প্রভাত রিপোর্ট: তামাক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় যতটা, তামাকজনিত রোগে চিকিৎসা ও উৎপাদনশীলতা হ্রাসে ক্ষতি তার চেয়ে অনেক বেশি বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, তামাক কর বাড়ানো বা রপ্তানিতে ছাড় দেওয়ার নীতি নয়, মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাই হওয়া উচিত সরকারের মূল অগ্রাধিকার। এ জন্য তামাক চাষ কমিয়ে বিকল্প ফসলের দিকে কৃষকদের উৎসাহিত করা এবং তামাকপণ্য উৎপাদন ও বিপণনে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরো (বিইআর) এবং বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসি (বিএনটিটিপি) আয়োজিত ‘কোম্পানির আগ্রাসনে বাড়ছে তামাক চাষ, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় হুমকি’ শীর্ষক সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন৷
সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও অর্থনৈতিক গবেষণা ব্যুরোর তামাক কর প্রকল্পের ফোকাল পারসন ড. রুমানা হক বলেন, পাট একসময় ‘সোনালী ফসল’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন এর চাষ কমে গিয়েছে৷ অন্যদিকে তামাকের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এটি দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, পরিবেশ ও কৃষি- সব ক্ষেত্রেই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, তামাক চাষ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি, তবে কৃষকদের ক্ষতি না করে বিকল্প চাষে যাওয়ার রোডম্যাপ সরকারকেই তৈরি করতে হবে। বর্তমানে তামাক রপ্তানিতে ট্যাক্স মওকুফ দেওয়ায় কৃষকরা আবার তামাকের দিকে ঝুঁকছেন। এতে একদিকে পরিবেশ ও মাটির ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষকরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন বড় কোম্পানির ওপর।
ড. রুমানা হকের মতে, তামাক থেকে সরকারের যে কর আদায় হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হয় তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায়। তাই বিকল্প রাজস্ব উৎস বাড়ানোই এখন সময়ের দাবি।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসির টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য সুশান্ত সিনহা। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম সিগারেট উৎপাদক দেশ। দেশে বর্তমানে ২৪টি সিগারেট কোম্পানি সক্রিয় রয়েছে, যার মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো ও জাপান টোবাকো সবচেয়ে বড় বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি জানান, দেশের প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করেন- যা ভারত, পাকিস্তান, চীন বা শ্রীলঙ্কার তুলনায় অনেক বেশি। ২০১৯ সালে সরকার তামাকপাতা রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ ট্যাক্স ধাপে ধাপে শূন্যে নামিয়ে আনে। এর ফলে তামাক রপ্তানি বেড়েছে, কিন্তু কৃষকরা এখনো কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সুশান্ত সিনহা বলেন, বাংলাদেশে তামাকপাতার দাম সবচেয়ে কম- প্রতি কেজি মাত্র ১.৬৮ ডলার। এতে কোম্পানিগুলো বিপুল মুনাফা করছে, অথচ কৃষকের ভাগে তেমন কিছুই জোটে না।
বাংলাদেশ নেটওয়ার্ক ফর টোব্যাকো ট্যাক্স পলিসির (বিএনটিটিপি) টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো কর ফাঁকি দিয়ে এবং নির্ধারিত খুচরা মূল্যের বাইরে পণ্য বিক্রি করে বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা লেনদেন করে। এই অতিরিক্ত টাকা লবিং ও প্রভাব বিস্তারে ব্যবহার করা হয়। তামাকের দাম বাড়ানোর কথা উঠলেই বলা হয়, গরিব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু তেল, ডিম, চিনি সব কিছুর দাম বাড়লে তখন বাঁধা দেওয়া হয় না৷ শুধু তামাকের দাম বাড়াতে বাধা দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো বিদেশে অর্থ পাচার করছে এবং কর কাঠামোর ফাঁকফোকর ব্যবহার করছে। সরকারের উচিত এ খাতের প্রকৃত কর আদায় নিশ্চিত করা এবং তামাক রপ্তানিতে প্রণোদনা বা কর ছাড় বন্ধ করা।
তামাক কোম্পানির দ্বৈত চরিত্র দূর করে কৃষকের স্বার্থে নিরপেক্ষ নীতি প্রয়োজন উল্লেখ করে বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সাহানোয়ার সাইদ শাহীন বলেন, তামাক খাতের আর্থিক ও পরিবেশগত ক্ষতি দেশের উন্নয়ন ব্যয়ের প্রায় অর্ধেকের সমান। এ কারণে সরকারের উচিত তামাক কোম্পানির করনীতি, রপ্তানি সুবিধা ও দাম নির্ধারণ ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো শুভঙ্করের ফাঁকি দিচ্ছে। জনগণ যে কর দেয়, তা নানা কৌশলে নিজেদের হাতে রেখে দিচ্ছে। প্রকৃত কর ফাঁকির হিসাব নেই, অথচ স্বাস্থ্য খাতে তামাকজনিত ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রতিযোগিতা আইন ভঙ্গের অভিযোগে তামাক কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা থাকা উচিত। পাশাপাশি কৃষকদের বিকল্প ফসল চাষে সহায়তা ও সচেতনতা বাড়াতে কৃষি সাংবাদিক ফোরাম, বিএনএনটিপিপি ও অন্যান্য তামাকবিরোধী জোটকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন কৃষি সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আবু খালিদ, তামাক কর প্রকল্পের সিনিয়র প্রজেক্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন অফিসার ইব্রাহীম খলিলসহ অন্যান্যরা৷