প্রভাত রিপোর্ট\ : প্রায় এক মাস পর গতকাল রবিবার শ্রেণিকক্ষে ফিরেছে স্কুল শিক্ষার্থীরা। ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে বদলে গেছে দেশের ইতিহাস। ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে তবে অস্থিরতা এখনো পুরোপুরি কাটেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় আতঙ্ক নিয়েই বিদ্যালয়ের পথ ধরতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। বাস্তবতার নিরিখে অভিভাবকরা চাইছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক। এর আগে গত ৭ অগাস্ট থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার নির্দেশনা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। স্কুল খোলার বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, নতুন সরকার বৈঠক করে এ বিষয়ে জানাতে পারবেন। এখন আসলে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ দায়িত্ব নিয়ে কথা বলার সুযোগ আমাদের নেই। তবে যেহেতু কোনো নির্দেশনা নেই, তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা আছে। এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম বৈঠকে গত শুক্রবার দ্রুত সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অন্যদিকে কবে নাগাদ পরীক্ষা শুরু হতে পারে, সে বিষয়ে জানাতে পারেননি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। তিনি বলেন, পরীক্ষা কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত। প্রশ্নও পুড়ে গেছে। এখন তো নতুন করে প্রশ্ন ছাপাতে হবে। কবে নাগাদ পরীক্ষা শুরু হবে, সে বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো খুললেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ছিল অনেক কম।
রবিবার থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে মিরপুরের সাউথ পয়েন্ট স্কুল ও কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তামান্না রহমান। তার মা পারুল আক্তার তার মেয়ের নিরাপত্তা নিয়েই বেশি শঙ্কিত। সেজন্য তিনিই তার মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করছেন। পারুল বললেন, এতোদিনে বাচ্চাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে পড়াশোনায়। কিন্তু তার পরও স্কুলে পাঠাতে ভয় লাগছে। রাস্তাঘাটের পরিস্থিতি ভালো না, নিরাপত্তা তো একেবারেই নেই। যে কোনো সময় যেকোনো জায়গায় হামলার ঘটনা ঘটতে পারে। আবার চুরি-ডাকাতিও বেড়ে গেছে। তাই মেয়েকে একা ছাড়ছি না। বনশ্রী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাবা শফিকুল ইসলাম বলেন, ৭ অগাস্ট থেকে স্কুল খোলা থাকলেও তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণে তার ছেলেকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। তিনি বলেন, সেনাপ্রধান ঘোষণা দেয়ার পরে স্কুল খুলেছে। কিন্তু আমি বাচ্চাকে পাঠাইনি। মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণার আগে পাঠাব না। আর এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে অবস্থা, সেই কারণেই ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর সাহসও পাচ্ছি না। আর কয়েক মাস পরেই এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরুর কথা রয়েছে। এই সময়ে পড়ালেখায় অনিয়মিত হয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে বলে মনে করছেন এই অভিভাবক।
শফিকুল ইসলাম বলেন, এখনকার সময়টা ওদের জন্য অনেক ইম্পোর্টেন্ট। কিন্তু তার পরও স্কুলে পাঠাতে পারছি না। যে ক্ষতিটা হয়ে যাচ্ছে, সেটা সীমাহীন। তার পরও পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক না হলে স্কুলে পাঠাব না ওকে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ এমাম হোসাইন জানান, স্কুল খোলা থাকলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম থাকায় স্বাভাবিক পাঠদান প্রক্রিয়ায় ফেরা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, অনেকের মধ্যে এখনও আতঙ্ক কাজ করছে। অনেকে আবার সরকারি ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছে যে, কবে স্কুল খুলে দেওয়া হবে। তবে শিক্ষার্থী উপস্থিতি অনেক কম। গড়ে ১০-১১ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্লাসে আসছে। ফলে স্বাভাবিক পাঠদানে ফেরা যাচ্ছে না।
রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল আসমা বেগম জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে এখনও ক্লাস শুরু হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের এখানে আর্মি ক্যাম্প থাকায় ক্লাস শুরু করা যায়নি। কারণ ক্লাস খালি নেই। অফিসের কার্যক্রম চলছে। আর আমাদের অনেক শিক্ষার্থী যেহেতু আবাসিক, তারা এখনও আসতে পারেনি। আসার মত পরিবেশ তৈরি হয়নি। অনেকের মাঝে এখনও উৎকণ্ঠা রয়েছে। মিরপুর-১০ নম্বরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নূরে আলম বলেন, ১৫ শতাংশের মত বাচ্চারা ক্লাসে আসছে। বাকিরা আসছে না। এদের অনেকে আবার ট্রাফিকের কাজ, শহর পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত আছে। শিক্ষার্থীরাও নিরপদ পরিবেশে ক্লাস শুরু করতে চান।
শ্যাওড়াপাড়ার মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া রহমান রবিবার থেকে স্কুলে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, স্কুলে যাচ্ছি ঠিকই। কিন্তু এখন তো সারাক্ষণ ডাকাতের আতঙ্ক থাকতে হচ্ছে। স্কুলে যদি আর্মি, পুলিশ বা কোনো নিরাপত্তা বাহিনীকে রাখা যেতÑ তাহলে ভালো হত। কোটা আন্দোলন নিয়ে সহিংস পরিস্থিতিতে গত ১৬ জুলাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর দেশজুড়ে নজিরবিহীন নৈরাজ্যে আরেক দফা হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। পুলিশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন নাগরিকরা। এর মধ্যেই বুধবার থেকেই কিছু বেসরকারি স্কুলে ক্লাস শুরু হয়েছে। রবিবার খুলে গেছে প্রায় সব স্কুল।
অভিভাবকরা বলছেন, দীর্ঘদিন স্কুলের বাইরে থাকায় শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে কারণে দ্রুত বাচ্চাদের ক্লাসে ফেরানো জরুরি ছিল, তবে সময়টা যে স্বস্তির না তাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তারা। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি শিক্ষার্থীদের কীভাবে প্রভাবিত করছে তা নিয়ে বলছিলেন ঢাকার মিরপুর-১২ নম্বরের লিটল ফ্লাওয়ারস প্রিপারেটরি স্কুলের একজন অভিভাবক তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, টিভিতে তো গত কয়েকদিন ধরে ওরা মারামারি দেখেছে। পরশুদিনও সারারাত ডাকাত আতঙ্কে ঘুমাতে পারেনি। ফলে বাইরে বের হলেই তাদের মধ্যে ভয় কাজ করছে। এমন ভয়ঙ্কর পরিবেশ তো আগে দেখেনি ওরা। অনেক অভিভাবক আবার অনলাইনে ক্লাস নেয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর মা ইসরাত জাহান বলেন, কোভিডের সময় তো বাচ্চারা বহুদিন অনলাইনে ক্লাস করেছে। এখন যেহেতু পরিস্থিতি ভালো না, তাই কিছুদিন অনলাইন ক্লাস নেয়া যায়। তাহলে বাচ্চারা কিছুটা হলেও পড়তে বসবে। তিনি বলেন, ওদের অর্ধবার্ষিক মূল্যায়নটাও শেষ হয়নি। চারটা পরীক্ষা হওয়ার পরই স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। তাই এখন অনলাইনে ক্লাস নেয়াটা জরুরি। অপরদিকে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা স্থগিত করায় বিপাকে পড়েছে পরীক্ষার্থীরা। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের থেকে এবার এইচএসি পরীক্ষা দিচ্ছেন মোহাইমিনা ইসলাম মুহু। বার বার পরীক্ষা পেছানোয় পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারছেন না তিনি।
মোহাইমিনা বলেন, কোন সাবজেক্ট ছেড়ে কোনটা পড়ব? সবকিছুই এলোমেলো হয়ে গেল। আমরা সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়ে গেলাম। আমাদের পরীক্ষাগুলো দ্রুত নিয়ে নেয়া দরকার। মোহাইমিনার মা নাহিদ ফারহানা চৌধুরীও বলেন, একটা বড় সংকটে পড়েছি আমরা। এভাবে বারবার পরীক্ষা পেছালে প্রিপারেশন নষ্ট হয়। জোর করেও পড়তে বসাতে পারছি না। তিনি বলেন, সামনে ওদের ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। অথচ এখন এই পরিস্থিতির কারণে ওরা অনেক পিছিয়ে গেল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংস পরিস্থিতিতে গত ১৮ জুলাই থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত রয়েছে। ৪ দফায় পরীক্ষা পেছানোর পরে ১১ অগাস্ট থেকে নতুন সূচিতে পরীক্ষা শুরুর কথা থাকলেও সেটিও দেশের চলমান পরিস্থিতিতে স্থগিত করা হয়।