সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১
Proval Logo

নতুন সরকারের এক মাস : সব অনিয়ম দুর্নীতি ঘুচে গিয়ে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক

প্রকাশিত - ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪   ০৯:৩২ পিএম
webnews24

সম্পাদকীয় : ছাত্র অভ্যুত্থানে শহীদদের স্বপ্নের সঙ্গে কখনোই বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গণ-অভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তিতে এক তিনি বার্তায় এই কথা বলেন। তিনি বলেন, মাত্র এক মাস হলো অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। তা সত্ত্বেও আমরা বিপ্লবের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার শুরু করেছি। আমাদের প্রথম কাজ জুলাই ও আগস্টের হত্যাকা-ের বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। তিনি আরও বলেন, গণহত্যার বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত পরিচালনা করার জন্য আমরা জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। তারা এই দেশে এসেছেন এবং তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। গণহত্যায় অভিযুক্তদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল তৈরি প্রয়াস নেয়া হয়েছে জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, জুলাই ও আগস্ট মাসে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইব্যুনাল তৈরির প্রয়াসে শীর্ষ আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। খুনিদের প্রত্যর্পণের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা খুনিদের প্রত্যর্পণ এবং স্বৈরাচারের সময় দুর্নীতিবাজ, রাজনীতিবিদ ও আমলারা যে পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছে, তা দেশে ফিরিয়ে আনতে চাই। এ জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি। ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের তালিকা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা শহীদ ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির জন্য ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছি। মূল তালিকা হয়ে গেছে। এখন শুধু দূর-দূরান্তে যাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাদের তথ্য সংগ্রহ করে তথ্যগুলোতে পূর্ণাঙ্গতা দেয়া হচ্ছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন, ক্ষমতা দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত করে। এই কথার পূর্ণ প্রতিফলন দেখা গেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের কর্মকা-ে। তবে ক্ষমতার স্বাভাবিক নিয়ম এই যে তা চিরস্থায়ী নয়। নিয়ম মেনেই তাই গত ৫ আগস্ট তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। অবসান ঘটে আওয়ামী লীগের টানা দেড় দশকের শাসনের। সেই পতনের এক মাস পূর্ণ হলো বৃহস্পতিবার। এর আগে ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোটের কাছে পরাজয়ের পর ২০০৯ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারও ক্ষমতায় এসেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ২০১৪, ২০১৯ ও ২০২৪-এর নির্বাচনে জয়লাভ করে সব মিলিয়ে পরপর ৪ বার সরকার গঠন করে দলটি। কিন্তু এই ৩ বারের নির্বাচনই ছিল ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ ও একপেশে। 
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দলটি টানা ক্ষমতায় ছিল। সে বছর বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে সাময়িক বিলোপ ঘটে আওয়ামী লীগের। ওই বছরের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হলে দুই দশকের জন্য ক্ষমতার বাইরে চলে যায় শেখ পরিবার। সে সময় দেশের বাইরে ছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর বাংলাদেশে বহুদলীয় রাজনীতি চালু করে দেয়া হলে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসেছিল এ দল। শেখ হাসিনা দলটির হাল ধরেছিলেন ১৯৮১ সালে। এর প্রায় ৪৩ বছর পর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ থেকে তার পালাতে বাধ্য হন তিনি। এ গণ-অভ্যুত্থানের ভিত ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন। এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ওপর তৎকালীন সরকার দমন-পীড়ন চালালে পরবর্তী সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন গণবিক্ষোভের রূপ নেয়। ফলে আন্দোলন ব্যাপ্তি পায়। নানা কারণে দীর্ঘ বছর ধরে মানুষের মনে যে ক্ষোভ জমেছিল, তা আন্দোলনকে বেগবান করে। জমা ক্ষোভের মধ্যে অন্যতম ছিল একতরফা বা জালিয়াতির নির্বাচন, বিরুদ্ধ মত দমন, অনিয়ম আর দুর্নীতি, সর্বাপেক্ষা আয়বৈষম্য যা দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুর দশাকেই নির্দেশ করে। 
আওয়ামী লীগ তার সর্বশেষ শাসনামলজুড়ে উন্নয়নের একটি ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছিল। যে উন্নয়ন ছিল অবকাঠামো উন্নয়ন ঘিরে। সেখানে সুশাসনের উপস্থিতি ছিল না। ফলে একসময় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দলটি। দেশের আপামর জনগণ যখন সুষমভাবে উন্নয়নের উপকারভোগী হতে পারে না, তখন সে উন্নয়ন অর্থপূর্ণ হতে পারে না, এর দৃষ্টান্ত আওয়ামী লীগ সরকার। দলটি বেশির ভাগ সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার ভিত হিসেবে ব্যবহার করেছে। দলটি পুরোপুরি প্রশাসন ও আমলানির্ভর হয়ে উঠেছিল। অবমূল্যায়ন করেছে দলের পরীক্ষিত যোগ্য নেতাকর্মীদের। পদ দেয়া হতো স্বজনপ্রীতি বা অর্থের বিনিময়ে। রাজনীতিবিদদের জায়গা দেয়া হয়েছিল অসাধু ব্যবসায়ীদের যারা অর্থ দিয়ে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। এভাবে বলপ্রয়োগের রাজনীতি এ সরকারের শাসনের ভিত্তি হয়ে ওঠে। অনিয়ম ও দুর্নীতি দলটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে, যার একটি নজির বেগমপাড়া। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদাধিকারীদের গড়ে উঠেছিল সম্পদের পাহাড়। বিশ্বব্যাপী অর্থ পাচারের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯-২৩ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামালে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। আয়, সম্পদ ও সুযোগের এ ধরনের প্রকট বৈষম্য সাদা চোখে জনগণ দেখতে পাচ্ছিলেন। 
কিছু মানুষের অঢেল সম্পদ গড়ার বিপরীতে দেশের সাধারণ মানুষ আর্থিক কষ্টে দিন যাপন করেছে এবং এখনো সে দুর্দশা কাটেনি। বিশৃঙ্খল বাজার ব্যবস্থাপনা ও সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে নাভিশ্বাস উঠেছে নির্দিষ্ট ও নি¤œ আয়ের মানুষের। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু এর সুবিধাগুলোর সুষম ও ন্যায্যবণ্টন হয়নি। যে কারণে দুই বছরের বেশি সময় ধরে প্রয়োজনীয় খাবার গ্রহণের তালিকা ছোট করতে হচ্ছে মানুষকে। বেড়েছে জীবনযাপনের ব্যয়। স্বাস্থ্যসেবায় বেড়েছে পকেট ব্যয়। খাদ্য, চিকিৎসার মতো অতীব জরুরি মৌলিক অধিকারসহ জনসাধারণের ভোটদান, মতপ্রকাশ এমন আরো অনেক মৌলিক অধিকার খর্ব হয়েছে এ সরকারের আমলে। নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় এলেও শেখ হাসিনা সরকার ধীরে ধীরে কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল। বিরোধী দলকে বিলুপ্ত ও নিষ্ক্রিয় করার সর্বাত্মক চেষ্টা গুম-খুন, গ্রেফতার, দমন-পীড়ন চালিয়েছে দলটি। এ সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ।
বাংলাদেশের জনগণের কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে নেয়া অবস্থান একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। সরকার যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলে তাকে জনগণই ক্ষমতাচ্যুত করার সামর্থ্য রাখে। শাসক যত বেশি নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে, তার বিরুদ্ধে জনগণের অবস্থানও ততটাই শক্ত ও দৃঢ় হয়। ফলে শেখ হাসিনাকে কেবল পদত্যাগই নয়, দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার এভাবে শাসনের অবসান ঘটার পর দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের যেমন এক মাস অতিবাহিত হয়েছে তেমনি অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ প্রায় এক মাসের কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে। গত ১৫ বছরের অনিয়ম, অরাজকতা দূর করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ৮ আগস্ট একটা হযবরল অবস্থায় দায়িত্ব গ্রহণের পর সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে দেশ। সুতরাং আওয়ামী লীগ ও প্রকৃতির সৃষ্ট দুর্যোগের মুখে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আমরা বিশ্বাসী হতে চাই। আমরা সময় দিয়ে এবং নিয়ে দেখতে চাই দুর্দশাগ্রস্ত দেশ ও ভঙ্গুর অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন। এক্ষেত্রে দেশে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনীতি স্থিতিশীল করা জরুরি। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি ঘুচে গিয়ে শৃঙ্খলা ফিরে শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠবে বলেই প্রত্যাশা সবার। 

ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে সঙ্গে থাকুন
ওয়েব নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

আরও পড়ুন