প্রভাত বাণিজ্য: বিশ্ববাণিজ্যের বৈশ্বিক গতিশীলতায় বইছে পরিবর্তন ও অনিশ্চয়তার হাওয়া, বিশেষত বাংলাদেশের প্রচলিত রপ্তানির গন্তব্য পশ্চিমা দেশগুলোর বাজারে। এই অবস্থায়, এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করার মাধ্যমে রপ্তানি বাজারকে বহুমুখী করার এক কৌশলগত উদ্যোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ।
এর অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে প্রধান প্রধান এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের (জেইসি) সভা করা হবে; যার লক্ষ্যই হবে এসব দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিনিয়োগ বাড়ানো এবং স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ (এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন) পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এর কর্মকর্তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়েনের বাইরে এবার এশিয়ার দেশগুলোতে বাজার সম্প্রসারণের কৌশল নিয়েছে সরকার। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সাথে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলোর কারণে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি, এসব কথা মাথায় রেখেই সরকার এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে এশিয়ার চীন, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়াসহ আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে পর্যায়ক্রমে জেইসি সভা করা হবে।
কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেন যে, আগামী ১ জুন চীনের সঙ্গে জেইসি সভা হতে পারে, এতে অংশগ্রহণের বিষয়ে ইতোমধ্যেই সাড়া দিয়েছে বেইজিং। এছাড়া জুলাই মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে জেইসি সভার সম্ভাবনা রয়েছে। ২০০৪ সালের পর দুই দেশের মধ্যে যা প্রথম এধরনের আলোচনা হতে চলেছে।
অন্যদিকে ইআরডি জেইসি সভার জন্য ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছে সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়াকে। মালয়েশিয়া , ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনেকে চিঠি পাঠানো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে ইআরডির কর্মকর্তারা জানান।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, এটা সময়োচিত উদ্যোগ। আমরা এখনো রপ্তানির ক্ষেত্রে নর্থ-আমেরিকার ওপর ব্যাপক নির্ভরশীল। যদিও ইস্ট এশিয়া ও চায়না থেকে আমদানি অনেক আসে। এটা ভালো উদ্যোগ যে এসব দেশের সঙ্গে সহযোগিতা ও সম্পৃক্ততা বৃদ্ধির কৌশল নিয়েছে সরকার। এসব দেশে বাংলাদেশের রপ্তানির কোন কোন সুযোগ রয়েছে— বাজার সম্প্রসারণ, এবং এসব দেশ থেকে কীভাবে বিনিয়োগ আনা যায়, এমন বিষয়গুলো বাংলাদেশের জন্য এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত এলডিসি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, এ ধরণের উদ্যোগগুলো তার যৌক্তিক জায়গায় পৌঁছে না। আমাদের দেখতে হবে এসব উদ্যোগের যেন আউট-কাম হয়। আমাদের রপ্তানি বাজার এবং বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার বিষয়ে যাতে এই উদ্যোগ কাজে লাগে। তিনি আরো বলেন, আমদানির ক্ষেত্রেও বিকল্প সুযোগ কি কি আছে সেটাও অনুসন্ধান করতে হবে। এছাড়া এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে আর্থিক সহযোগিতার বিষয়টিও দেখতে হবে। বিশেষ করে, সহনশীল শর্তে ঋণ পাওয়ার বিষয়েও পর্যালোচনা করতে হবে। এই উদ্যোগের বহুমাত্রিক ইতিবাচক প্রভাব আমাদের অর্থনীতিতে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ইআরডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, এশিয়ার চীন ও আসিয়ান দেশগুলো বাংলাদেশের জন্য বড় রপ্তানি গন্তব্য হতে পারে। এসব দেশে আমাদের রপ্তানি বৃদ্ধির কৌশল হিসেবে— ইতোমধ্যে জেইসি করার উদোগ নেয়া হয়েছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে চীনের সঙ্গে জেইসি সভার এজেন্ডাগুলো চূড়ান্ত করতে আমরা কাজ করছি, যেখানে বাণিজ্য সম্প্রসারণ বা দেশটিতে আমাদের রপ্তানি বাড়ানোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
জেইসি সভার বিষয়েগুলো চূড়ান্ত করতে আন্তমন্ত্রণালয় সভা আহ্বান করা হয়েছে। আগামীকাল ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও (এশিয়া ও জেইসি) উইংয়ের প্রধান মিরানা মাহরুখে সভাপতিত্বে প্রস্ততিমূলক এ সভার পরই বাংলাদেশ বৈঠকের এজেন্ডাগুলো চূড়ান্ত করবে।
বাংলাদেশ যেসব বিষয়ে প্রস্তাব দেবে সেগুলো চূড়ান্ত করাই হবে সভার মূল বিষয়বস্তু। যার মধ্যে থাকছে, চীনে আম-কাঠাল রপ্তানি, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো এবং আরও সহজশর্তে ঋণ প্রাপ্তির বিষয়েও আলোচনা হবে। এছাড়া ই-কমার্স সহযোগিতা নিয়েও আলোচনা হবে।
ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে জেইসি সভা আগামী ১ জুন অনুষ্ঠিত হবে। ইতোমধ্যে দুই দেশ এ বিষয়ে একমত হয়েছে। ওই সভায় চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন বলে ইতোমধ্যে চীনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এতে চীনের ১০০ থেকে ১৫০ জন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি অংশ নেবেন বলেও জানায় দেশটি। বাংলাদেশর পক্ষে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিবেন অর্থ উপদেষ্টা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা। তাছাড়া, সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহও ইঙ্গিত দেয় যে চীনের থেকে দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্য সুবিধা পেতে আগ্রহী হচ্ছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে দেশটির বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ২০২৮ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে ঘোষণা দেয়া হয় বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক ও র্যাপিড এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এ রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলেন, সক্ষমতা না থাকায় এলডিসি হিসেবে চীনের দেওয়া শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। একারণে চীন হয়তো দুই বছর সুবিধা বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু, চীনা বিনিয়োগসহ রপ্তানিখাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা না গেলে— এ সুবিধাও খুব বেশি কাজে লাগাতে পারবে না বাংলাদেশ। তিনি বলেন, চীন বিশ্বের বৃহত্তম ট্রেডিং ইকোনমি। এই বাজারে দীর্ঘসময় শুল্কমুক্ত সুবিধা স্ট্র্যাটেজিক কারণে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ সুবিধা পেতে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নিতে পারে।
ইআরডি কর্মকর্তারা আরো জানান, বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের সঙ্গেও জেইসি সভার জন্য যোগাযোগ করেছে। এবিষয়ে তাদের সম্মতিও পাওয়া গেছে। বাংলাদেশকে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়, ব্যাংকখাত সংস্কার, পুঁজিবাজার ও বন্ড বাজার, লজিস্টিকস, বন্দর ও মাল্টিমোডাল পরিবহনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে চায় দেশটি। এছাড়া সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতেও বিনিয়োগে করতে চায়। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশিদের জন্য স্বাস্থ্য সেবা প্রক্রিয়া সহজ করার কথাও জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়ায় হালাল পণ্য রপ্তানি করতে চায়। এছাড়া গ্রিন ফাইন্যান্সিং নিয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। জেইসি সভার বিষয়ে ইতোমধ্যে ইআরডির থেকে দেশটিকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।
সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার বিদায়ী রাষ্ট্রদূত হেরু হার্তান্তো সুবোলো-র সঙ্গে সাক্ষাৎকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস আসিয়ান জোটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে দেশটির সমর্থন চেয়েছেন। সেইসঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন বাজার খোলার আহ্বানও জানান।
গত ১৭ এপ্রিল সিপিডির এক সংলাপে সংস্থাটির চেয়ারমান রেহমান সোবহান বলেন, ট্রাম্পের শুল্কনীতি নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মোদ্দাকথা হলো, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানির একক বৃহত্তম বাজার। সেখানে এত অনিশ্চয়তা থাকলে আমাদের বিকল্প খুঁজতে হবে। তিনি আরো বলেন, নিজেদের যে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা আছে, তার মধ্যে থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমাদের বাজার বড় করার চেষ্টা করা উচিত বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। সেখানে আরও কয়েক বছর বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত বাজারের সুবিধা আছে। সেই সঙ্গে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের বাজার অনুসন্ধান করতে হবে। এশিয়ার বাজারও আছে; এই মহাদেশ আগামী দিনে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধির মূল কেন্দ্র হবে। আগামী ২৫ বছরের মধ্যে এশিয়াই হবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বড় জায়গা। এই পরিবর্তনের মধ্যে বাংলাদেশের উচিৎ হবে কৌশলগতভাবে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করা।