প্রভাত রিপোর্ট: সামাজিক ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহের কারণে অবলীলায় খুন হচ্ছে মানুষ। অধিকাংশই ঘটনাই ঘটছে শিক্ষিত পরিবারে। বাবা-মায়ের হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে বাবা-মা, পরকীয়ার কারণে স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, সম্পত্তির জেরে এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা করছে। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই তুচ্ছ কোনো কারণে ঘটছে। একটি ঘটনার নৃশংসতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটিকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতির দৃষ্টান্ত নয়, দেশে আইনের শাসনের ঘাটতি ও সামাজিক অসুস্থতারও লক্ষণ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সামাজিক অনুশাসন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, অনৈতিক সম্পর্ক, সহনশীলতার অভাব, দ্রুত বিত্তশালী হওয়ার প্রবণতা, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন, আত্মকেন্দ্রিকতা, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব, অসচ্ছলতা ইত্যাদি কারণে ঘটছে এসব ঘটনা।
এ ধরনের অপরাধ কমাতে হলে পরিবারের পাশাপাশি সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বাড়ানোর কথাও বলছেন তারা। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সবাইকে আরও মনোযোগী হতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে- এই পাঁচ মাসে সারাদেশে খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে এক হাজার ৫৮৭টি। এর মধ্যে কয়েক বছর আগের কিছু মামলাও রয়েছে।
পুলিশের তথ্যানুযায়ী, বছরে মোট হত্যাকাণ্ডের ৪০ শতাংশ হয় পারিবারিক কলহের কারণে। নিরপরাধ শিশুরাও স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের কারণে হত্যার শিকার হয়। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে সারাদেশে এক হাজার ৫৮৭টি খুনের ঘটনা ঘটে। এ সময়ে রাজধানীতে ১৬৮ জন খুন হয়। অধিকাংশ খুনের কারণই পারিবারিক। পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে অপরাধ ঘটছে। খুনোখুনিসহ নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে সচেতনতামূলক সভা করতে নির্দেশ দেওয়া আছে।- পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১০ থেকে ১২ জন। এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক কারণে। আর এর প্রধান শিকার নারী ও শিশু।
ঢাকা মহানগরে গত পাঁচ বছরে খুনের মামলা হয়েছে এক হাজার ১০৬১টি। ২০২০ সালে ২১৯টি, ২০২১ সালে ১৬৬টি, ২০২২ সালে ১৭২টি, ২০২৩ সালে ১৬৫টি এবং ২০২৪ সালে মামলা হয়েছে ৩৩৯টি। এসব হত্যাকাণ্ডের বড় একটি অংশ ঘটেছে পারিবারিক কলহ ও দ্বন্দ্বে। হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যানে ঢাকাই শীর্ষে। তবে আয়তন বিবেচনায় ঢাকার জনসংখ্যাও সর্বাধিক।
শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশেই পারিবারিক কলহ আর দ্বন্দ্বের কারণে হত্যা বাড়ছে। গত মে মাসে সারাদেশে খুনের মামলা হয়েছে ৩৪১টি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ১৮০ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা ৪০ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা ৫৮ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৭৪ জন নারী।
২০২৩ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২০৭ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৫৩ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৩২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন নারী। ২০২২ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২০৬ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৪৪ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৪২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৭ জন নারী। ২০২১ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২২৪ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭৩ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭৫ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন নারী। ২০২০ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২৪০ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭১ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৫৬ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন নারী।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১০৫৭ জন নারী। আত্মহত্যা করেন ৬৪৫ জন।
সামাজিক যে অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে তার বেশিরভাগই অর্থ-সম্পদ কেন্দ্র করে। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগি হতো না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে। জমি কেন্দ্র করে এখন সামাজিক অপরাধ বেশি সংঘটিত হচ্ছে।
এ রকম ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক অবক্ষয়কেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি এসব ঘটনার পেছনে প্রযুক্তিনির্ভর জীবন, সহমর্মিতার অভাব, টিভি সিরিয়ালে ক্রাইম সিন দেখে হত্যায় উৎসাহিত হওয়া এবং ব্যক্তিনির্ভর জীবন গড়ে ওঠাকে দায়ী করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা, একে অপরকে ছাড় দেওয়ার মনোভাব গড়ে তোলা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করতে হবে।
ঢাকা আহছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট রাখী গাঙ্গুলী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা নিজেদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারি না অথবা শিখি না। সমাধান কোথায় অথবা কোন জায়গায় স্ট্রেস লেভেল বাড়ছে তা আমরা বুঝি না। এতে একটি একটি করে সমস্যা আমাদের স্ট্রেসকে ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্ট্রেস বাড়তে বাড়তে ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। যখনই ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে তখনই উপচে পড়ছে।’
পারিবারিক সহিংসতার পেছনে মাদকের একটি বড় প্রভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাদকাসক্ত ব্যক্তিরাও সহিংসতার ঘটনা ঘটায়। না জেনে, না বুঝে এমন কিছু আচরণ তারা করে যা সমাজসিদ্ধ নয়। যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার বাড়ছে। যখনই একক পরিবার আবির্ভূত হলো তখনই সন্তানকে স্বার্থপর হতে শেখাচ্ছি আমরা। আমরা ভাগ করে খাবার খাচ্ছি না। কষ্টগুলো ভাগ করছি না। একাকিত্বকে অনুভব করছি আমরা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. মো. তৌহিদুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘অনৈতিক সম্পর্ক, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহের জের, জমি নিয়ে বিরোধ এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে সামাজিক অপরাধ ঘটছে। এর মূল কারণ— আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা। আইন প্রয়োগের জায়গাটি অনেক দুর্বল। এই মুহূর্তে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের যে চরম অবক্ষয় ঘটেছে, সেটা রোধ করতে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে।’
অর্থনৈতিক চাপ ও অনিশ্চয়তাকেও সহিংসতা বাড়ার বড় কারণ মনে করেন অনেকে। অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর বেশ কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট, সুস্থ পারিবারিক বিনোদনের অভাব, তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার। মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে পরস্পরের সঙ্গে বন্ধনের জায়গায় ঘাটতি হচ্ছে।’
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতা কমাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন হয়েছে। শুধু আইন হলেই হবে না, আইনের প্রয়োগ দরকার। শুধু মেয়েরাই সহিংসতার শিকার হয় তা নয়। পুরুষ ও নারী উভয়েই সহিংসতার শিকার হয়। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে পরকীয়া অনেক বেশি বেড়েছে। মানুষের মধ্যে যে ধৈর্যশীলতা থাকা দরকার তা নেই। নৈতিকতা, মূল্যবোধ কমে গেছে। এসব মানসিক অস্থিরতা পারিবারিক সহিংসতার মূল কারণ।’ তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর ছোটখাটো বিষয় নিয়ে যে ঝামেলা তৈরি হয় সেটা মেটানোর জন্য মাঝে যে লোকগুলো থাকে তারা সমাধানে এগিয়ে আসে না। বরং দুজনের মধ্যে আরও ইন্ধন জোগায়। এ কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যায়।’
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে অপরাধ ঘটছে। খুনোখুনিসহ নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে সচেতনতামূলক সভা করতে নির্দেশ দেওয়া আছে। এসব সভায় পুলিশ ওইসব অপরাধের আইন ও শাস্তির বিষয়ে সবাইকে অবগত করে। তারপরও এখানে সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে জরুরি। পাশাপাশি অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান।’