প্রভাত রিপোর্ট : কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনে মঙ্গলবার দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে ৬জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ঢাকায় ২জন, চট্টগ্রামে ৩জন ও রংপুরে ১জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ২জন শিক্ষার্থী, ২জন পথচারী ও বাকি ৩জনের পরিচয় জানা যায়নি। নিহতদের মধ্যে ৩জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন বলে জানা গেছে। সংঘর্ষে সারা দেশে দুই শতাধিক আহত হয়েছে। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেয়া হয়। এদের মধ্যে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ রয়েছেন বলে জানা গেছে। পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় দেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, গাজীপুর, রংপুর ও রাজশাহীর ৬ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। চট্টগ্রামে নিহত ৩জনই বুকের বাঁ পাশে গুলিবিদ্ধ হন বলে নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. তসলিম উদ্দীন।
দফায় দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, গুলিবর্ষন, কাদাঁনে গ্যাস ও ইট পাটকেল নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে রণক্ষেত্র তৈরি হয় ঢাকাসহ সারাদেশে। কোটা বিরোধী আন্দোলনকারি, ছাত্রলীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষে সারাদেশ ছিলো স্থবির। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে সংঘর্ষ ছিল ব্যাপক । ছাত্রদের বিক্ষোভের কারণে গোটা দেশ ছিলো অচল। কাল শেষ বিকেলে বগুড়া. চট্টগ্রাম, ঢাকা, রংপুর ও রাজশাহীতে বিজিপি মোতায়েন করা হয়েছে। তবে এর আগে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে, গাছের ডাল ফেলে লাটি নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায় আন্দোলনকারীদের।
গতকাল সকাল থেকেই ঢাকার রাজপথ ছিলো থমথমে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সায়েন্সল্যাব, মোহাম্মদপুর বেরিবাধ, বাড্ডা, খিলখেত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সড়কে নেমে কোটা বিরোধী আন্দোলন করতে থাকেন। এসময় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তৈরি হয় তীব্র যানজট। দুপুর একটা থেকে সায়েন্সল্যাব, ঢাকা কলেজ এবং বাড্ডা এলাকায় শিক্ষার্থীদের সাথে ছাত্রলীগ ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়। সেই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে মিরপুর ১০, ১৪, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ধানমন্ডি, কারওয়ানবাজার, উত্তরা হাউজ বিল্ডিং, মহাখালীসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে। প্রথমে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে ছাত্রদের নির্বিত করার চেষ্টা করলেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামা যানবাহনের উপর হামলা চালান।
রাজধানী বাড্ডা এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে বেসরকারী শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ করে। এছাড়া দক্ষিণ যাত্রবাড়ি থেকে উত্তরা এলাকার বেশ কয়েকটি পয়েন্টে চলে এই প্রতিবাদী সমাবেশ। মহাখালী রেলরাইন অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। বিকাল তিনটায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রেল লাইন অবরোধ করে রাখেন তারা। মিরপুর ১০ নম্বরে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালানো হয়। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে সড়ক অবরোধ করার চেষ্টা করলে পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। মিরপুরে ১০ নম্বর গোল চক্করে বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজি (বিইউবিটি), মিরপুর কমার্স কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ, ঢাকা স্টেট কলেজ, ভাসানটেক সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। শিক্ষার্থীরা চার দিকের সড়ক বন্ধ করে দেন। হামলার পরপরই সেখান থেকে সরে যান আন্দোলনকারীরা। এছাড়া উত্তরার হাউজবিল্ডিং থেকে রাজলক্ষ্মী পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
উত্তরার হাউজবিল্ডিং থেকে রাজলক্ষ্মী পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। মূলত বেলা সাড়ে এগারটা থেকে শুরু হয় এই অবরোধ। অবরোধে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইইউবিএটি, শান্ত মারিয়াম, উত্তরা, রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা হাইস্কুল, নওয়াব হাবিবুল্লাহ স্কুল এন্ড কলেজ, গাজীপুরের টঙ্গী সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। যাত্রাবাড়ি, প্রগতি স্মরণী, শান্তিনগরেও চলে এই অবরোধ কর্মসূচী। বেলা দেড়টার দিকে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ ও ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের কয়েকশ ছাত্রী বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শন্তিনগরে মোড়ে অবস্থান নেয়। সেখানে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
দুপুরের পর পুুলিশের সাথে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) আবু সাঈদ নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে বেরোবিতে অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু সাঈদ। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনকারীরা আরও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। পরে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক অবরুদ্ধ করেন। রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতাল থেকে আবু সাঈদের লাশ নিয়ে বেরোবির দিকে যেতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার সব জায়গায় উত্তেজনা দেখা দেয়। এসময় সায়েন্সল্যাব ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা লাঠি ও বাশঁ নিয়ে রাস্তা অবরোধ করে পুলিশ ও ছাত্রলীগের উপর চড়াও হতে থাকে। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগ ও পুলিশ পাল্টা আক্রমন করলে টানা সাড়ে তিনঘন্টা ধরে সংঘর্ষ চলে। এসময় ঢাকা কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে নেয়ার সময় একজন মারা যান। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে পুরান ঢাকার চানখারপুলে। সেসময় গুলিবিদ্ধ হন চারজন। পুলিশ রাবার বুলেট ছুড়লেও দমানো যায়নি ছাত্রদের। মুহূর্মুহ আক্রমনে গোটা ঢাকা অচল হয়ে পড়ে। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, সাধারণ মানুষ দ্বিগবিদিক ছুটাছুটি করতে থাকেন। রাইসুল ইসলাম নামের ঢাকা কলেজের এক ছাত্র এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন এখন তিন দাবির কারণে। প্রথমত, প্রধামন্ত্রীর বক্তব্য সংশোধন করা, দ্বিতীয়, কোটা সংস্কার এবং সর্বশেষ গত কয়েকদিনে বিনা উসকানিতে আমাদের ভাই-বোনদের উপর হামলা করা হয়েছে তার বিচার করা। এই তিন দাবি ছাড়া আমরা রাজপথ থেকে নামবোনা।’
বিকেলের দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন চারজন। তবে হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এক আন্দোলনকারী জানান, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিরা তাদের উপর গুলি চালান। এদিকে কোটা আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে মিছিল করেছে ছাত্রদল। বিকেলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সবাইকে রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে আজ পাঁচজন মারা যাওয়ায় চিন্তিত অভিভাবকরাও। এসব কারণে কাল বিকেলেই অনেকে হল ছাড়ছেন। অনেক অভিভাবকরা চান না যেন তাদের ছেলেমেয়েরা আন্দোলনে না থাকেন। আতংকে শিক্ষার্থীরা হল ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে প্রভোষ্ট ষ্ট্যান্ডিং কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. ইকবাল রউফ মামুন সাংবাদিকদের বলেন, ‘কেউ যদি হল ছেড়ে যায় এটা তার বিষয়। তবে আমরা নিরাপত্তার জন্য শিক্ষার্থীদের রাতে হলে থাকার কথা বলেছি। আমার মনে হয়, নিরাপত্তার কারণে ক্লাস ও পরীক্ষা না থাকায় তারা হল ছাড়ছেন।’
ঢাকার পাশাপাশি সারাদেশে কাল রণক্ষেত্র তৈরি হয়। রংপুরে ছাত্র মারা যাওয়ার পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্ররা। দফায় দফায় ছাত্র, পুলিশের সংঘর্ষ বাধে। বিকেলের দিকে বিজিবি মোতায়েনের পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। চট্টগ্রাম নগরীতে কোটা আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষে দুই জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের ছাত্র। গতকাল বিকেলে আহত অবস্থায় দুজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল ৩টা থেকে নগরের মুরাদপুর, ২ নম্বর গেট এবং ষোলশহরসহ আশেপাশের এলাকায় কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এর আগে দুপুর থেকে বিভিন্ন মোড়ে অবস্থা নেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। দুই নম্বর গেট এলাকায় একটি বাস ভাঙচুর করে তারা। দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে দুজন নিহত হন। নিহতরা হলেন, ওয়াসিম ও ফারুক। এর মধ্যে ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষার্থী। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া এলাকার বাসিন্দা। পথচারীর ফারুকের বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন। সবশেষ পাওয়া তথ্য মতে, ষোলশহর শিক্ষা বোর্ড এলাকায় কোটা আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছে। মুরাদপুর অংশে অবস্থান নিয়েছে কোটা আন্দোলনকারীরা। দুই নম্বর ও ষোলশহর এলাকায় অবস্থান নিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এতে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে রামদাসহ দেশীয় অস্ত্র দেখা গেছে। কোটা আন্দোলনকারীরাও লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এছাড়া বগুড়া, রাজশাহী, ঢাকা আরিচা মহাসড়ক, বরিশাল, খুলনাসহ সারাদেশে সড়ক অবরোধ করে রাখেন আন্দোলনকারীরা।
প্রভাত/টুর