মাকসুদা লিসা : মুখিয়ে ফুটবলপ্রেমীরা। এক ফাইনাল শেষ না হতেই আরেকটি ফাইনাল দেখার অপেক্ষা কাটছে তাদের। কোপা আমেরিকায় প্রত্যাশিতভাবে ফাইনালে নামছে আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ কলম্বিয়া। দক্ষিণ আমেরিকার এই শ্রেষ্ঠত্বের আসরে প্রথমবারের মতো শিরোপা লড়াইয়ে নামছে দুই দেশ। কোপার ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে সোমবার সকাল ৬টায়। অন্যদিকে ৬ ঘণ্টা ব্যবধানে আগেই রাত ১টায় ইউরোর ফাইনালে মুখোমুখি হবে ইংল্যান্ড-স্পেন।
শিরোপা জয়ের দোড়গোড়ায় স্পেন। প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডকে। একইদিনে কোপার পর ইউরোর ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনায় বুদ হয়ে আছে দর্শকরা। ফুটবলপ্রেমীদের এখন সুপার সানডের অপেক্ষা। রাতে ইউরো, সকালে কোপা– গেল কয়েক সপ্তাহ বেশ কেটেছে ফুটবলপ্রেমীদের। যুক্তরাষ্ট্রের মাঠগুলোতে মেসি- রদ্রিগেজদের লাতিনশৈলীর সঙ্গে জার্মানির ভেন্যুগুলোতে ইয়ামাল-সাকাদের গতিময় ফুটবলে বুঁদ হয়ে থাকা দর্শকদের জন্য এখন অপেক্ষা এক সুপার সানডের। জার্মানির বার্লিনে (বাংলাদেশ সময় রোববার রাত ১টা) টগবগে তারুণ্যের স্পেন চ্যালেঞ্জ জানাবে ইংল্যান্ডের অভিজ্ঞদের। বুধবার নেদারল্যান্ডসকে ২-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালে পা রেখেছে ইংলিশরা। দেশের বাইরে কোনো বৈশ্বিক আসরে এটাই তাদের প্রথম ফাইনালে ওঠা। এ নিয়ে টানা দ্বিতীয়বার ইউরোপের শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে ফাইনালে উঠেছে তারা। ঠিক এখানেই ইউরোর সঙ্গে কোপার একটি মিল রয়েছে। কোপাতেও আর্জেন্টিনা টানা দ্বিতীয়বারের মতোই ফাইনাল মঞ্চে। তবে গেল আসরে টাইব্রেকারে ইতালির কাছে হৃদয় ভেঙেছিল ইংল্যান্ডের।
এবার সেই চাপা যন্ত্রণা এবার ঘুচে যাবে, যদি স্পেনকে তারা হারাতে পারে। প্রায় এক মাস আগে শুরু হওয়া ইউরোতে দলের সংখ্যা অবশ্য বেশি, ২৪ দেশ খেলেছে সেখানে। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইতালি শেষ ষোলোতে নেদারল্যান্ডসের কাছে হেরে যায়। অলটাইম ফেভারিট জার্মানির বিদায় হয় কোয়ার্টারে স্পেনের কাছে হেরে। ফ্রান্স আরেক ধাপ এগিয়ে সেমিতে এসে স্প্যানিশদের কাছে হার মানে। তার আগে গ্রুপ পর্ব থেকে বড় দলগুলোর মধ্যে ক্রোয়েশিয়া বাদ পড়ে। রোনালদোরা বাড়ি ফেরেন কোয়ার্টারে এমবাপ্পেদের কাছে হেরে। সেখানে স্পেন ফাইনালে এসেছে ইতালি, ক্রোয়েশিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো দলগুলোকে বিধ্বস্ত করে। টানা ছয় ম্যাচ জিতে এরই মধ্যে ইউরোতে রেকর্ডও গড়েছে ওলমো-ইয়ামালরা। সেই তুলনায় ইংল্যান্ড কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা পেয়েছে। গ্রুপ পর্বে স্লোভেনিয়া, সার্বিয়ার মতো কিছুটা কম শক্তির দলগুলোকে পেয়েছে ইংলিশরা। নকআউটে এসে স্লোভেকিয়া, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসের মোকাবিলা করে। মূলত ডাচ চ্যালেঞ্জটাই সবচেয়ে বড় হার্ডেল ছিল ইংল্যান্ডের সামনে। সেখানে হ্যারি কেইন আর ওয়াটকিনসনের গোলে ডাচদের হৃদয় ভেঙে দেয় ইংলিশরা।
২০০২ থেকে ২০২৪, এই ২২ বছরে বড় টুর্নামেন্টে মোট ২৬টি ফাইনাল খেলেছে স্পেনের দলগুলো। বড় টুর্নামেন্ট বলতে জাতীয় দল পর্যায়ের ফিফা বিশ্বকাপ ও ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ, আর ক্লাব পর্যায়ের চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইউরোপা লিগ। স্পেনের দলগুলো বলতে বোঝানো হচ্ছে স্পেনের জাতীয় দল ও ক্লাবগুলো। গত ২২ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, এ সময়ে স্প্যানিশ দলগুলো ২৬ ফাইনালের একটিতেও হারেনি, জিতেছে সব কটিতেই। দুই দশকের মধ্যে ফাইনালে টানা জয়ের মধ্যে থাকা স্প্যানিশ দলগুলো যাদের হারিয়েছে, তাদের মধ্যে ৯টিই ইংল্যান্ডের! ২০২৪ ইউরোতেও তাহলে স্পেন জিতবে না কেন? বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে স্পেনের দলগুলোর এই অজেয় যাত্রার শুরুর ২০০২ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের জয়ের মধ্য দিয়ে। সে বার ইউরোপের ক্লাবসেরার প্রতিযোগিতার শিরোপার মঞ্চে জার্মানির বায়ার লেভারকুসেনকে হারিয়েছিল রিয়াল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত স্প্যানিশ দলগুলোর বিপক্ষে খেলে পাঁচবার হেরেছে ইতালির দল, তিনবার জার্মানির এবং দুবার ফ্রান্সের দল। চারবার অবশ্য দুই ফাইনালিস্টই স্প্যানিশ হওয়ায় এক দলের জয় অবধারিতই ছিল। স্প্যানিশদের কাছে ফাইনালে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে ইংল্যান্ডের দল। এর মধ্যে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের বর্তমান কোচ গ্যারেথ সাউথগেটও আছেন। ২০০৬ সালের উয়েফা কাপে স্পেনের সেভিয়ার কাছে হেরেছিল সাউথগেটের মিডলসবোরো।
২০০৮ থেকে ২০১২ সালে দুটি ইউরো ও একটি বিশ্বকাপ জেতে স্পেনের জাতীয় দল, একই সময়ে বার্সা জেতে দুটি চ্যাম্পিয়নস লিগ। এত সব ফাইনালের গল্প জেনে মনে হতে পারে ইংল্যান্ডের জয়ের আশা মাঠে নামার আগেই শেষ। না, সাউথগেটের দলের আশার জায়গাও আছে। স্প্যানিশ দলগুলোর শেষ দুটি ফাইনাল হারের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে জার্মানির নাম, যে দেশে এবার ফাইনাল খেলবে ইংল্যান্ড-স্পেন। ২০০১ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল হয়েছিল ইতালির মিলানে। সেখানে ভ্যালেন্সিয়াকে টাইব্রেকারে হারিয়েছিল জার্মানির ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ। এর আগের সপ্তাহে উয়েফা কাপের ফাইনালে স্পেনের আলাভেজকে হারায় ইংল্যান্ডের লিভারপুল। এই ম্যাচটা হয়েছিল জার্মানির ডর্টমুন্ডে। বিশ্বকাপ, ইউরো, চ্যাম্পিয়নস লিগ এবং ইউরোপা লিগের বাইরে ২০১৩ ফিফা কনফেডারেশনস কাপের ফাইনালে (ব্রাজিলের কাছে ৩-০ ব্যবধানে) হেরেছিল স্পেন। এমনিতে মুখোমুখি লড়াইয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে স্পেনের বিপক্ষে বেশি জয়ও ইংল্যান্ডের, ২৭ ম্যাচে ১৪টি। তবে এর কোনোটিই ফাইনালে নয়। আর সেটিই ইংল্যান্ডের জন্য শঙ্কার। যা আশার সঞ্চার করেছে স্প্যানিয়ার্ডদের মধ্যে।
অন্যদিকে মোটামুটি ৬ঘণ্টা ব্যবধানে কোপা আমেরিকায় ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে। উরুগুয়েকে বিদায় করে ২৩ বছর পর ফাইনালে উঠেছে কলম্বিয়া। আর কানাডাকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় ফাইনাল নিশ্চিত করে চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। কোপা আমেরিকার ফাইনালে এ নিয়ে তৃতীয়বার উঠেছে কলম্বিয়া। উল্টো দিকে আর্জেন্টিনার এটি ৩০তম কোপা ফাইনাল। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরটিতে এ নিয়ে ১৬তম বারের মতো মুখোমুখি হতে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়া। এর আগের ১৫ লড়াইয়ে অবশ্য জয়ের পাল্লা ভারী বর্তমান চ্যাম্পিয়নদেরই। ৭টি ম্যাচে জয় পেয়েছে তারা।
অন্যদিকে কলম্বিয়ার জয় ৩ ম্যাচে। বাকি পাঁচটি ম্যাচ হয়েছে ড্র। তবে ড্র হওয়া পাঁচ ম্যাচের মধ্যে তিন ম্যাচের ফলাফল এসেছে। অর্থাৎ নকআউট পর্বে মুখোমুখি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ম্যাচ গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। যেখানে তিনবারই জয় পেয়েছে আর্জেন্টিনা। ২০১৫ আসরের কোয়ার্টার ফাইনাল এবং ১৯৯৩ ও ২০২১ আসরের সেমিফাইনাল জিতে নিয়েছিল দলটি। আর সামগ্রিকভাবে আর্জেন্টিনা এবং কলম্বিয়া এ পর্যন্ত ৩৯টি ম্যাচে মুখোমুখি হয়। যেখানে আর্জেন্টিনার জয়ের সংখ্যা ২২টি, আর ৯ ম্যাচে জিতেছে কলম্বিয়া। ৮টি ম্যাচ হয়েছে ড্র। কোপার ১৯৪৫ আসরে আর্জেন্টিনা ৯-১ গোলে হারিয়েছিল কলম্বিয়াকে। সেটিই তাদের সবচেয়ে বড় ব্যবধানে জয়। বড় ব্যবধানে আর্জেন্টিনাকে হারানোর সুখস্মৃতি খুঁজতে কলম্বিয়াকে ফিরে যেতে হবে ৩০ বছর আগে। ১৯৯৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ’৯৪ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ম্যাচে কলম্বিয়া ৫-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল আর্জেন্টিনাকে।
এবারের কোপা আমেরিকায় বলতে গেলে ঘাম না ঝরিয়েই ফাইনালে উঠে এসেছে আর্জেন্টিনা। তবে শিরোপার লড়াইয়ে সম্ভাব্য সেরা প্রতিপক্ষই পেয়েছেন লিওনেল মেসিরা। উরুগুয়েকে ১-০ গোলে হারিয়ে টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত থাকার নতুন রেকর্ড নিয়ে যে ফাইনালের টিকিট কেটেছে কলম্বিয়া। শারল্যাটে ব্যাংক অব আমেরিকা স্টেডিয়ামে আরো একবার ঝলসে উঠেছে হামেস রদ্রিগেসের নিখুঁত, বাঁকানো ক্রস। ফাইনালে আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়া ম্যাচে ব্রাজিলের ৫ রেফারি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে। ঘোষিত তথ্য অনুয়ায়ী, খেলায় মাঠে থাকছেন ব্রাজিলীয় রেফারি রাফায়েল ক্লস। তার সঙ্গে অ্যাসিসট্যান্ট, ভিএআর মিলিয়ে মোট ৭ জন রেফারির মধ্যে ৫ জনই থাকছেন ব্রাজিলের।
এর আগে ২০২০ সালে কাতার বিশ্বকাপ বাছাইয়ে রেফারি রাফায়েল ক্লসের সঙ্গে সমস্যা হয়েছিল আজেন্টিনার। প্যারাগুয়ের সঙ্গে একটি ম্যাচে মেসিদের পক্ষে একটি পেনাল্টি না দেওয়া, আবার বিরুদ্ধে একটি পেনাল্টি দেওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে আর্জেনটাইনদের। একই ম্যাচে ১৫ পাসের পর মেসির একটি গোল বাতিল করে দিয়েছিলেন তিনি। কারণ গোল বিল্ডআপের ২৭ সেকেন্ড আগে প্যারাগুয়ের একজন খেলোয়াড়কে ফাউল করেছিলেন, যা রাফায়েল ক্লস লো সেলসো-ভিএআরে দেখেছিলেন। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ওই ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র হয়। এদিকে কোপার ফাইনালের টিকিটের মূল্য ১০ গুণ বেড়েছে। কোপা আমেরিকার ফাইনাল বলে কথা! সঙ্গে লিওনেল মেসি যে টুর্নামেন্টের ফাইনালে থাকবেন সেই ম্যাচের টিকিটের দাম চড়া হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই এবারের কোপা আমেরিকার ফাইনালেও ব্যতিক্রম কিছু হচ্ছে না। মায়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামের ফাইনালের টিকিটের জন্য তাই হয়তো দর্শকদের মধ্যে এত হাহাকার। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে ৬৫ হাজার ৩২৬ আসনের স্টেডিয়ামের টিকিটের মূল্যও বাড়িয়ে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। ফাইনালের টিকিটের মূল্য এক লাফে ১০ গুণ বেড়ে গেছে।
প্রভাত/টুর