদিন ধরেই আলোচনায় ছিল এই আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে গেছে। চাকরিতে সব ধরনের কোটা সংস্কারের কথা বললেও মূলত ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়েই ছিল এক শ্রেণির মানুষের আপত্তি। সেই শ্রেণিটা কারা? রবিবার মধ্যরাত এবং সোমবার দিনরাত এবং গতকাল মঙ্গলবারের ঘটনায় সেই হিসাব কিছুটা মিলে কি?
প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে রাতে নিজেদের রাজাকার ঘোষণা দিয়ে স্লোগান দিলেন শিক্ষার্থীরা। সকালের আলো না ফুটতেই সেই বক্তব্য বদলে ফেললেন তারা। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের আন্দোলন এখন অনেকটাই সার্বজনীন- কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই আন্দোলন কারা শুরু করেছিল। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের সাধারণ সম্পাদক নিজে বলেছেন, ১৯৯৬ সাল থেকে তারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের আন্দোলন করছেন। এখানে একটা বিষয় আছে উল্লেখ করার মতো। ২০০৩-০৪ সাল; ক্ষমতায় বিএনপি জামায়াত জোট সরকার। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের উত্তর-পশ্চিম পাশের লেকচার থিয়েটার ভবন এলাকা থেকে শিবিরের কিছু ছেলে প্রায়ই মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের স্লোগান নিয়ে মিছিল বের করতো। মিছিলটি মধুর ক্যান্টিন অতিক্রমের চেষ্টা করলে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিলে পালিয়ে যেতেন শিবিরকর্মীরা। কিছুদিন পরপরই তখন এই ঘটনা ঘটতো। সেই সময় যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, অনেকেই এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। সময়ের পরিক্রমায় শিবিরের ব্রেইনচাইল্ড সেই আন্দোলন এখন সার্বজনীনের কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়ে গেল!
দেড় দশকের বেশি সময় আগের সেই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীই এবারের আন্দোলনের জন্য ওঁত পেতে ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। সেই গোষ্ঠীই রবিবার রাতে এবং সোমবার ও গতকাল মঙ্গলবার দিনভর তাদের ফায়দা তুলে নিলো।
অনেক জায়গায় দেখা গেছে ছাত্রলীগ নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা। কেউ কেউ তো ছাত্রলীগকে দানবীয় রূপ পর্যন্ত দিয়ে ফেলার অপচেষ্টা করছেন। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই যোগ দিচ্ছেন সেই কাতারে। কিন্তু তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, কিংবা জানার চেষ্টা করেছেন বিএনপি জামায়াত আমলে, স্বৈরাচার এরশাদের আমলে কেমন ছিল দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অবস্থা? তথনকার সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনগুলো অস্ত্রের ঝনঝনানিতে ক্যাম্পাসগুলো কেমন উত্তপ্ত করে রেখেছিল? ছাত্রদল, ছাত্র সমাজ কিংবা শিবিরের নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে কত প্রাণহানি ঘটেছিল, সেই হিসাব, ইতিহাস আজকের তরুণেরা জানার চেষ্টা করছেন? করেছেন কখনো?
গত দেড় দশকের ক্যাম্পাসগুলোর চিত্র কি এমন ভয়াবহ? হয়তো ছাত্রলীগও ধোয়া তুলসী পাতা না। তাদেরও অনেক ব্যত্যয় আছে। তাই বলে ছাত্রলীগের ওপর হামলা করে আবার তাদেরকেই ভিলেন বানানোর চেষ্টা কি ঠিক?
কেমন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীরা নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিতে পারেন? একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাতের ভয়াবহ বিভীষিকা, রক্তের দাগ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধর্ষিত, শহিদ শিক্ষার্থীদের আর্তনাদ মাত্র ৫০ বছরে মুছে গেল এই হল থেকে? এই হলের শিক্ষার্থী যারা নিজেদের রাজাকার বলতে দ্বিধা করেননি, তাদের বুক একটুও কাঁপল না? শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থীরা কি ভুলে গেছেন ২০০১ সালের ট্র্যাজেডি? রাতের আঁধারে কীভাবে পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের ওপর! হলের ভেতর ঢুকে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা এবং পুলিশ মিলে কেমন বেধড়ক পিটিয়েছিল তাদের! সব ভুলে গেলেন তারা? তবে সবশেষে, একটাই চাওয়া সুষ্ঠু এবং যৌক্তিক সমাধান আসুক এই আন্দোলনের। কোনো সুবিধাবাদী গোষ্ঠী ফায়দা নিতে না পারুক এই আন্দোলন ঘিরে।
প্রভাত/টুর

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন
সংবাদ সম্মেলনে অসত্য তথ্য পরিবেশনের তীব্র প্রতিবাদ
সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা