বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ আশ্বিন ১৪৩১
Proval Logo

খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই : দ্রুত লাগাম  টানতে না পারলে সঙ্কট আরও বাড়বে

প্রকাশিত - ১৬ আগস্ট, ২০২৪   ০৯:২০ পিএম
webnews24

সম্পাদকীয় : গত সোমবার প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জুলাইয়ের ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ও মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্যানুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাসে সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা আগের মাসে ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে। দেশে ২০১০-১১ অর্থবছরে গড় খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ। সে হিসাবে প্রায় দেড় দশকের মধ্যে গত মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল সর্বোচ্চ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি ঠেকে ১২ দশমিক ৩ শতাংশে। তারপর এই প্রথম আবার তা সাড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে গেল। আর্থিক নীতি ও রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে অর্থ অপচয় কমাতে ও বাজারে বিদ্যমান সিন্ডিকেট দমনে শক্ত পদক্ষেপ জরুরি। আমদানিতে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে তা ভাঙতে তৎপর হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ে দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো জ্বালানির দাম বাড়লে তার প্রভাব দ্রুতই পড়ে। কিন্তু জ্বালানির দাম কমলে তার প্রভাব সহজে দৃশ্যমান হয় না। 
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচারও মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব রাখে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ১১ দশমিক ১১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সেটিই এর পুরো চিত্র নয় বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, লুকানো খেলাপি ঋণ বরং এর চেয়ে অনেক বেশি। অবলোপন, আদালতের স্থগিতাদেশ, বিশেষ নির্দেশিত হিসাবে থাকা অর্থ ধরলে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ হবে সাড়ে ৪ লাখ থেকে ৫ লাখ কোটি টাকার মধ্যে। তাই শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের গুরুত্ব দেয়া দরকার। 
দেশে বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা রয়েছে। পণ্য উৎস মুখ থেকে পাইকারি বাজার পর্যন্ত আসতে বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়। প্রতি হাতবদলে বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। এ পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক মানুষ যুক্ত। ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, এমনকি প্রশাসনের লোকজন জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে পরিবহন শ্রমিকদের পক্ষ থেকেও নানা সময়ে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায়নি। উল্টো পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে বাজারের প্রতিটি পর্যায়ে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে লাগামহীন হয়ে ওঠে নিত্যপণ্যের দাম। যার ফলে দেখা যায়, ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার দাম বেঁধে দিয়ে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নামিয়ে বাজারে অভিযান ও তদারকি বাড়িয়েও পণ্যের দাম কমাতে পারেনি। 
বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে চাঁদাবাজির উৎপাত অনেকটাই কমে এসেছে। সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধের মাধ্যমে পণ্যের দাম যে কমানো সম্ভব, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলি সবার নজরে এসছে। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কর্মবিরতিতে যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাস্তায় ছিল না ট্রাফিক পুলিশ। তাদের অনুপস্থিতিতে সড়কে যান চালাচল নিয়ন্ত্রণ করেন শিক্ষার্থীরা। এতে একদিকে চাঁদাবাজি কমেছে, অন্যদিকে কমেছে পুলিশের হয়রানিও। যার প্রতিফলন বাজারে স্পষ্ট। স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে শাকসবজির বাজারে। সবজি বিক্রেতাদের ভাষ্য, বাজারে এখন কোনো সিন্ডিকেট ও চাঁদাবাজি না থাকায় সবজির দাম আগের চেয়ে কম। এর মধ্যেই তাদের লাভ হচ্ছে এবং ক্রেতারাও এতে খুশি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে নিত্যপণ্যের দাম আরো অনেক কমে যাবে। সুতরাং দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ জরুরি। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সড়কে শৃঙ্খলায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে বাজার ব্যবস্থাপনায় কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছিল। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে আরেকটি গোষ্ঠী সক্রিয় হচ্ছে। তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বাজার কোনো গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে গেলে আবার অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। তাই কোনো গোষ্ঠী যাতে বাজারে নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারে সে বিষয়ে এখনই শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। 
দেশে পণ্য আমদানি একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। পণ্য আমদানির জন্য বিশেষ কিছু কোম্পানিকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে। পণ্য আমদানিতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ অনুপস্থিত থাকায় তাদের কাছে পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রিত। ফলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে তা প্রভাব রাখছে। পণ্য আমদানিতে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে দেশের ছোট-বড় সব ধরনের কোম্পানিকে পণ্য আমদানির নিবন্ধন দিতে হবে। তারা যাতে কোনো ধরনের প্রভাব ও প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পণ্য আমদানি ও বিপণন করতে পারে, সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। আমদানিকারকের সংখ্যা বেশি থাকলে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি হবে এবং পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। ফলে দামও কমবে।  
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলংকা দৃষ্টান্ত হতে পারে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে দ্রুত সাফল্য দেখিয়েছে। শ্রীলংকা ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে পড়ে ২০২২ সালে। সে সময় মূল্যস্ফীতি ঠেকে প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে বন্ধ হয়ে যায় জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি। আমদানি দায় আর বিদেশী ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করে শ্রীলংকা সরকার। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক সে পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে শ্রীলংকা। মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে গত জুনে নেমে আসে ১ দশমিক ৭ শতাংশে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মে মাসে এ হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। শ্রীলংকার রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে গিয়েছিল ও দুর্নীতি কমেছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনায় অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি সরকারিভাবে বিভিন্ন পণ্যের মজুদ বাড়ানো ও তদারক করা দরকার। পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে বলেই সবার প্রত্যাশা।

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন