প্রভাত রিপোর্ট: সারাদেশেই নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়েছে। নতুন-পুরাতন নির্বাচনমূখী রাজনৈতিক দলগুলো ধীরে ধীরে তাদের কার্যক্রম নিয়ে মাঠে এগোচ্ছে। আর সুষ্ঠু নির্বাচন করাটাই এখন অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। নির্বাচন কমিশনকে ওই সময়ে নির্বাচন করার জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য দ্রুত একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় এসে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করার বিষয়টিতে সব রাজনৈতিক দল একমত হবে এমন আশা করাও ঠিক নয়। বেশির ভাগ দলের সম্মতিটাই গ্রহণযোগ্য। দলগুলোর সবাই নির্বাচন চায়। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং নতুন একটি দল মনে করে, বেশি সময় পেলে তারা তাদের দল গুছিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু তারা যে দল গুছিয়ে নিতে পারবে সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। আবার কারো মতে, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে সমঝোতার বিষয়টিতে বেশির ভাগ দল সমর্থন জানিয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারির প্রথামার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অন্য দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা দরকার। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেশবাসীর দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষা। ভোট দিয়ে নিজেদের পছন্দের সরকার গঠনের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশনের কোনো সমস্যা হবে না।
নির্বাচন নিয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তাদের ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, সব কটি আসনের সম্ভাব্য হেভিওয়েট প্রার্থীরা জোরালোভাবে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। এ ছাড়া সাংগঠনিকভাবেও ঈদ পুনর্মিলনীর আয়োজন করা হয়, যেখানে সম্ভাব্য প্রার্থীকে উপস্থিত রাখা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তৎপর অনেকে। কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ভিন্ন কথা বললেও তাদের স্থানীয় নেতারা নির্বাচনী প্রচারে পিছিয়ে নেই। দল থেকে, বিশেষ করে বিএনপি থেকে কারা প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন তা নিয়েও কৌতূহলের অন্ত নেই। ছোট দলগুলো বড় কোনো দলের সঙ্গে জোট গঠনের অপেক্ষায়। দেশজুড়ে এখন প্রধান আলোচনার বিষয় নির্বাচন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথামার্ধেই হতে যাচ্ছে এমন খবরে জনমনে এক ধরনের স্বস্তি দেশের সর্বত্র। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ এলাকায় জনসংযোগ বাড়িয়েছেন। শোভাযাত্রাও হচ্ছে।
গত শুক্রবার লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের সময় নিয়ে এক ধরনের সমঝোতার পর দেশজুড়ে নির্বাচনী তৎপরতা জোরদার হয়েছে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলি এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একসময় আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলেছিল। পরে প্রধান উাপদেষ্টা ঘোষণা দিলেন, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে। সব শেষে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠক করে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। অর্থাৎ আগামী বছর ফেব্রুয়ারির প্রথামার্ধে নির্বাচন হতে পারে। আমার মনে হয়, এ সময়ে নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশনের কোনো সমস্যা হবে না। এখন নির্বাচন কমিশনকে ওই সময়ে নির্বাচন করতে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য একটি রোডম্যাপ প্রস্তুত করতে হবে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার জন্য এখনো প্রায় ছয় মাস সময় রয়েছে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নির্বাচন হলে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তফসিল ঘোষণা হবে। কিন্তু তার আগে জাতীয় সংসদের আসনগুলোর সীমানা নির্ধারণ, দল নিবন্ধন, আরপিও সংস্কার করতে হলে সে বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি, পর্যবেক্ষক নীতিমালা, অন্যান্য নির্বাচনী বিধি-বিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার এগুলো করতে হবে, করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। কিছু কাজ নির্বাচন কমিশন আগেই শুরু করেছে বলে আমরা জানি। ভোটার তালিকা প্রস্তুত প্রায় সম্পন্ন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও নির্বাচন কমিশনের বৈঠক হওয়া দরকার।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার ধারণা, সব দল এখন নির্বাচনমুখী। কয়েকটি দল তাদের প্রার্থীও চূড়ান্ত করে রেখেছে। মাঠ পর্যায়ে সব দলই, বিশেষ করে জুলাই-গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের দলগুলো জনসংযোগ শুরু করে দিয়েছে। এ অবস্থায় সঠিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাটাই অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। দু-এক মাস আগে-পিছে কিছু আসে যায় না। নির্বাচনটা কেমন হলো সেটাই আসল বিষয়। কারণ একটা নির্বাচনের রেশ অনেক দিন থাকে।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. মো. আব্দুল আলীম বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সংশয়-সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। দেশ দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে চলেছে। সারা দেশে নির্বাচন নিয়েই আলোচনা। লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকে সমঝোতার বিষয়টি বেশির ভাগ দল সমর্থন জানিয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারির প্রথামার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য অন্য দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনা দরকার। এ বিষয়ে আমরা এরই মধ্যে জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দলের প্রতিক্রিয়ার কথা জেনেছি। তারা কিছুটা নাখোশ। তাদের সঙ্গেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনের হাতে সময়ও বেশি নেই। জুলাই মাসে ‘জুলাই সনদ’ ঘোষণার পর সেই সনদের আলোকে চার-পাঁচ মাসের মধ্যে নির্বাচনী বিধি-বিধানেরও কিছুটা সংস্কার প্রয়োজন হবে। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশের জন্য আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও আরো উন্নতি ঘটাতে হবে। সব পক্ষের প্রয়োজনীয় সহযোগিতার মাধ্যমে এটি করা অসম্ভব কিছু নয়।’
সাবেক সচিব ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবু আলম শহীদ খান মনে করেন, নির্বাচন এ দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষা। গত তিনটি নির্বাচনে সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, ‘২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও জনগণের ভোট হাইজ্যাক করা হয়। ভোট হয়েছে রাতের অন্ধকারে ভোটকেন্দ্র দখল করে। বিনা ভোটে নির্বাচনের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণে জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের মানুষের অপেক্ষা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের। অন্তর্বর্তী সরকার একসময় আগামী ডিসেম্বর থেকে জুন, আবার আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধে এবং সব শেষে সম্ভাব্য সময় আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগের সপ্তাহে নির্বাচন হতে পারে বলে জানিয়েছে। কিন্তু এটিও এখন ততটা পরিষ্কার নয়। শর্তসাপেক্ষে হতে পারার মধ্যেই রয়েছে। লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যার তারেক রহমানের সঙ্গে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সমঝোতা বেশির ভাগ দলের কাছে স্বস্তির মনে হলেও জামায়াত ও এনসিপি ভিন্ন কথা বলছে। ড. ইউনূস দেশে ফিরেছেন, তিনি হয়তো উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক করবেন। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্তের জন্যও হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হতে পারে। নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা ও অনিশ্চিয়তা কেটে গেছে, এটা বলার মতো পরিস্থিতি এখনো হয়নি বলে আমার মনে হয়। দলগুলো সবাই নির্বাচন চায়। তবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং নতুন একটি দল মনে করে, বেশি সময় পেলে তারা তাদের দলকে গুছিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু তারা যে দল গুছিয়ে নিতে পারবে সে সম্ভাবনাও দেখছি না। ৫ আগস্টের আগে এই দলের নেতাদের প্রতি যে ধরনের জনসমর্থন ছিল, পরে তা আর দেখা যাচ্ছে না। এই দলটিকে তাদের সভা-সমাবেশ সফল করার জন্য এখন জামায়াত ও কয়েকটি ইসলামী দলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এরা নির্বাচনের জন্য সময় চায়। কিন্তু কতটা সময় চায় তা-ও পরিষ্কার না। এ ছাড়া যে কয়েকটি দল মনে করছে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন করলে তাদের তেমন সুবিধা হবে না, তারাও দ্রুত নির্বাচনের লক্ষ্যে যেকোনো সমঝোতার বিপক্ষে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন যারা চাচ্ছে তারাও আসলে সময়ক্ষেপণের পক্ষে।’