প্রভাত অর্থনীতি : অর্থনীতিতে নতুন দুশ্চিন্তা এখন বিদেশি ঋণ শোধ। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে যত টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল, তা ১০ মাসেই ফুরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই (জুলাই-মে) বিদেশি ঋণ পরিশোধে খরচ হয়েছে ৩০৭ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২৪৬ কোটি ডলার। সে হিসাবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় এবার ৬০ কোটি ডলার বা ২৫ শতাংশ বেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। এ সময় সুদ ও আসল মিলিয়ে ২৬৮ কোটি ডলার পরিশোধ করেছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের কিস্তি শুরু হয়েছে। তাতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
ডলারের সংকট না কাটায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে নিয়মিতভাবে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে রিজার্ভ কমে গেছে। ২০২৩ সালের ২৬ জুন মোট রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১১৪ কোটি ডলার বা ৩১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের জুনে তা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭১৫ কোটি ডলারে। যদিও প্রকৃত রিজার্ভ আরও কম, প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের মতো নতুন অর্থবছরেও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, খেলাপি ঋণের বোঝা, ক্ষয়িষ্ণু রিজার্ভ। পুরোনো এসব চাপের পাশাপাশি নতুন চাপ হিসেবে সামনে আসছে বিদেশি ঋণ পরিশোধ ও ব্যাংক খাতের দুরবস্থা। তবে অর্থনীতির অন্যতম সূচক প্রবাসী ও রপ্তানি আয়ে কিছুটা স্বস্তি আছে। সার্বিকভাবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া চাপ যেমন সামাল দিতে হবে, তেমনি নতুন চাপও মোকাবিলা করতে হবে। সংকট কাটাতে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), এটাই এখন দেখার বিষয়। মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব সংগ্রহ, ডলার সংকট, খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার এখন অর্থনীতির বড় সমস্যা। এ জন্য কৌশল নির্ধারণ করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাংক খাত যেভাবে চলছে, সেভাবে আর চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। এক মার্কিন ডলারেই কাবু হয়ে পড়েছে পুরো অর্থনীতি। নতুন অর্থমন্ত্রীর সামনে অর্থনীতির বহু চ্যালেঞ্জ। নানা সমস্যায় জর্জরিত অর্থনীতি আজ আরেকটি নতুন অর্থবছরে পা দিল।
২০২০ সালে করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল। বাংলাদেশের অর্থনীতির সূচকগুলো তখনো বেশ ভালো ছিল। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর একে একে খারাপ হতে শুরু করে দেশের অর্থনীতি। এক মার্কিন ডলারেই কাবু হয়ে পড়ে পুরো অর্থনীতি। নিত্যপণ্যের দামে নাকাল অবস্থা সাধারণ মানুষের। নানা সমস্যায় জর্জরিত অর্থনীতি আজ সোমবার নতুন আরেকটি অর্থবছর শুরু করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ এ নিয়ে বলেন, মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব সংগ্রহ, ডলার সংকট, খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার এখন অর্থনীতির বড় সমস্যা। এ জন্য কৌশল নির্ধারণ করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। একদিকে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি, অন্যদিকে উচ্চ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য; এমন সমন্বয়হীনতা থাকলে সংকট কাটবে না।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, বাজারে তদারকি বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হচ্ছে, সেগুলোর দামও বাড়ছে। বাজার তদারকির দুর্বলতার কারণেই এটি ঘটছে। ব্যাংক খাত যেভাবে চলছে, সেভাবে আর চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। এখনই এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে পুরো খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার একটা বার্তা যায়।
১৫ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি। খাদ্য মূল্যস্ফীতিও ১০ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এতে কষ্টের মধ্যে আছেন নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। এ জন্য অনেককে বাজারের ফর্দ ছোট করতে হয়েছে, আবার অন্য খরচ কমিয়ে বাজার খরচ সমন্বয় করছেন কেউ কেউ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসের মধ্যে গত ডিসেম্বর মাসে সর্বনি¤œ ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ছিল। ফলে পুরো অর্থবছরেই সাধারণ মানুষকে গড়ে সাড়ে ৯ শতাংশের মতো মূল্যস্ফীতির চাপ সহ্য করতে হয়েছে। এর মানে হলো, কোনো মানুষ আগের বছরের একই সময়ে ১০০ টাকায় যে পণ্য ও সেবা কিনতে পারতেন, এ বছর ১১ মাস ধরে একই পণ্য ও সেবার জন্য তাঁকে খরচ করতে হচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। যদিও আজ শুরু হওয়া ২০২৪-২৫ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর বিশ্বজুড়ে খাদ্য, জ্বালানি ও পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়। ফলে আমদানি খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। দেখা দেয় ডলার সংকট। ডলারের বিনিময় মূল্যও হু হু করে বাড়তে শুরু করে। এতে সংকট আরও প্রকট হয়। এর প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির সব খাতে।
ডলারের দাম নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর গত মে মাসে ডলারের দাম ও ব্যাংকঋণের সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি জানিয়েছে, ডলারের দাম ১১৭ টাকার আশপাশে থাকবে, যা যা আনুষ্ঠানিকভাবে ১১৮ টাকা। ২০২২ সালের জুনে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৮ টাকা । ফলে ৮৮ টাকার ডলারের দাম ২ বছরে ৩০ টাকা বা ৩৪ শতাংশ বেড়ে যায়।
ডলার সংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি কমেছে শিল্পের মূলধনি যন্ত্র আমদানি। ফলে বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। এতে থমকে গেছে কারখানার আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ, যার প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে আমদানি খরচ হয়েছে ৪ হাজার ৯২১ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১৫ শতাংশ কম। এ সময়ে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রের আমদানি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এদিকে সুদের হার বাজারভিত্তিক হওয়ায় ঋণের সুদ উঠেছে সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশে। ফলে বেড়েছে ব্যবসা করার খরচ। এ কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, এতে কর্মসংস্থান স্থবির হয়ে গেছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে চলতি হিসাবে ৩২৯ কোটি ডলার ঘাটতি হলেও ২০২৩–২৪ অর্থবছরের একই সময়ে ৫৭৯ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত হয়েছে। চলতি হিসাবের পরিস্থিতির উন্নতি হলেও আর্থিক হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। গত জুলাই-মার্চে এই ঘাটতি ছিল ৯২৫ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৯২ কোটি ডলার।
অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচক খারাপ অবস্থায় থাকলেও রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কিছুটা স্বস্তিদায়ক অবস্থায় রয়েছে। ডলারের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে প্রবাসী আয়ে। জুনের প্রথম ২৩ দিনে ২০০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় দেশে এসেছে। এদিকে গত জুলাই-মে সময়ে ৫ হাজার ১৫৪ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় দেশে এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি।
অর্থনীতির গতি কমে আসায় কাঙ্ক্ষিত হারে শুল্ক-কর আদায় হচ্ছে না। এর ফলে সরকারকে খরচের লাগাম টানতে হচ্ছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে ৪ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল এনবিআরের। কিন্তু জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত আদায় হয়েছে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাকি দুই মাসে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে, যা প্রায় অসম্ভব।
এদিকে, সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে ৫৭ শতাংশ, যা গত ৩ অর্থবছরে সর্বনি¤œ। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা।
ব্যাংক খাতের পরিস্থিতিও এখন নাজুক। জোরপূর্বক ব্যাংক একীভূত করতে গিয়ে এ খাতে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে কয়েকটি ব্যাংক। আবার দীর্ঘদিন ধরে তারল্য–সংকটে রয়েছে ইসলামি ধারার বেশ কয়েকটি ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতার কারণে প্রভাবশালীদের মালিকানাধীন ব্যাংক ও তাদের ঋণ অনেকটা তদারকির বাইরে রয়েছে। খেলাপি ঋণ জানুয়ারি থেকে মার্চÍএই তিন মাসেই বেড়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত মার্চের শেষে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। ব্যাংক খাতের পাশাপাশি ধুকছে শেয়ারবাজারও।
অর্থ পাচার ও দুর্নীতি নতুন মাত্রা পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতি ও অঢেল সম্পদের তথ্য বিষয়টিকে নতুন করে সামনে এনেছে। ফলে অর্থনীতি নিয়ে নতুন অর্থমন্ত্রীর সামনে স্বস্তির চেয়ে চ্যালেঞ্জই বেশি। নতুন অর্থমন্ত্রী এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মানুষকে কতটা স্বস্তি দিতে পারবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।